রাশিয়া ও চীন কেন ঘনিষ্ঠতা জোরদার করছে?

0

সম্প্রতি জাপানের সমুদ্রসীমার কাছেই যুদ্ধজাহাজ নিয়ে মহড়া করেছে চীন ও রাশিয়া। পাঠিয়েছে বোমাবাহী যুদ্ধবিমানও, যা জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা জোনের মধ্য দিয়ে একাধিকবার উড়ে গেছে। সিউল বাধ্য হয়েছে পাল্টা যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে শত্রুকে নিজেদের সীমার বাইরে পাঠিয়ে দিতে। পুরো বিষয়টি নিয়ে গত মঙ্গলবার গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন জাপানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী কিশি নবু। রাজধানী টোকিওতে সাংবাদিককের কাছে তিনি বলেন, জাপানকে ঘিরে নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।

জাপান যখন উদ্বেগ জানিয়ে যাচ্ছে তখন রাশিয়া ও চীনের কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় করতে ব্যস্ত। আকাশ ও সাগরে আরও মহড়া চালানোর মাধ্যমে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক ঝালিয়ে নিতে নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে দুই পক্ষের মধ্যে। রাশিয়ার পক্ষে এতে স্বাক্ষর করেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শইগু এবং চীনের পক্ষে স্বাক্ষর করেছেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়েই ফেংহে। চুক্তি অনুযায়ী এশিয়া-প্যাসেফিক এলাকার জাপান সাগর ও পূর্ব চীন সাগরে যৌথ মহড়া চালাবে রাশিয়া ও চীন।

সাম্প্রতিক সময়ে চীন ও রাশিয়ার মধ্যেকার সামরিক সহযোগিতার সম্পর্ক স্থিতিশীলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

গত আগস্ট মাসে চীনের নিংশিয়া এলাকায় বড় মাত্রার সামরিক মহড়া চালানো হয়। এতে প্রথমবারের মতো চীনের মাটিতে বিদেশি সেনা হিসাবে রাশিয়ার সেনাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। শুধু যৌথ মহড়াই নয়, সেখান থেকে যৌথ উদ্যোগে হেলিকপ্টার, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও চাঁদে গবেষণা স্টেশন তৈরির ঘোষণাও আসে। রাশিয়া বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র আইআইএসএস-এর গবেষক নিগেল গুড ড্যাভিস বলেন, ১৯৫০ এর দশকের পর এখনই রাশিয়া ও চীনের মধ্যে সবথেকে দারুণ সম্পর্ক বিরাজ করছে। হতে পারে দুই দেশ ইতিহাসের সবথেকে ঘনিষ্ঠ সময় পার করছে।

চীন ও রাশিয়ার সম্পর্ক বিভিন্ন সময়ে কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে গেছে। ১৯৬০ এর দশকে সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়েছিল। সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন পরমাণু যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। তবে গুড ড্যাভিসের ভাষ্য হচ্ছে, বর্তমানে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে যে সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে তা একেবারেই আলাদা। গত ১০ বছর ধরে একটানা দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক বেড়ে চলেছে। ২০১৪ সালে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা জারি হলে দ্রুততার সঙ্গে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায় দেশটি।

শুধু প্রতিরক্ষাই নয়, দুই দেশ কূটনীতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। ইরান, উত্তর কোরিয়া, সিরিয়া ও ভেনিজুয়েলা ইস্যুতে চীন ও রাশিয়ার অবস্থান একই। দুই দেশের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে রয়েছে দারুণ সম্পর্কও। ২০১৩ সালের পর থেকে দুজন ৩০ বারের বেশি দেখা করেছেন। পুতিনকে নিজের ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ বলে ডাকেন শি।

রাশিয়া হচ্ছে চীনের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী রাষ্ট্র। একইসঙ্গে জ্বালানি তেলের জন্যেও রাশিয়ার উপরে নির্ভর করে দেশটি। অপরদিকে চীন হচ্ছে রাশিয়ার প্রধান বাণিজ্য সহযোগী রাষ্ট্র। দেশটির শক্তি খাতেও ব্যাপক বিনিয়োগ রয়েছে রাশিয়ার। গুড ড্যাভিস মনে করেন, মূলত উদারপন্থী গণতান্ত্রিক আদর্শের বিরুদ্ধে আগ্রাসী অবস্থানই চীন ও রাশিয়াকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। দশকের পর দশক ধরে দুটি রাষ্ট্রই গণতন্ত্রবিরোধী শক্তির হাতে শাসিত হচ্ছে। নিজের দেশের মধ্যে পশ্চিমা উদারপন্থী আদর্শ বিস্তার ঠেকাতে একই অবস্থানে রয়েছে দেশ দুটি। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের প্রভাবকে খর্ব করতেও একই অবস্থানে দু’দেশ। ড্যাভিস এক কথায় জানালেন, মূলত গণতান্ত্রিক আদর্শের বিরোধিতাই চীন-রাশিয়া সম্পর্ক জোরদারের পেছনে কাজ করেছে।

এদিকে চীন ও রাশিয়ার মধ্যেকার এই ঘনিষ্ঠতা পশ্চিমা দেশগুলোর মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন গোয়েন্দারা বলছেন, চীন ও রাশিয়ার এই সুসম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সদস্যগুলোর জন্য ইতিহাসের সবথেকে বড় হুমকি। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের হুমকি মোকাবেলায় ১৯৪৯ সালে তৈরি করা হয়েছিল ন্যাটো। এখন জোটটি রাশিয়া ও চীন উভয় রাষ্ট্রকেই নিজেদের প্রধান শত্রু মনে করছে।

গত মাসে লন্ডনভিত্তিক ফাইনান্সিয়াল টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টল্টেনবার্গ বলেন, তিনি রাশিয়া ও চীনকে আর আলাদা হুমকি হিসাবে দেখেন না। দেশ দুটি ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। এখন তারা আমাদের জন্য একটা বড় হুমকি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাশিয়াকে বিশ্বের উপর প্রভাব বিস্তারে সাহায্য করছে। অপরদিকে চীনও এই সম্পর্কের কারণে রাশিয়ার উন্নত প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির অ্যাক্সেস পাচ্ছে। একইসঙ্গে তাদের অভিজ্ঞতার যে ঘাটতি রয়েছে তাও ভরিয়ে দিচ্ছে রাশিয়া। আবার পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় থাকায় রাশিয়ারও কিছু প্রযুক্তি সহায়তার প্রয়োজন সৃষ্টি হয়েছে। সেটি মিটাতে পারছে চীন।

দুই দেশের মধ্যে প্রায় ৪ হাজার ৩০০ কিলোমিটারের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। ১৯৬৯ সালে এই সীমান্ত সংঘর্ষে মেতেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন। কিন্তু এখন দুই দেশই বুঝতে পারছে, নিজেরা নিজেদের শত্রু হয়ে থাকাটা কত বড় ঝুঁকির।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com