দুই চীনের সংঘাত: যুদ্ধ আসন্ন?

0

বিশ্বে এখন দুটি চীন আছে—পিপলস রিপাবলিক অব চায়না (পিআরসি), যা চীন নামে পরিচিত। এই চীনের শাসনক্ষমতায় আছে কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না (সিপিসি)—প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। আর আছে রিপাবলিক অব চায়না (আরওসি), যা তাইওয়ান নামে পরিচিত। তাইওয়ানের শাসনক্ষমতায় আছে ডেমোক্র্যাটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি—প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন। দুই চীনকে বিভক্ত করেছে তাইওয়ান প্রণালি।

তাইওয়ানকে চীন নিজের অংশ দাবি করে। বেইজিংয়ের শাসন মেনে নেওয়ার জন্য বিপুল চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে তাইওয়ানের ওপর। এ মাসের শুরুর দিকে চীন বলেছে, দ্বীপটির আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতায় যারা সমর্থন দেবে, তাদেরকে অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হবে। আর তাইওয়ান নিজেকে স্বাধীন দেশ হিসেবে দেখে। তবে তাইওয়ানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল। দ্বীপটি চীন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় না। কারণ তাইওয়ানের দৃষ্টিকোণ থেকে তারাই চীন—অন্তত সাংবিধানিকভাবে।

যে কারণে দুই কোরিয়া আছে এবং দুই ভিয়েতনাম ছিল, ঠিক দুই চীন থাকার কারণও সেটাই—স্নায়ুযুদ্ধ ও এর আগে-পরের ইতিহাস। দুই দেশই নিজেকে চীন মনে করে। এবং দুই দেশের মধ্যে দা-কুমড়ায় সম্পর্ক। কমিউনিস্টশাসিত চীনের কাছে তাইওয়ান হলো তাদের দলছুট অংশ। এই দলত্যাগী অংশ চীনের ক্ষমতার জন্য হুমকি।

বেইজিং ইতিমধ্যে বলপূর্বক তাইওয়ান প্রণালির দুই পারকে পুনরায় এক করার জন্য কাজ করছে। কিন্তু তাইওয়ান বলেছে, তারা নিজের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে।

চীনও ‘এই দেশ দুই নীতি’ নামে একটি ফরমুলা বের করেছে। এ নীতির আওতায় চীনের পুনরেকত্রীকরণ মেনে নিলে তাইওয়ানকে যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে। তাইওয়ান এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে, তবে চীনে ভ্রমণ ও বিনিয়োগের নিয়মনীতি শিথিল করেছে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট পর্যায়ের বৈঠকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তাইওয়ানের ওপর তার দেশের দাবি একটি ‘অলঙ্ঘনীয় রেড লাইন’। ২০২১ সালের শুরুর দিকে চীন ও তাইওয়ানের খারাপ সম্পর্ক আরও খারাপের দিকে যায়। এ বছরের অক্টোবরে তাইওয়ানের আকাশসীমায় পরপর চার দিন সামরিক জেট পাঠিয়েছে চীন। খুব কম দেশই তাইওয়ানকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি হয়ে গেছে চীনের বিরুদ্ধে শ্রেষ্ঠত্বের যুদ্ধের ছায়া ময়দান।

দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাইওয়ানের কাছে ফের পুরো দমে অস্ত্র বিক্রি শুরু করেছেন। এছাড়াও বাইডেন প্রশাসন স্বাধীনতা রক্ষায় দ্বীপটিকে সাহায্য করার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছে। বাইডেন এ বছরের অক্টোবরে বলেছেন, তাইওয়ানের ওপর চীন হামলা চালালে ওয়াশিংটন নাক গলাবে।

প্রণালির দুই পারের গল্প

চীনের মূল ভূখণ্ডের সিংহভাগ মানুষই তাইওয়ানকে চীনের অংশ মনে করে। একই ভাষা ও  সংস্কৃতির তাইওয়ানিজদের তারা চীনা হিসেবেই বিবেচনা করে। তবে চীনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাইওয়ানের কোনো মাথাব্যথা নেই। তাইওয়ানের অধিকাংশ মানুষ নিজেদের তাইওয়ানিজই মনে করে। আর তাদের দৈনন্দিন জীবনের ওপর অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাব খুব সামান্যই।

চীন-তাইওয়ানের রেষারেষির মূল প্রোথিত ১৯ শতকের শেষ দিকের ইতিহাসে—যখন চীনকে শাসন করত কিন রাজবংশ। তাইওয়ানের ইতিহাস বেশ প্রাচীন ও জটিল। এই জটিল ইতিহাসের আড়ালে লুকিয়ে আছে তাইওয়ানের আজকের অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণ।

