সরকারের মন্ত্রীরা টাকা পাচারের খবর জানেনা, নতুন দরিদ্র মানেনা: রুমিন ফারহানা

0

গতবারের মতো এবারও সংসদে বাজেট দেওয়া হলো করোনার মধ্যেই। অতি সতর্কতা মেনে ডাকা হলো অধিবেশন। এক মাসধরে চলা অধিবেশনে সংসদ চললো মূলত ১১ দিন। মাঝখানে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে কয়েক দফায় সর্বোচ্চ তিন/চার দিনের জন্য বসলো সংসদ। প্রতিবার বসার আগে আগে সবার করোনা টেস্ট ছিল  বাধ্যতামূলক। এত সাবধানতার সঙ্গে চললো যে সংসদ সেটিও দৈনিক দুই/আড়াই ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হলো না। অথচ দফায় দফায় পরীক্ষা করে সকল প্রকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অধিবেশনের পুরোটাই চাইলে কাজে লাগানো যেত। কে জানে সরকার হয়তো এতেই স্বস্তিবোধ করে। কথা যত কম, ঝামেলা ততকম।

এই সংসদকে কেউ বলছেনহ্যাঁ/নাবলার সংসদ, কারও মতে এটি একটিস্টেজযেখানে গিয়ে আমরা হাজির হই, আবার কেউবা বলছেন বাজেট আলোচনা এক ধরনেরনাটক তা সে যাই হোক নিস্তরঙ্গ রাজনীতির অঙ্গনে সংসদ অধিবেশন কিছুটা হলেও যে ঢেউ তোলে তা স্বীকার করতেই হবে। না হলে মাত্র দিনেই বিরোধী দলের ক্ষীন কণ্ঠের বাজেট সমালোচনার সাথেসাথে পরীমণি, বোটক্লাব, মদের আসর, টাকার উৎস থেকে শুরু করে আবু ত্বহার নিখোঁজ, মন্দ ঋণ, টাকা পাচার, শেয়ার কেলেঙ্কারি সব নিয়েই তো ঝড় উঠলো সংসদে। গণমাধ্যমের শিরোনাম হলো প্রতিদিনই।

পরীমণি প্রাথমিক বিচার পেলো। অভিযুক্তের নামে মামলা, এমনকি গ্রেফতারও হলেন তিনি। সাংসদরা প্রশ্ন তুললেন ১৫ থেকে২০ লাখ টাকা দিয়ে ক্লাবের মেম্বারশিপ কারা নেয়? টাকার উৎসটাই বা কী? ন্যায্য প্রশ্ন, সন্দেহ নেই। তবে ক্লাব মেম্বারশিপে রাজনীতিবিদরা খুব পিছিয়ে আছেন তেমনটা মনে হয় না। সংসদে হাঁকডাকের দুই দিনের মাথায় ত্বহাকেও পাওয়া গেলো।অতীতের আর সব হারিয়ে গিয়ে ফিরে আসাদের মতো চুপ থাকলেন তিনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বললো, ‘ব্যক্তিগতকারণেঅজ্ঞাতবাসে ছিলেন দিন। যা বলে তাই সই, ফিরে তো এলো। কিছু না পাওয়ার কালে এটুকুই বা কম কি?

তবে হ্যাঁ, মন্দ ঋণ, কালো টাকা, বিদেশে পাচার সব নিয়ে শোরগোল বাধলেও দিনের শেষে নিস্তরঙ্গ দীঘি।       

লক্ষী নাকি চঞ্চলা; তাই তাকে আঁচলে বেঁধে ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ। বুদ্ধিমান মানুষ তাই জমি কেনে, বাড়ি বানায়, ব্যাংকে রাখে, শেয়ার বাজারে খাটায়। অর্থাৎ যত কায়দায় সম্ভব লক্ষীকে বাঁধার চেষ্টা। তবে যাই করুক না কেন মানুষের প্রথম চিন্তাইথাকে লক্ষীকে নিরাপদ রাখা। দেশে নিরাপদ, লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখতে পারলে তো ভালোই, না হলে বিদেশই সই। উন্নয়নের মহাসড়কে যাত্রা করা দেশটিতে কয়েক কোটি টাকা হয়তো বা রেখে দেওয়া যায় কিন্তু বাকিটা? গত এক যুগে কিছু মানুষের হাতেটাকা তো আর কম জমেনি!    

প্রতি বছর বাজেট আসলেই তাই উত্তপ্ত হয় সংসদ। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। এক পর্যায়ে অর্থমন্ত্রীতো বলেই ফেললেন টাকা পাচারকারীদের তালিকা তার কাছে নেই। বিরোধী দলের যে গুটিকয়দুষ্ট সাংসদটাকা পাচার নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাদের কাছে তালিকা থাকলে সেটিও দিতে বললেন তিনি। সংসদে ছাটাই প্রস্তাবে আর্থিক খাত নিয়ে কথা বলতে গিয়ে টাকা পাচার, মন্দ ঋণআর শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির প্রসঙ্গ তুলেছিলাম আমি। দেশে বর্তমানে মন্দ ঋণের পরিমাণ কত আর গত এক যুগে কত টাকাপাচার হয়েছে সংক্রান্ত আমার সরাসরি প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী যখন কারা অর্থপাচার করছে তাদের তথ্য সরকারের কাছে নেইজানিয়ে সে সংক্রান্ত তথ্য থাকলে তা সরকারকে দিতে অনুরোধ জানালেন তখন খানিকটাবেকুববনে গেলাম আমি। তারবলার পর বিষয়ে দ্বিতীয় দফা বলার আর সুযোগ পাইনি। না হলে বলতাম মাননীয় মন্ত্রী আপনি ইস্তফা দিন, যোগ্য কেউআসুক যার কাছে অন্তত পাচারের তথ্যটুকু থাকবে।

