করোনা টেস্ট করাতে গিয়ে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে মানুষের
করোনা টেস্ট করাতে গিয়ে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে। এখানে রোগীর তুলনায় পরীক্ষা হচ্ছেনগণ্য। নমুনা দিতে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে পুড়েও পাওয়া যাচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত সেবা। আবার করোনার নমুনার ফি জমা দিয়েএসে অনেককেই পড়তে হচ্ছে বিপাকে। যারা টোকেন ও ফি জমা দিচ্ছেন, তারাও নির্দিষ্ট দিনে নমুনা পরীক্ষা করাতে পারছেন না।এতে করোনার উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও শূন্যহাতে ফিরতে হচ্ছে অনেককে। এনিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হাসপাতালে আগতরা।
গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টায় রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে দেখা যায়, গেটে দীর্ঘ লাইন।
নারী–পুরুষ এক কাতারে। কেউ দাঁড়িয়ে আছেন, কেউ সড়কে বসে অপেক্ষা করছেন করোনা টেস্টের টিকেটের আশায়। তাদের চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ। করোনার নমুনা টেস্ট করাতে পারবেন তো? তখনো টিকিট দেয়া শুরু হয়নি। আগে সিরিয়াল পেতে অনেকেই ভোরে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। সময় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘ হচ্ছে লাইন। দুপুর গড়ালেও অনেকেই টিকেট না পেয়ে ফিরে গেছেন। সকাল পৌনে নয়টায় ২জন আনসার সদস্য গেট থেকে ১০ টাকা করে নিয়ে বহির্বিভাগের টিকেট দেয়া শুরু করেন।করোনা সন্দেহ হলে আরেকটি লাইনে দাঁড়িয়ে নমুনা পরীক্ষার ফি জমা দিতে বলেন। সেখানে আরেক ভোগান্তি। লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন কয়েকশ’ রোগী। একজনের গায়ের সঙ্গে লেগে আরেক জন দাঁড়িয়ে। মানা হচ্ছে না শারীরিক দূরত্ব। করোনার লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে আগতদের অনেকের উপসর্গ না থাকায় নমুনা টেষ্ট ছাড়াই ফেরত পাঠানো হয়েছে। এছাড়া দীর্ঘ সময় রোদের মধ্যেদাঁড়িয়ে বহির্বিভাগের টিকেট না পাওয়ায় ডাক্তারদের সাক্ষাৎ পাননি অনেকে।
করোনার নমুনা টেস্ট করতে আসা অনেকেই অভিযোগ করেন, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে করোনার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে এলেও টিকেট ও নমুনা টেস্ট করাতে পারছেন না। দায়িত্বে থাকা স্টাফরা নির্দিষ্ট সংখ্যক রোগী ছাড়া দেখতে চান না।মৌখিক ভাবে অনেককেই করোনা হয়নি বলে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এছাড়া নমুনা পরীক্ষায় বিলম্ব করা হচ্ছে। বহির্বিভাগে টিকিট পেলেও নমুনা দিতে এসে হয়রানির শিকার হচ্ছেন কেউ কেউ। ২/৩ দিন লাইনে দাঁড়িয়েও নমুনা দিতে না পেয়ে ফিরেগেছেন অনেকেই। এনিয়ে গতকাল দুপুরে মুগদা হাসপাতালের বহির্বিভাগে বিক্ষোভ করেছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। পরেপুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
রামপুরা থেকে আসা স্নিগ্ধা নামের এক রোগী বলেন, হাসপাতালে এমন ভোগান্তি আগে কখনো দেখিনি। রোগীদের চাপ অনেক বেশি। সবাই নমুনা পরীক্ষায় এসে আটকা পড়ছেন। ভোগান্তির শেষ নেই। যারা করোনায় আক্রান্ত নয়, এখানকার পরিস্থিতিতে পড়লে এমনিতেই আক্রান্ত হয়ে যাবে। ১০০ টাকা দিয়ে স্লিপ নেয়ার জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। লাইন শেষ হচ্ছে না। নমুনাপরীক্ষা না করেই ফিরে গেছেন কয়েকশ’ রোগী।
খিলগাঁও থেকে আসা রোগীর স্বজন ইউনূস আলী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, আমার রোগীকে নিয়ে দু’দিন ধরে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরছি। করোনা টেস্ট করাতে পারছি না। আজও মুগদা হাসপাতালের সামনে তিন ঘণ্টা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু টেস্ট করাতে পারিনি।