একটি সাম্রাজ্যের মৃত্যু ও প্রজাতন্ত্রের জন্ম

১৮৯৪ সালে কিন সাম্রাজ্য ও জাপানি সাম্রাজ্যের মধ্যে শুরু হয় প্রথম চীন-জাপান যুদ্ধ। ওই যুদ্ধ হয়েছিল মূলত তাইওয়ান ও কোরিয়ায়। সে সময় কোরিয়া শাসন করত কিনদের অধীন জোসিয়ন রাজবংশ। প্রথম চীন-জাপান যুদ্ধে জাপান জয়ী হয়। ১৮৯৫ সালে তাইওয়ান দ্বীপ দখল করে নেয় জাপান। এ যুদ্ধে ৫০০ বছরের প্রাচীন জোসিয়ন রাজবংশেরও পতন হয় এবং চীনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে কোরিয়া। জাপান ১৯১০ সালে কোরীয় উপদ্বীপ দখল করে নেয়।

১৯১২ সালে চীনের রাজতন্ত্রের পতন হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম চীনা প্রজাতন্ত্র, রিপাবলিক অভ চায়না। নানজিংয়ে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট করা হয় সান ইয়াৎ-সেনকে। কিন্তু তৎকালীন চীনের বৃহত্তম সেনাদল বেইয়াং সেনাবাহিনীর সেনাপতি হওয়ার সুবাদে ততক্ষণে বেইজিংয়ের ক্ষমতা দখল করে ফেলেন ইউয়ান শিকাই। সংঘাত এড়ানোর জন্য উয়ানকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিতে রাজি হন সান।

ইউয়ান শিকাই ক্ষমতার অপব্যবহার করলে সেই সুযোগ নিয়ে তার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেন সান। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়, সান পালিয়ে যান জাপানে। ১৯১৫ ইউয়ান চাইনিজ ন্যাশনালিস্ট পার্টি ভেঙে গিয়ে নিজেকে চীনের নতুন সম্রাট ঘোষণা দেন। এর এক বছর পর মারা যান তিনি। এরপরই চীনে শুরু হয় ওয়ারলর্ডদের যুগ। দেশটি অনেকগুলো ছোট ছোট অঞ্চলে ভাগ হয়ে যায়।

১৯১৭ সালে নির্বাসন থেকে ফিরে এসে প্রজাতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন সান ইয়াৎ-সেন। কুমিনতাং নামে নিজের জাতীয়তাবাদী দল পুনরুজ্জীবিত করেন। চীনের দক্ষিণ অংশে কুমিনতাং সরকার গঠিত হয়, আর উত্তরাঞ্চলে ছিল ওয়ারলর্ড ও বেইয়াং সেনার দাপট।

বামপন্থি ও ডানপন্থিদের রেষারেষি

সান ইয়াৎ-সেন পুরো দেশকে এক সরকারের অধীনে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ওয়ারলর্ডদের বিরুদ্ধে জেতার মতো সামরিক শক্তি তার ছিল না। পশ্চিমা বিশ্বও তাকে সাহায্য করতে অস্বীকার করে। এরপর তিনি সাহায্য পান সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে। দুই বছরব্যাপী সামরিক অভিযান শেষে ওয়ারলর্ডদের জমানার অবসান হয়।

কিন্তু এ অভিযান শেষ হওয়ার আগেই, ১৯২৫ সালে সান ইয়াৎ-সেনের মৃত্যুর পর, জাতীয়তাবাদী ও কমিউনিস্টদের মধ্যে ফাটল ধরতে শুরু করে। কুমিনতাং দল দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাই—ডানপন্থি ও বামপন্থি। বামপন্থি অংশটি তাদের রাজধানী উহানে সরিয়ে নেয়। চিয়াং কাই-শেকের নেতৃত্বাধীন ডানপন্থি অংশটি রাজধানী হিসেবে বেছে নেয় নানজিংকে।

জাতীয়তাবাদীরা কমিউনিস্টদের সরিয়ে দিতে থাকে। ১৯২৭ সালের এপ্রিলে জাতীয়তাবাদী বাহিনী কয়েক হাজার কমিউনিস্টকে হত্যা করে। কুমিনতাংয়ের বামপন্থি অংসটিও কমিউনিস্টদের হত্যা করতে আরম্ভ করে। শেষ পর্যন্ত দলটি ভেঙে যায়। চীনের সরকার হিসেবে টিকে যায় প্রথম দলটি।

