দেশে কোনো এক ‘রহস্যজনক’ কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একনাগাড়ে বন্ধ, মন্তব্য রুমিন ফারহানা’র

0

দেশে কোনো এক ‘রহস্যজনক’ কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একনাগাড়ে বন্ধ দেড় বছরের বেশি। এই সময়ের মধ্যে দীর্ঘকাল সংক্রমণের হার বেশ নিচুতে ছিল। কয়েক মাস তো এটা ছিল ৫ শতাংশেরও নিচে। সবকিছু একেবারে স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। পুরোদমে চলছে ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন সবকিছু। কিন্তু কপাল খোলেনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের; সেগুলো বন্ধ থেকেছে সবসময়।

যখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কথা সামনে এসেছে, তখনই সরকার বলেছে, শিক্ষার্থীদের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে না। এই ঝুঁকি এড়ানোর জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের টিকা দিয়ে তবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। যদিও বর্তমানে বন্ধ থাকলেও কওমি মাদ্রাসাগুলো খোলা ছিল প্রায় পুরোটা সময়। এর ব্যাখ্যা সরকারের পক্ষ থেকে আসেনি।
এখন পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে ১৮-ঊর্ধ্ব মানুষদের টিকা দেওয়া হচ্ছে। ধাপে ধাপে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে- এর কম বয়সী মানুষদের টিকা দেওয়া হবে কিনা। ব্রিটেনে ১৭ বছরের বয়সীদের টিকার আওতায় আনা হচ্ছে। আমেরিকায় ১২ বছর পর্যন্ত টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারও টিকা দেওয়ার বয়স দ্রুতই ১৮তে নামিয়ে আনার কথা বলছে।
খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, এর নিচে তো আমাদের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা আছে। তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কোনো পরিকল্পনা কি নেই? ধরে নেওয়া গেল, বাংলাদেশের হাতে এখন অসংখ্য টিকা আছে। বাংলাদেশ চাইলেই এখন যে কাউকে টিকা দিতে পারে। সেই ক্ষেত্রেও তো ১২ বছরের নিচের কাউকে টিকা দেওয়া সম্ভব নয়। এর নিচের বয়সের মানুষকে টিকা দেওয়ার কোনো আলোচনাই পৃথিবীতে নেই। কিন্তু এই বয়সের নিচে এ দেশের অসংখ্য শিক্ষার্থী আছে, যারা কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ছে। তাহলে এদের টিকা না দিয়ে কি স্কুলে যেতে দেওয়া হবে? আমরা তো এখন জানি, শুরুতে শিশুরা করোনায় আক্রান্ত না হলেও পরবর্তী সব ভ্যারিয়েন্টে শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে।
বিশ্বের প্রায় সব দেশে করোনার সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সুবিধামতো খোলা রাখা হয়েছে; আবার এর প্রকোপ খুব বেশি হয়ে গেলে বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু কোথাও টিকা দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে হবে- এমন শর্ত ছিল না। অসংখ্য টিকা হাতে থাকার পরও উন্নত বিশ্বের দেশগুলো এ শর্ত আরোপ করেনি।
বাংলাদেশি টিকার রেজিস্ট্রেশনের বয়স ক্রমাগত নামানো হচ্ছে। যে মুহূর্তে এই লেখা লিখছি, তখন এই বয়স ২৫। সরকারের বক্তব্য অনুযায়ী, অচিরেই এটা ১৮তে নামিয়ে আনা হবে। এমন এক সময়ে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যখন সরকারের হাতে আমাদের চাহিদার তুলনায় খুব কমসংখ্যক টিকা আছে।
