বেড়েছে সীমান্ত হত্যা
সীমান্ত এলাকায় হত্যাকাণ্ড কমিয়ে আনতে দুই বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশ ও ভারত সম্মত হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও ভারতের বিএসএফ সিদ্ধান্ত নেয় সীমান্তে ‘লিথ্যাল উইপন’ বা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হবে না। তবে হতাশার বিষয় হলো, সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরের বছর ২০১৯ সালেই এর আগের চার বছরের তুলনায় সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার সংখ্যা বেড়েছে। সরকারি হিসাবে এই সংখ্যা ৩৫ দাবি করা হয়েছে। তবে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, ২০১৯ সালে সীমান্তে বিএসএফের হাতে মোট ৪৩ জন মারা পড়েছেন। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল সরকারি হিসাবে ৩। বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) খোদ বিজিবি মহাপরিচালকও সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বেড়েছে বলে স্বীকার করেছেন।
২০১৮ সালের ২৩ থেকে ২৬ এপ্রিল ঢাকার পিলখানা সদর দফতরে বিজিবি ও বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ে তিন দিনব্যাপী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন শেষে বিজিবি মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম বলেন, ‘সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্রের (লিথ্যাল উইপন) ব্যবহার হবে না, আমরা উভয় দেশ আলোচনার মাধ্যমে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। এ কারণে সীমান্ত হত্যা অনেকাংশে কমে এসেছে। সীমান্তে কোনও প্রাণনাশ গ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণে বিএসএফ প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্র (নন-লিথ্যাল উইপন) ব্যবহার করছে।’
ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) মহাপরিচালক (ডিজি) কে কে শর্মাও একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। তিনি সে সময় বলেছিলেন, “সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে আমরা কাজ করছি। হত্যাকাণ্ড বন্ধে আমাদের রক্ষীরা ‘নন-লিথ্যাল উইপন’ ব্যবহার করছে। যদিও অপরাধীরা আমাদের ওপর আক্রমণ করছে, তবু আমরা ‘নন-লিথ্যাল উইপন’ ব্যবহার করছি। সীমান্তে মানবাধিকার লঙ্ঘন হোক, এটা আমরা চাই না।”
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএসএফের কথা ও কাজে কোনও মিল নেই। গত চার বছরের তুলনায় ২০১৯ সালে সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা বেড়েছে। সরকারি হিসেবে ২০১৮ সালে মাত্র তিন জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। যদিও বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা আরও বেশি। ২০১৭ সালে ১৭ জন ও ২০১৬ সালে ২৫ জন বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্তে বিএসএফের হাতে মারা পড়েন। ‘লিথ্যাল উইপন’ ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা সরকারি হিসাবেই বেড়েছে দশগুণের বেশি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, ২০১৯ সালে ভারতীয় সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকের ওপর নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা বেড়েছে। অন্যান্য বছরের মতো গত বছরেও আন্তর্জাতিক নীতিমালা ভঙ্গ করে বিএসএফ কর্তৃক সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর গুলিবর্ষণ, নির্যাতনসহ হতাহতের নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে। গেল বছর বিএসএফের গুলিতে ৩৭ জন ও শারীরিক নির্যাতনের কারণে ৬ জনসহ মোট ৪৩ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে এ ক্ষেত্রে মোট নিহতের সংখ্যা ছিল ১৪।
নিজেদের তথ্যানুসন্ধানের বরাত দিয়ে আসক আরও জানায়, ২০১৯ সালে ৪৩ জন নিহত হওয়া ছাড়াও ৩৯ জনের বেশি বাংলাদেশি নাগরিক বিএসএফের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ২০১৯ সালের ২৭ এপ্রিল নওগাঁ জেলার সীমান্তবর্তী রাঙামাটি এলাকায় আজিম উদ্দিন নামে এক যুবককে আটকের পর বিএসএফ তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। আজিম উদ্দিনের দুই হাতের ১০টি আঙুলের নখ তুলে ফেলাসহ সারা শরীরে রাইফেলের হাতল ও লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়। ওই দিনই বিএসএফের সঙ্গে পতাকা বৈঠকের মাধ্যম তাকে দেশে ফিরিয়ে আনে বিজিবি।
সীমান্তে প্রাণঘাতী ‘লিথ্যাল উইপন’ ব্যবহার নিষেধ থাকার পরও হত্যাকাণ্ড বাড়ছে কেন জানতে চাইলে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়ে বিএসএফ মহাপরিচালকের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আমাদের হিসাবে ৩৫ জন নিহত হয়েছেন। বিএসএফের হিসাবে সীমান্তে হত্যার সংখ্যা আরও কম। কিন্তু আমরা ওদের বলেছি, অনেকে আহত হয়ে বাংলাদেশে আসার পর হাসপাতালে মারা গেছে। সেই হিসাবটা আমাদের আছে, সেটা ধরলে ৩৫ জন মারা গেছেন। এ বিষয়ে আমরা আমাদের উদ্বেগের কথা তাদের জানিয়েছি। বিএসএফ মহাপরিচালক আমাকে আশ্বস্ত করেছেন, এ বিষয়ে আরও সতর্ক ও সজাগ থাকবেন, যাতে সীমান্তে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত হত্যাকাণ্ড এড়ানো যায়।’
উল্লেখ্য, গত ২৫-৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতের রাজধানী দিল্লিতে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ে সীমান্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বিজিবি প্রধানের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধি দল ও বিএসএফ মহাপরিচালক শ্রী ভিভেক জোহরীর নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের প্রতিনিধি দল সম্মেলনে অংশ নেন। সেখানে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে সীমান্ত হত্যা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। ‘যৌথ আলোচনার দলিল’ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে মহাপরিচালক পর্যায়ের ৪৯তম সীমান্ত সমন্বয় সম্মেলন শেষ হয়।