বিশ্বযুদ্ধের মধ্যেই যুদ্ধ

চীনের গৃহযুদ্ধ শুরু হয় ১৯২৭ সালের আগস্টে, নানচাং বিদ্রোহ ও কমিউনিস্ট পার্টির সেনাবাহিনী রেড আর্মির প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এর চার বছর পর গৃহযুদ্ধ চলমান অবস্থায়ই চীনে আক্রমণ করে জাপান।

কমিউনিস্টদের হত্যার কারণে চীন সরকারের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের মৈত্রী শেষ হয়ে যায়। চীনের পূর্বাঞ্চলে হামলা চালিয়ে জাপানি বাহিনী মাঞ্চুরিয়া ও আশপাশের অন্যান্য দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নেয়। দখলকৃত অঞ্চলে জাপান নিজেদের পুতুল সরকার বসায়। তবে ১৯৩৭ সালের আগ পর্যন্ত দুই দেশের সংঘর্ষ কখনও চরম আকার ধারণ করেনি।

জাতীয়তাবাদীরা অনেকবার চিয়াং কাই-শেককে কমিউনিস্টদের সঙ্গে সমঝোতায় এসে জাপানের বিরুদ্ধে একত্রে লড়ার আহ্বান জানায়। কিন্তু চিয়াং তাতে রাজি হননি। তবে ১৯৩৬ সালে নিজ দলেরই সেনাপতির হাতে তিনি অপহৃত হন। তার চাপাচাপিতে কমিউনিস্টদের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে রাজি হন চিয়াং।

চীনের রাজধানী নানজিংয়ে ঢুকে হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিক ও সৈন্যকে হত্যার পর শুরু হয় দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধ। ১৯৪১ সালে জাপান সহসা পার্ল হারবারে হামলা করে। এর জেরে যুক্তরাষ্ট্রও যুদ্ধে যোগ দেয়, দুটি পারমাণবিক বোমা ফেলে জাপানে। ১৯৪৫ সালে আত্মসমর্পণ করে জাপান সাম্রাজ্য।

আত্মসমর্পণ চুক্তির একটি অংশে অন্তর্ভুক্ত ছিল যে, যুদ্ধের মাধ্যমে জাপান যেসব অঞ্চল দখল করেছে, সেগুলোকে সার্বভৌমত্ব দিতে হবে। চুক্তিতে কোরিয়া ও তাইওয়ানের দখলকৃত অঞ্চলের কথাও উল্লেখ ছিল।

চীনা গৃহযুদ্ধ

জাপানের সঙ্গে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ফের ১৯৪৬ সালে চীনে গৃহযুদ্ধ বেধে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্টদের সহায়তা দেয়, আমেরিকা মদদ দেয় জাতীয়তাবাদীদের। তখন সবে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়েছে। কমিউনিস্টরা জাতীয়তাবাদীদের কোণঠাসা করতে করতে আরও দক্ষিণে পাঠিয়ে দেয়। ১৯৪৯ সালে কুমিনতাং সরকার পিছু হটতে হটতে তাইওয়ান দ্বীপে আশ্রয় নেয়।

এর ফলে চীনা গৃহযুদ্ধ কার্যত শেষ হয়, তবে দুই পক্ষের মধ্যে কখনও কোনো শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। ওই বছরই পিপলস রিপাবলিক অভ চায়নার দখল নেয় কমিউনিস্ট পার্টি অভ চায়না। অন্যদিকে রিপাবলিক অভ চায়নার শাসক কুমিনতাং সরকার তাইওয়ানে নির্বাসনে চলে যায়। এ সরকারের পেছনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি ছিল।

তাইওয়ান প্রণালি নিয়ে তাইওয়ানের নিকটবর্তী কিনমেন দ্বীপে দুই পক্ষের যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে কমিউনিস্টরা দ্বীপটির দখল নিতে পারেনি।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিবর্তন

এর পরের দুই দশকে আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত পিপলস রিপাবলিক অভ চায়নার দিকে ঘুরে যেতে শুরু করে। ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে পিআরসিকে চীনের বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র এ সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ভেটো দেয়, তবে আরওসির সঙ্গে ১৯৭৯ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে।

১৯৭৯ সালে ‘দ্য থ্রি লিঙ্কস’ নামক প্রস্তাবের মাধ্যমে আরওসির সঙ্গে যোগাযোগ উন্মুক্ত করার চেষ্টা করে পিআরসি। আরওসি এ প্রস্তাবে সাফ না করে দেয়। বলে দেয়, কোনো যোগাযোগ, সমঝোতা বা দরকষাকষি হবে না।