আগামী বছরের শুরুর মধ্যেই বাংলাদেশ ২১ কোটি টিকা হাতে পাবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে। টিকাপ্রাপ্তি নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, এই আশ্বাসগুলো খুব বেশি বিশ্বাস করা ভুল হবে। কারণ টিকা নিয়ে বৈশ্বিক পরিস্থিতিই ভীষণ রকম অনিশ্চয়তায় ভরা। আছে টিকা নিয়ে চরম ‘ভূ-রাজনৈতিক খেলা’। ফলে টিকা কেনার মতো পর্যাপ্ত টাকা হাতে থাকার পরও বাংলাদেশ সময়মতো চাহিদামাফিক টিকা পাবে- এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং বাংলাদেশ যতটুকু টিকা হাতে পাবে, তার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করা উচিত।
একটি টিকারও যেন অপচয় না হয়। ‘অপচয়’ বলতে আমি এখানে নিশ্চিতভাবেই টিকা ফেলে দেওয়াকে বোঝাইনি। বাংলাদেশে এখন যত করোনা রোগী আছেন, তার প্রায় সবাই (৯৮ শতাংশ) ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। আমরা জানি, এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো জটিলতা এবং মৃত্যুহার অনেক বেশি। মৃত্যুর ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের পরিসংখ্যান থেকে আমরা জানি, ৮০ শতাংশের বেশি হচ্ছে ৫৫-ঊর্ধ্ব মানুষ। আমরা এটাও জানি, আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তরুণরা এগিয়ে থাকলেও তাদের ক্ষেত্রে মৃত্যুহার খুবই কম। এ বিবেচনায় আমাদের হাতে যে পরিমাণ টিকা এসে পৌঁছায়, সেই টিকা দেওয়ার জন্য আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার থাকা উচিত ৫৫-ঊর্ধ্ব মানুষ। এই মানুষদের গণহারে টিকা দিয়ে দিলে করোনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কো-মর্বিডিটিসহ মানুষদের টিকা হয়ে যাবে। এটা করে করোনার মৃত্যুহার অনেক কমিয়ে ফেলা সম্ভব। করোনায় তরুণরা যথেষ্ট পরিমাণে আক্রান্ত হচ্ছে, এটা সত্য। ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু-কিশোররাও। কিন্তু আমরা এখন নিশ্চিতভাবেই জানি, এই বয়স-শ্রেণিটি করোনা-জটিলতায় ভোগার ক্ষেত্রে খুব কম ঝুঁকিপূর্ণ।
উন্নত দেশগুলো যখন প্রচুর পরিমাণে টিকা নিয়ে তাদের টিকাদান কর্মসূচি শুরু করেছে, তখনও তারা একটা ‘প্রায়োরিটি লিস্ট’ করেছে। হাসপাতালে কাজ করা চিকিৎসক-নার্স-টেকনোলজিস্ট এবং অন্য কর্মীরা সবাই প্রথমে টিকা নিয়েছেন। এর পর ধাপে ধাপে সর্বোচ্চ বয়স থেকে শুরু করে নিচের দিকে টিকা দেওয়া হয়েছে। শুরুর দিকে কম বয়সীদের টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে গণহারে টিকা দেওয়া হয়নি। শুধু অতি জটিল রোগে (যেমন ক্যান্সার, যক্ষ্ণা, ক্রনিক অ্যাজমা ইত্যাদি) ভোগা তরুণদের দেওয়া হয়েছে। এটাই ন্যায্যতা।
গত বছর টিকা কর্মসূচি শুরুর দিকে মানুষের আগ্রহের ঘাটতি ছিল। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অনেক বয়স্ক মানুষ টিকা নিতে চাননি। কিন্তু এ বছর বিশেষ করে গত মার্চের দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর থেকে মানুষের মধ্যে করোনা নিয়ে সচেতনতা এবং ভীতি দুটোই বেড়েছে। ফলে শহরাঞ্চলে তো বটেই, গ্রামাঞ্চলের বয়স্ক মানুষও টিকা নেওয়ার জন্য উদগ্রীব। এই সময় বয়সকে ভিত্তি ধরে প্রতিটি বয়স-শ্রেণিকে টিকা দেওয়া শেষ করে ধাপে ধাপে এই বয়স কমানো উচিত। এভাবে একটা পর্যায়ে শিক্ষার্থী ও তরুণরা টিকার আওতায় আসবেই। সরকার এই পথে না গিয়ে ২৫ বছর পর্যন্ত মানুষদের টিকা দিচ্ছে। একই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার নামে ১৮-ঊর্ধ্বদেরও টিকার আওতায় আনতে যাচ্ছে। এটা অন্যায্য এবং নিশ্চিতভাবেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে জটিলতায় ভোগা এবং মৃত্যুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের প্রতি অবিচার। এ পদক্ষেপ নিশ্চয় করোনায় মৃত্যু বাড়াবে।

লেখকঃ রুমিন ফারহানা
সংসদ সদস্য; আইনজীবী ও কলাম লেখক

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com