কবে ফিরবে সড়কে শৃঙ্খলা?

0

স্বাধীনতার ৫০ বছরে নিরাপদ সড়কের দাবির পাশাপাশি পরিবহণ চালক ও হেলপারদের সন্তানদের স্কুলে লেখাপড়ার খরচ বিনামূল্যে এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্ধেক ফিতে নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই। পরিবহণ চালক, হেলপাররা আমাদের ভাই। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে তাদের জীবনমানের উন্নতি করতে হবে।

করোনাকালে চালকদের পাশে দাঁড়ায়নি মালিকরা। কিন্তু নিসচার প্রত্যেক শাখার কর্মীরা করোনার মধ্যে গণপরিবহণ বন্ধের সময় নিজেরা ঈদ করার আগে সাধ্যমতো পরিবহণ চালকদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এই দেশের মানুষ না খেয়ে থাকলে আমি খেতে চাই না। এই দেশের মানুষ কষ্টে থাকলে আমি সুখে থাকতে চাই না। সড়ক দুর্ঘটনারোধে আইন ছাড়া মানুষকে সচেতন করা সম্ভব নয়, শুধু আইনের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা যাবে না-এই কথাটি যারা বলেন তা ঠিক নয়।

আমরা সব সময় আমাদের নিজেদের পয়সা দিয়ে মানুষের কল্যাণে কাজ করছি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে নিসচা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের মাটির ব্যাংকে জমা রাখা গচ্ছিত টাকা ভেঙে সেই অর্থ দিয়ে স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে ৫০টি সেলাই মেশিন বিতরণ করে ১৯ নভেম্বর। এই ৫০ সেলাই মেশিনের বাইরেও আরও ৫০টি দেওয়া হয় নিসচার শাখা কমিটির পক্ষ থেকে। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত পরিবারের সদস্যরা উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ে। পঙ্গুত্ব হওয়া ব্যক্তিরা নিঃস্ব হয়ে পড়ে। এ পরিবারগুলো যাতে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ করে নিতে পারে, সে কারণে তাদের মাঝে সেলাই মেশিন তুলে দেওয়া হয়। আমি যতদিন বেঁচে থাকব, যতদিন নিসচা থাকবে, ততদিন দেশের মানুষের পাশে থাকব। প্রতিবছর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে নিসচা এই মানবিক কাজটি করে থাকে।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর ২৯ বছরের পথাচলা সুখকর নয়। করোনার সর্বনাশা ছোবলে বিপর্যস্ত পুরো বিশ্ব এখন বেঁচে থাকার লড়াই করছে। আর তাই নিসচার ২৯ বছরের এই শুরুটা হচ্ছে নতুন সংগ্রামের মধ্যদিয়ে, বেদনাবিধুর পরিবেশে। শুধু তাই নয়, যে কষ্ট আমাকে ২০১৮ সাল থেকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে-এই প্রশ্নে আমরা আমাদের আগামী প্রজন্মকে কোথায় ঠেলে দিচ্ছি? আপনারা জানেন, ২০১৮ সালে মর্মান্তিক এক ঘটনার মধ্য দিয়ে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আমাদের দেশের ছাত্ররা রাস্তায় নেমেছিল।

পুরো দেশ যেন সেদিন সড়কে এসে নেমেছিল। কিন্তু তাদের ঘরে ফেরানো হলো, সড়ক নিরাপদ করার অঙ্গীকার দিয়ে। প্রশ্ন হচ্ছে, যে অঙ্গীকারে আমাদের সন্তানদের ঘরে ফেরানো হলো, তা কি আদৌ বাস্তবায়ন হয়েছে। বহুল কাঙ্ক্ষিত ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহণ আইন কি বাস্তবায়ন হয়েছে? সড়ক কি নিরাপদ হয়েছে? তাহলে কেন সিটি করপোরেশনের বর্জ্য সরানোর গাড়ির নিচে কোমলমতি ছাত্রদের জীবন দিতে হচ্ছে, কেন বাস থেকে ফেলে দিয়ে বা উঠতে না দিয়ে ছাত্রদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে? এ প্রশ্ন জাতির বিবেকের কাছে রাখছি। কারণ তিন বছরের মাথায় নতুন করে আবার এই ছাত্ররাই এখন রাস্তায় নেমেছে। এবারও সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করার জন্য, নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়ন করার জন্য দাবি তুলেছে। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার গণপরিবহণে হাফ ভাড়ার দাবি আদায়ের জন্য।