টাকা পাচারের আলোচনা যখন তুঙ্গে তখন মূলধারার গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খোদ দুই সাংসদ নিয়েব্যাপক আলোচনা হয়। একজন লক্ষীপুর আসনের সদ্য সাবেক সাংসদ শহিদুল ইসলাম পাপুল যিনি সাংসদ থাকা অবস্থায়মানব পাচার, ভিসা জালিয়াতি অর্থ পাচারের অভিযোগে কুয়েত পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। কুয়েতের অপরাধ তদন্ত সংস্থামানব পাচার এবং ১৪০০ কোটি টাকা পাচারের দায়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে। আর গত ২৯ মে অনুসন্ধানী এক প্রতিবেদনে নাটোরের সাংসদ শফিকুল ইসলাম শিমুলের স্ত্রীর কানাডার স্কারবোরো শহরে ১২ কোটি টাকা (১৪ লাখ ৫৬ হাজার কানাডীয়ডলার) দামের প্রাসাদ তুল্য বাড়ির খবর আসে। শিমুলের স্ত্রী গৃহবধূ যার নিজস্ব কোনও আয়ের উৎস নেই। এই বিষয়ে গণমাধ্যমে কথা বলাতে শিমুল বেশ নাখোষ হন আমার ওপর যা তিনি গোপনও করেননি। সংসদ মুলতুবি হলে তিনি আমারদিকে এগিয়ে এসে বেশ উত্তেজিত ভাবেই প্রশ্ন করেন আমি তার পিতা শ্বশুর সম্পর্কে জানি কিনা। আমি তাকে চেহারায় চিনতামনা; তিনিও নিজের পরিচয় দেওয়ার দরকার মনে করেন নাই। তাই বেশ কিছুক্ষণ আমি বুঝিনি তিনি উত্তেজিত হয়ে কী বলছেন।তাদের যে পরিচয় তিনি উত্তেজিত হয়ে দিতে থাকেন তাতেও ১২ কোটি টাকার প্রাসাদ কানাডায় কেনা সম্ভব কিনা সে প্রশ্ন থেকেইযায়। তার চেয়ে বড়  বিষয় হলো বৈধ উপায়ে অর্জিত টাকাও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া দেশের বাইরে নেওয়া যায় না।অথচ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে বৈধভাবেও কাউকে দেশের বাইরে টাকা নেওয়ার অনুমতি দেওয়াহয়নি। কে বোঝাবে কাকে? আগে অভিযুক্তরা মাথা নিচু করে চলতো, এখন যারা অভিযোগ নিয়ে কথা বলে তাদের ভীতির মধ্যেরাখা হয়।

ফিরে আসি অর্থমন্ত্রীর কথায়। বাজেট আলোচনায় তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন টাকা পাচারের তথ্য যেমন তার কাছে নেইতেমনি নতুন দরিদ্রের হিসাব মানতেও রাজি না তিনি। সমাধান এড়াতে অস্বীকারের চেয়ে ভালো রাস্তা আর কী হতে পারে? নাহলে দেশ দেশের বাইরে অর্থ পাচারের ঘটনা তদন্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বিএফআইইউ গত পাঁচ অর্থবছরে হাজার ২৪টিঘটনার প্রমাণ পেয়েছে যার প্রতিবেদন ইতিমধ্যেই পাঠানো হয়েছে দুদক, বাংলাদেশ পুলিশ, সিআইডি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবার হাতে।যদিও তারা কেউই বিষয়ে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এছাড়াও গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি প্রতি বছর মার্চ মাসে যে রিপোর্ট প্রকাশ করে তাতেও থাকে টাকা পাচারের তথ্য। এই রিপোর্ট সংসদ, গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সেমিনার, গোলটেবিল কোথায় না আলোচিত হয়। সুতরাং মন্ত্রী জানেন না, বিষয়টি কতটা বিশ্বাসযোগ্য সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে বিশেষ করেতার সহকর্মী পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলছেন তিনি নিজ উদ্যোগে কানাডার বেগমপাড়া সম্পর্কে একটি গোপন জরিপ চালিয়ে ২৮টিনমুনা দেখেছেন যেখানে রাজনীতিবিদ, আমলা, শিল্পপতিসহ সবারই নাম আছে। পানাপা বা প্যারাডাইস পেপার্সে আসা নাম গুলোও কারো অজানা নয়। ঠিক যেমন অজানা নয় সানেম, পিপিআরসি কিংবা ব্র্যাকের গবেষণা তথ্য।

কেউ ঘুমালে তাকে জাগানো যায়, কিন্তু যদি কেউ জেগে ঘুমায় তখন? টাকা পাচারের তথ্য যেমন অর্থমন্ত্রীর সামনে আছে তেমনিআছে নতুন দরিদ্র হওয়া মানুষের পরিসংখ্যান। সরকার চাইলে বহু আগেই ব্যবস্থা নিতে পারত। কিন্তু সর্ষের মধ্যেই যদি ভূতথাকে তাহলেতো ঘুমিয়ে থাকাই নিরাপদ।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য বিএনপি দলীয় হুইপ

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com