ফ্যসিবাদী শাসনের কারণেই দেশে মানবাধিকার নেই

0

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে’ দেশের প্রধান রাজনৈতিক সংকট হিসেবে উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানিয়েছেন।

তারা বলেন, ফ্যসিবাদী শাসনের কারণেই দেশে মানবাধিকার নেই। বাক স্বাধীনতা নেই। গুম, খুন, দমন-পীড়ন বেড়েছে। সর্বত্র দলীয়করণের অপচেষ্টা চলছে। সাংবিধানিকভাবেই দেশে বর্তমানে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বিএফইউজের চার যুগপূর্তি উপলক্ষে শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে আয়োজিত সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।

‘গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের সংকট : উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট কলামিস্ট ও সমাজচিন্তক ফরহাদ মজহার।

সভাপতিত্ব করেন বিএফইউজের সভাপতি এম আবদুল্লাহ। প্রধান আলোচক ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভিসি ড. আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বিএফইউজে মহাসচিব নূরুল আমিন রোকন।

বক্তব্য রাখেন বিএফইউজে ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি এবং সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের আহ্বায়ক শওকত মাহমুদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম, সুপ্রিমকোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার নাসরিন সুলতানা মিলি, দ্য ডেইলি নিউনেশন-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোস্তফা কামাল মজুমদার, বিএফইউজের সাবেক মহাসচিব এম এ আজিজ, ডিইউজে সভাপতি কাদের গনি চৌধুরী, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, ডিইউজে সাধারণ সম্পাদক মো: শহীদুল ইসলাম, ডিইউজের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ বাকের হোসাইন ও জাহাঙ্গীর আলম প্রধান।

মূল প্রবন্ধে ফরহাদ মজহার বলেন, গণতন্ত্রের প্রধান সংকট গণতন্ত্র নিজে। বাংলাদেশের সংকট আরো গভীরে। যেখানে বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা উৎখাত করবার কথা, সেখানে গণতন্ত্র কথাটিকে যত্রতত্র নানা অর্থে নানান মতলবে ব্যবহারটাই বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক সংকট। গণতন্ত্র হয়ে ওঠেছে স্রেফ নির্বাচন, যাতে বিরোধী দল ক্ষমতায় যেতে পারে। নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র এই ধারণার আধিপত্য বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে। গণমাধ্যমের সংকটও মূলত চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চনার সাথে যুক্ত বলে তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ বা জাতিবাদ একটি ফ্যাসিস্ট মতবাদ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে এই ফ্যাসিস্ট মতবাদ গড়ে উঠেছে।

প্রধান আলোচক ড. আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ফ্যাসিবাদের সূচনার সাথে বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট সরকারের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

তিনি বলেন, দেশে বর্তমানে এক ব্যক্তির শাসন চলছে। যা কিছু ঘটছে, সব ওই ব্যক্তির ইচ্ছায়। পাকিস্তান আমলের আইউব-ইয়াহিয়ার চেয়ে আরো কঠোর ফ্যাসিবাদী শাসন চলছে। এখন আইন-আদালতকে ব্যবহার করে দমন-পীড়নে হচ্ছে। বর্তমান শাসন ব্যবস্থায় গণতন্ত্র নির্বাসনে গেছে। সত্য নির্বাসনে গেছে। অথচ এসবের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ নেই। এখন বুদ্ধিজীবীরা তল্পিবাহক হয়ে আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা দলীয় ক্যাডারের ভূমিকা রাখছেন। অধিকাংশ টেলিভিশন চ্যানেল সরকারের গুণকীর্তন নিয়ে ব্যস্ত। সত্য যাতে প্রকাশ না হয়, এ কারণে ভীতি ছড়িয়ে রাখা হয়েছে। সাংবাদিকরা অতীতের ন্যায় সাহস করে এগিয়ে এলে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