আপনারা জানেন, ২৮ বছর আগে আমার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর এফডিসি থেকে প্রেস ক্লাব পর্যন্ত একটি র‌্যালির মাধ্যমে নিরাপদ সড়ক চাই স্লোগানে আমাদের কার্যক্রম শুরু করেছিলাম। কিন্তু এই ২৮ বছরে আমরা যা চেয়েছিলাম তা কি পেয়েছি? আমি আমার স্ত্রীকে হারিয়েছি, আমি তো আমার স্ত্রীকে ফিরে পাব না, কিন্তু আমাদের সন্তানদের, এই দেশের মানুষকে তো দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করতে পারব। স্বাধীনতার সূর্যসৈনিক আমাদের যে মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে আছেন, তাদের অন্তত একটি নিরাপদ সড়ক দিতে পারব।

২৫ বছর পাকিস্তানি দুঃশাসন হটিয়ে আমরা স্বাধীন হতে পেরেছি। কিন্তু ২৮ বছর যুদ্ধ করে নিরাপদ সড়ক আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। প্রসঙ্গত, ১ ডিসেম্বর আমরা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের যাত্রা শুরু করেছিলাম, কারণ এ মাসটি হলো বিজয়ের মাস। এ বিজয়ের মাসে আমরা যেন আরেকটি যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারি এই উদ্দেশ্যে। কিন্তু অত্যন্ত দঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, সড়কে আজও মৃত্যুও মিছিল থামেনি।

দীর্ঘদিন ধরে আমি আন্দোলন করছি যেন সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসে। এর জন্য একটি আইনের দরকার ছিল। সড়কে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সে যেন ন্যায়বিচার পায়। প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যায়বিচার। সেজন্য পুরোনো আইনকে যুগোপযোগী করে একটি নতুন আইন চেয়েছিলাম। সে আইনটি ২০১৮ সালে সংসদে পাশ হওয়ার পর ২০১৯ সালে ১ নভেম্বর এটি বাস্তবায়ন হওয়ার কথা থাকলেও আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এ পরিস্থিতিতে আমি বলব, আইনটির বাস্তবায়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তা যেন অচিরেই বাস্তবায়িত হয় এবং সড়ককে নিরাপদ করার জন্য আমরা সরকারকে যে সাজেশন দিয়েছি, তাও যেন বাস্তবায়ন করা হয়।

আমি সব সময় দেশকে ভালোবাসার কথা বলি। মুখে মুখে অনেকে বলেন, কিন্তু এ ভালোবাসা কাজের মাধ্যমে প্রমাণ দিতে হবে। যে যেখানে থাকুন, সেখান থেকে নিজের সামর্থ্য দিয়ে দেশের জন্য কাজ করা-সেটিকে বলে দেশপ্রেম। সেই প্রমাণ দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা অনেকে বলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে তারা জানেন। দেশপ্রেম কী তারা জানেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা কত কষ্ট করেছি! কত কষ্টের বিনিময়ে এই দেশকে স্বাধীন করেছি এটা কি কেউ অনুধাবন করেন? সেই চেতনা কি আমরা লালন করি? যদি লালন করতাম তাহলে এই ২৮ বছরে আমাদের দেশে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে পারতাম। আমাদের রাজনীতিবিদ যারা আছেন, তাদের সদিচ্ছা যদি থাকত, তাহলে তারা যে এলাকায় থাকেন সে এলাকার দুর্ঘটনা রোধে চেষ্টা করতেন, তাহলেও দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কমে যেত। আমরা রাজনৈতিক নেতারা নিজেরাই তো সড়কে নিয়ম মানি না। বরং সড়কে চলাচলে যার যতটুকু ক্ষমতা তা প্রয়োগ করি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী? আমাদের স্বাধীন সত্তার অধিকার, আমাদের খাদ্য ও বস্ত্রের অধিকার, বাসস্থানের অধিকার, আমাদের চিকিৎসার অধিকার, আমাদের শিক্ষার অধিকার। সবই তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে যখন অর্থনৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ় হবে। আর এই অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে সবার জন্য। কোনো গোষ্ঠীর জন্য নয়। এই চেতনা নিয়েই মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন। আজ শুধু আপনারা নিজেদের কথা ভাবেন। এটা কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা?

দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আজ হাফ ভাড়ার জন্য রাস্তায় নামতে হয় ছাত্রদের। কেন তারা রাস্তায় নামবে? আমি আপনি যখন ছাত্র ছিলাম তখন কি আমরা হাফ ভাড়ার সুযোগ পাইনি? পেয়েছি। তাহলে আমাদের সন্তানরা পাবে না কেন? আমি জোর দাবি জানিয়ে বলব, সারা দেশের সব গণপরিবহণে শিক্ষার্থীদের জন্য এই হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করা হোক। আমি বলতে চাই, শিক্ষার্থীদের জন্য পরিবহণে হাফ ভাড়ার পাশাপাশি পরিবহণ চালক ও শ্রমিকদের সন্তানদের পড়ালেখা অবৈতনিক করা হোক (খাতা-কলম, জামা-কাপড়ের খরচ ছাড়া)। পরিবহণ শ্রমিকরা তাহলে তাদের সন্তানদের পড়ালেখার ব্যয় থেকে রেহাই পাবেন। সন্তানদের শিক্ষা ব্যয় মেটাতে গিয়ে তারা যে আর্থিক টানাপোড়েনে ভোগেন, সেখান থেকে স্বস্তিতে থাকবেন তারা। সেই সঙ্গে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও তাদের হাফ বেতনে পড়ালেখা করানোর সুযোগ দেওয়ার দাবি জানাই।

আমি মনে করি এবং বিশ্বাস করি, পরিবহণ শ্রমিকদের জীবনমান যদি আমরা উন্নত করতে পারি, তাহলে তাদের মধ্যে বিবেক কাজ করবে, বোধোদয় হবে। তাদের মাঝে যে বেপরোয়া মনোভাব রয়েছে তা আর থাকবে না। অথচ এই পরিবহণ শ্রমিকদের নিয়ে ভাববার যেন কেউ নেই। বরং তাদেরকে নেতৃত্বের ঢাল বানাতে ব্যস্ত অনেকে। গত ৫০ বছর ধরে পরিবহণ শ্রমিকরা একই অবস্থায় রয়েছেন। তাদের পেশাগত ও জীবনমানে কোনো উন্নতি নেই। তাদের জন্য কোনো হাসপাতাল তৈরি করা হয়নি। তাদের বাসস্থানের পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আমি মনে করি, এ দেশটি সবার জন্য। শুধু একটি শ্রেণি ভোগ করবে তা হতে পারে না। আমি আশা করি, আমাদের এই দাবির সঙ্গে সবাই একাত্মতা ঘোষণা করবেন। আমি সবাইকে বলব, যদি সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করেন, সত্যিকার অর্থে দেশকে ভালোবাসেন তাহলে সবাই দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন। আপনি কে তা প্রদর্শন করবেন না, আপনার কত টাকা বা ক্ষমতা তা সড়কে প্রদর্শন করবেন না। আমরা সবাই এই দেশের মানুষ। আমরা সবাই যেন দেশকে ভালোবাসি। দেশের আইন যেন মানি। সড়ক দুর্ঘটনারোধে যা করণীয় তা যেন সবাই মিলে করি।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়েছে, আরও ৫০ বছর পার করতে চাই না এভাবে। আমরা একটা সভ্য জাতি হিসাবে সম্মানিত হতে চাই বিশ্বের দরবারে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যেমন সম্মানিত হয়েছি, তেমনই আমরা সভ্য জাতি হিসাবে বিশ্ববাসীকে দেখাতে চাই, আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করেছি। আমরা নিয়ম মানতে শিখেছি। আমরা আইনকে শ্রদ্ধা করতে শিখেছি। আমরা দুর্নীতিমুক্ত একটি বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম হয়েছি। আসুন সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে শপথ করি; বিজয়ের এই মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত আমরা বৃথা যেতে দেব না। যে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত দিয়ে, মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে, তাদের যেন আমরা অশ্রদ্ধা না করি। তাদের যেন আমরা ভালোবাসতে পারি। এ ভালোবাসা তখনই সার্থক হবে, যখন আমরা তাদের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করতে পারব।

ইলিয়াস কাঞ্চন : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com