১৯৮৬ সালে আরওসির রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চায়না এয়ারলাইন্সের একটি কার্গো বিমান অপহরণ করে পিআরসিতে পালালে আরওসি ও পিআরসি যোগাযোগ স্থাপনে বাধ্য হয়।

১৯৯২ সালে দুই সরকার এক চীন নীতিতে সমঝোতা আনে। এ নীতি অনুসারে, একটি চীন থাকবে এবং তাইওয়ান হবে চীনের অংশ। তবে তাইওয়ান প্রণালির দুপাশে পক্ষই নিজেকে বৈধ চীন সরকার মনে করত। তবে দুই পক্ষই একমত হয় যে, চীনের মিলনই চূড়ান্ত লক্ষ্য।

১৯৯০-এর দশকের আগে কুমিনতাং সরকারশাসিত তাইওয়ান ছিল একদলীয় রাষ্ট্র। চীনও তা-ই। কিন্তু ২০০০ সালে তাইওয়ানের ক্ষমতায় আসে ডেমোক্র্যাটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি (ডিপিপি)। এই মুহূর্তে তারাই সেখানকার সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। ডিপিপি ‘এক চীন নীতি’তে বিশ্বাসী নয়। ১৯৯২ সালের সমঝোতাও তারা মানে না। সমর্থন করে না দুই চীনের মিলনেও। ডিপিপি তাইওয়ানিজ পরিচয়ের কট্টর সমর্থক। দলটির বিশ্বাস, তাইওয়ান ইতিমধ্যেই স্বাধীন দেশ।

তাইওয়ান জাতিসংঘের সদস্য নয়। খুব কম দেশই তাদের স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে অনেক দেশেরই তাইওয়ানের রাজধানীতে তাইপেতে অনানুষ্ঠানিক দূতাবাস রয়েছে। তাইওয়ানের নিজস্ব সরকার, সেনাবাহিনী, পাসপোর্ট আছে। ফুটবল বিশ্বকাপ ও অলিম্পিক গেমসের মতো আন্তর্জাতিক স্পোর্টস টুর্নামেন্টগুলোতেও অংশ নেয় তাইওয়ান, তবে সেটি করে ‘চাইনিজ তাইপে’ নামে।

ব্যবসা এবং ব্যবসাই আসল

ইতিহাস ছাড়াও বিনিয়োগ, ব্যবসা ও প্রযুক্তি দুই দেশকে এক সুতোয় গেঁথে রেখেছে। দুই দেশই ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে ডব্লিউটিও-তে ঢুকেছে।

তাইওয়ানিজ কোম্পানিগুলো চীনে প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এছাড়াও প্রায় দশ লাখ তাইওয়ানিজ চীনে থাকে, সেখানে তাইওয়ানিজ কারখানা চালায়। তাইওয়ানের প্রযুক্তি ও চীনের নিম্ন শ্রমখরচের পরস্পরের পরিপূরক। ফক্সকন টেকনোলজির মতো উৎপাদকরা অ্যাপল ও অন্যান্য বৈদ্যুতিক কোম্পানিকে পণ্য সরবরাহের জন্য চীনের মূল ভূখণ্ডে লাখ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। হুয়াওয়ে, শাওমির মতো চীনা টেলিকম সরবরাহকারীদের চিপ সরবরাহ করে তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর (টিএসএম)। হাইটেক শিল্পে চীনের অগ্রগতি অনেকাংশেই তাইওয়ানের কাছ থেকে পাওয়া সেমিকন্ডাক্টর ও অন্যান্য যন্ত্রাংশের ওপর নির্ভরশীল।

তাইওয়ানের অর্থনীতি এখন চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে, এ নিয়ে কিছু তাইওয়ানিজ এখন চিন্তিত। ২০১৪ সালে দুই দেশের মধ্যে একটি মুক্তবাণিজ্য চুক্তির প্রস্তাব উঠলে তার বিরুদ্ধে ভোট দেয় তাইওয়ানিজ ভোটাররা। ‘সানফ্লাওয়ার আন্দোলনের’ জেরে এর দু-বছর পর তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সাই ইং-ওয়েন। দুই চীনের পুনরেকত্রীকরণের সব আশায় তিনি পানি ঢেলে দিয়েছেন। সাই এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিনিয়োগে মনোযোগী হয়ে উঠেছেন।

গত বছর চীনের সঙ্গে রেকর্ড বাণিজ্য হয় তাইওয়ানের। তাইওয়ানের মোট দেশজ উৎপাদনের ১৫ শতাংশে অবদান রাখে চীনে রপ্তানি। এর বদৌলতে হাতে এক নতুন অর্থনৈতিক অস্ত্র পেয়ে গেছে চীন।