যাত্রাবাড়ী থেকে আসা সুইটি জানান, ক্যানসার আক্রান্ত রোগী নিয়ে আসছি। রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ। আগামী রোববার অপারেশন। যে কারণে আগেই করোনা টেস্ট করতে আসছি। সকাল ৬টায় লাইনে দাঁড়িয়েও নমুনা দিতে পারি নাই। ইমার্জেন্সি রোগীর জন্য অনেক অনুরোধ করেও কোনো ফল হয়নি। তারা বলছেন আবার আগামীকাল আসার জন্য। এখানে আমরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছি।
বনশ্রী থেকে আসা সফিউর রহমান বলেন, ৩ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট পেয়েছি। এখন ভিতরে ঢুকে হয়রানির শিকার হচ্ছি।এখানকার এমন পরিস্থিতি আগে জানলে বাহিরেই করোনা টেস্ট করাতাম। আমেরিকান প্রবাসী স্বাস্থ্যকর্মী সোনিয়া হাসনাত চৌধুরী বলেন, আমি ৩দিন এই হাসপাতালে আসছি। কখনো হাসপাতালের লোকজন বলছেন, আপনার সময় চলে গেছে।সকাল থেকে এখানে লাইন। শুধু আমি নই, আরো অনেককে ফিরিয়ে দিয়েছে। তারা ৯টা থেকে ১২টা ছাড়া রোগী দেখবে না।এটা কেন আগে বলে দেয় না। ওদের মধ্যে কেউ একজন এসে কিছু সংখ্যক লোক রেখে বাকিদেরকে চলে যেতে বলে। আমি এখনকি করবো। আমার সঙ্গে কেউ নেই। আমি ৫৮ বছর বয়সী একজন মহিলা। আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করছে। আরো অন্যান্য রোগীদের সঙ্গে তাদের স্বজন আছে। সবার সঙ্গেই একই ব্যবহার করছে। তিনি আরো বলেন, আজসহ তিনবার আমার নমুনা পরীক্ষা না করেই বিদায় করে দিলো। আমি প্রচণ্ডভাবে অসুস্থ। আসা–যাওয়া করতে কষ্ট হচ্ছে। ঢাকা মেডিকেলেও গিয়েছি করোনা টেস্ট করাতে পারিনি।
নমুনা টেস্টের জটিলতায় পড়েছেন নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা ব্যবসায়ী সেলিম মিয়া। তিনি বলেন, গতকাল ভোরে এসে দুপুর ১২টার দিকে বহির্বিভাগের টিকেট কিনেছি। টেস্টের ফি জমা দেয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলে সময় শেষ বলে জানায় হাসপাতালের স্টাফরা। আজ আবার ভোরে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। এখনো নমুনা দিতে পারছি না।
বাড্ডা থেকে আসা শিউলী আক্তার বলেন, গত ৭/৮ দিন ধরে শরীরটা খারাপ যাচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। গায়ে হালকা জ্বরআছে। করোনা টেস্ট করাতে এখানে এসেছি। টিকেটের জন্য ৩ ঘণ্টার বেশি সময় লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। হাসপাতালের আনসার সদস্যরা বলছেন, আজ আর টিকেট দেয়া হবে না। আগামীকাল আবার আসার জন্য। অসুস্থ হয়ে মারা গেলেও টিকেট পাবোবলে মনে হচ্ছে না।
এদিকে হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি সময়ে রোগীদের চাপ অনেক বেশি। ফলে নমনুা পরীক্ষায় হিমশিম খেতে হচ্ছে।করোনা রোগীতে মুগদা হাসপাতালের সবক’টি শয্যাই এখন পূর্ণ। ১৯টি আইসিইউতে রোগী ভর্তি। আইসিইউ খালি হচ্ছে না।রোগীদের অক্সিজেন সরবরাহের জন্য ৪১টি ভেন্টিলেটর থাকলেও ১৫টি প্রায় অকেজো।
এ বিষয়ে মুগদা হাসপাতালের পরিচালক ডা. অসীম কুমার নাথ বলেন, হাসপাতালে নমুনা দিতে এসে অনেকেই ভোগান্তিতে পড়েন এটা সত্যি। তবে আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। প্রতিদিন ১৮৮ জনের নমুনা টেস্ট করার সক্ষমতা রয়েছে আমাদের। এরমধ্যে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের নমুনা পরীক্ষা করাতে হয়। সব মিলিয়ে বাহির থেকে আসা ১৫০ জনের নমুনাটেস্ট করতে পারি। কিন্তু রোগীর সংখ্যা এই চাইতে কয়েকগুণ বেশি। এতে আমাদেরকেও নমুনা টেস্ট করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।বাহিরে সিরিয়ালের বিষয়ে আমরা এখন থেকে নিদিষ্ট সংখ্যক লোককে টিকেট দেবো। এতে ভোগান্তি কমে আসবে। তিনি আরোবলেন, মুগদা হাসপাতালে ভোগান্তি কমাতে হলে এখানে আরো পরীক্ষা করার সুযোগ দিতে হবে। এছাড়া আশপাশে আরোকয়েকটি নমুনা টেস্টের সেন্টার বাড়াতে হবে।