বিএফইউজে ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি এবং সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের আহ্বায়ক শওকত মাহমুদ গণমাধ্যম প্রান্তিক অবস্থায় এসে ঠেকেছে উল্লেখ করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে জনগণের মধ্যে বিভাজন তৈরি চেষ্টা চলছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর ৭ (খ) ধারার মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গণজাগরণ সৃষ্টির মাধ্যমেই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা উপড়ে ফেলা সম্ভব।

তিনি ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে সাংবাদিক সমাজের সাহসী ভূমিকার কথা স্মরণ করে বলেন, বাংলাদেশের সাংবাদিক ও গণমাধ্যম বরাবরই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছে। বর্তমানে যেসব ফ্যাসিবাদের পদলেহী হিসেবে সুবিধা ভোগ করছেন, তাদের ব্যাপারে সতর্ক হবার আহ্বান জানান।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম দেশ এখন কঠিন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে উল্লেখ করে বলেন, শুধুমাত্র গণমাধ্যমের ঐক্যই দেশকে সকল সংকট থেকে মুক্ত করতে পারে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী রাজনৈতিক ঐক্যকেও সুদৃঢ় করবে।

মোস্তফা কামাল মজুমদার বলেন, গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে মানবাধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত জরুরি।

ব্যারিস্টার নাসরিন সুলতানা মিলি বলেন, জাতির দুর্ভাগ্য যে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এসেও গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের সংকট নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। ফ্যাসিবাদ থেকে উত্তরণে গণমাধ্যমের ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু গণমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকার কারণেই সাংবাদিকরা সাহস করে কিছু লিখতে পারছেন না।

বিএফইউজের সাবেক মহাসচিব এম এ আজিজ বলেন, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ-দুটি পৃথক সত্তা। যারা গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে চিৎকার করে তারা নিজেরাও গণতন্ত্র মানেন না।

তিনি বলেন, বর্তমানে রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে ব্যবসায়ী ও আমলা দ্বারা। তিনি সংবিধান সংশোধনের দাবি তুলে বলেন, সাংবিধানিকভাবেই দেশে কর্তৃত্ববাদ-একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সমালোচনার মুখ বন্ধ করতেই ডিজিটাল নিরাপত্তাসহ বহু কালাকানুন হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

সিনিয়র সাংবাদিক আবদুল আউয়াল ঠাকুর দেশের সংকটময় পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেন, গুম-হত্যা-নির্যাতন এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে, মানুষ আজ শংকিত। গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব।

ডিইউজে সভাপতি কাদের গনি চৌধুরী বলেন, গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সব কিছুই আছে, শুধু নেই ‘জনগণ’। দেশে এখন সাংবিধানিকভাবে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে।
তিনি নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সংলাপকে ‘নাটক’ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, অস্ত্র যেমন কোনো বিষয় নয়’ দেখা হয় অস্ত্র কে পরিচালনা করে। তেমনি নির্বাচন কমিশন নয়, সেই কমিশন কাদের দ্বারা পরিচালিত হবে সেটি গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান স্বৈর শাসকের বিদায় ছাড়া গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় বলে মত দেন এ সাংবাদিক নেতা।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান বলেন, গণতন্ত্র না থাকার কারণেই গণমাধ্যমে সংকট বিরাজ করছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। নির্বিচারে গুম-খুন হচ্ছে। বর্তমানে অনেক গণমাধ্যম বন্ধ, বহু সাংবাদিক বেকার। সরকারের রোষাণলের শিকার হয়ে অনেক সাংবাদিক কারাবন্দি হয়ে আছেন।

ডিইউজে সাধারণ সম্পাদক মো: শহীদুল ইসলাম বলেন, ঐক্যবদ্ধ হয়ে সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে ফ্যাসিবাদকে উৎখাত করতে হবে।

দেশে স্বৈরশাসনের সকল লক্ষণ বিরাজমান উল্লেখ করে সভার সভাপতি এম আবদুল্লাহ স্বাগত বক্তব্যে বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বিএফইউজের চার যুগপূর্তি এমন এক সময়ে উদযাপন হচ্ছে, দেশে যখন এক রুদ্ধশ্বাস অবস্থা।

প্রেস বিজ্ঞপ্তি

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com