চীন ও তাইওয়ানের মধ্যকার অর্থনৈতিক সম্পর্কের কারণে দুই দেশের মধ্যে সামরিক যুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা কম। বেইজিং সম্ভবত তাইওয়ানকে অর্থনৈতিক চাপে রাখবে। হংকংকে যেভাবে বশ করেছে, তা-ই প্রমাণ করে দিয়েছে সামরিক শক্তি প্রয়োগ না করেই ছোট দ্বীপ শক্তির ওপর আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম চীন।

দুই চীনের রেষারেষি: যুদ্ধ হবে কি?

চীন হুমকি দিয়েছে, তাইওয়ান যদি স্বাধীনতালাভের চেষ্টা করে, তবে জোর খাটিয়ে হলেও দুই চীনকে এক করবে।

জাতিসংঘে পিআরসির রাষ্ট্রদূত ওয়াং ইংফ্যান বলেছেন, ‘তাইওয়ান প্রাচীনকাল থেকেই চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।’ তাইওয়ানিজ প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন বলেছেন, চীন আক্রমণ করলে নিজেকে রক্ষার জন্য তাইওয়ান ‘শেষ দিন পর্যন্ত লড়াই করবে’।

তাইওয়ান সতর্ক করে দিয়েছে, চীন যদি তাদের আকাশসীমায় বিমান পাঠায়, তাহলে তাইওয়ান গুলি চালাতে পারে। তাইওয়ানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী চিউ কু-চেং বলেছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে তাইওয়ানে হামলা চালাতে পারে চীন।

চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তাইওয়ানকে পিপলস রিপাবলিক অভ চায়নার সঙ্গে যুক্ত করাকে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।

মার্কিন কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার বলেছেন, তাইওয়ান দখলের ইচ্ছা থাকলেও চীন অন্তত বছর দশেকের মধ্যে দ্বীপটির ওপর হামলা চালাবে না বলে আশা করেন তিনি।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মন্তব্য উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে তাইওয়ানের সামরিক বাহিনীর প্রস্তুতি দুর্বল। এছাড়াও তাইওয়ানিজ সেনাবাহিনীর নৈতিক জোরও কম। তাছাড়া ‘তাইওয়ানের প্রাপ্তবয়স্ক লোকেরা বস্তুত লড়াই করতে চায় না’। আর চীনের সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো শক্তি তাইওয়ানের নেই বলেই অনুমান করা হয় ওই প্রতিবেদনে।

চীনের কমিউনিস্ট নেতারা আসলেই তাইওয়ানে আক্রমণ চালাতে চান কি না, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে জোর বিতর্ক উঠেছে। আর চীনা নেতারা চাইলেও দেশটির সামরিক বাহিনী এই মুহূর্তে কিংবা নিকট-ভবিষ্যতে এমন হামলা চালানোর মতো শক্তিশালী কি না, তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।

পেন্টাগনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরাসরি বড় আকারের হামলা চালানোর জন্য চীন তার সামরিক বাহিনীর আকার বাড়াচ্ছে, এমন কোনো ‘লক্ষণ নেই’।

চীনের সামরিক কৌশল হলো বিদেশি সামরিক বাহিনী, বিশেষ করে মার্কিন বাহিনীকে চীনা অঞ্চল থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখা। চীন এই কাজ করেছে খানিকটা দক্ষিণ চীন সাগরে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি এবং ওইসব দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি তৈরির মাধ্যমে।

গেল কয়েক বছরে কৌশলের অংশ হিসেবে ওয়ারশিপ, অ্যান্টি-শিপ মিসাইলের সংখ্যা বাড়িয়েছে চীন। একে সম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা কৌশল—কিংবা উপসাগর থেকে মার্কিন বাহিনীকে দূরে রাখার উপায়—হিসেবে দেখা যায়। এর ফলে দক্ষিণ চীন সাগরের গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথগুলোতে চীনের সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেইসঙ্গে তাইওয়ানকে বশে রাখার আকাঙ্ক্ষাও চরিতার্থ করেছে।

সমর কৌশলবিদ সান জু ‘দি আর্ট অভ ওয়ার’-এ লিখেছেন: ‘যে জানে কখন যুদ্ধ করতে হবে আর কখন চুপ থাকতে হবে, সে-ই জিতবে।’ কে জানে, চীন ও তাইওয়ান দুই পক্ষই হয়তো এই শিক্ষা মাথায় রেখেছে!

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com