নিশিরাতের সরকার শেখ হাসিনার পাঠানো ফল মধ্যরাতে ঘোষণা ইসির: রিজভী

0

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করে বলেছেন, ‘চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে ভোট ডাকাতির ডিজিটাল মেশিন ইভিএমে ভোটাভুটি হলেও নির্বাচন শেষ হওয়ার ১০ ঘণ্টা পরে রাত পৌনে ২টায় রিটার্নিং কর্মকর্তা গণভবন থেকে নিশিরাতের সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাঠানো ফলাফল ঘোষণা করেন।’

শুক্রবার (২৯ জানুয়ারি) দুপুরে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন

রিজভী বলেন, ‘গত ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে আরও একটি নজিরবিহীন তামাশার রক্তাক্ত নির্বাচন প্রত্যক্ষ করলো দেশবাসী। দিনভর সহিংসতা, খুনোখুনি, গোলাগুলি, ভোটকেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদান, ইভিএমের গোপন কক্ষে সরকারি ক্যাডারদের তাণ্ডব এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় ধানের শীষের প্রার্থীদের সকল এজেন্টকে মারধর করে তাড়িয়ে দিয়ে ভোট ডাকাতির উৎসব করেছে আওয়ামী লীগ।’

বিএনপির এই মুখপাত্র বলেন, ‘ইভিএমে ফলাফল দিতে সর্বোচ্চ এক-দুই ঘণ্টার বেশি লাগার কথা নয়। ডাকাতির পর ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে হিসাব মেলাতেই এই দীর্ঘ সময় লেগেছে। বহু হিসাব-নিকাশ করে তারা দেখিয়েছে নির্বাচনে ২২ শতাংশ ভোট পড়েছে। তার মানে হচ্ছে, বন্দরনগরীর ৭৮ শতাংশের বেশি ভোটার নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। এই প্রত্যাখ্যান ভোটসন্ত্রাসী ক্ষমতাসীনদের বলদর্পী শাসন-শোষণ ও নতজানু-মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি-নেতারা ও আইন শৃঙ্খলাবাহিনী মিলে যে ভোট ডাকাতির পাতানো নির্বাচন সম্পন্ন করেছে, সেটা সরকারি শত বাধার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মিডিয়ার কারণেই দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে উন্মোচিত হয়েছে। এই নির্বাচন ঘিরে নিহত দু’জন এবং ঘাতক সবাই আওয়ামী লীগের। তবে, সেসব খুনি অথবা প্রকাশ্যে গুলিবর্ষণকারী কেউ গ্রেফতার হয়নি, গ্রেফতার হয়েছেন বিএনপি কাউন্সিলর প্রার্থী ইসমাইল হোসেন বালি। কারণ তিনি ভোট ডাকাতির প্রতিবাদ করেছিলেন। নির্বাচনের পরও উত্তেজিত বাতিকগ্রস্তের মতো উদ্ভট উল্লাসে বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর পৈশাচিক নিপীড়ন-নির্যাতন করে চলেছে।’

রিজভী বলেন, ‘‘পদ বাঁচাতে’ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নিজের বাসায় অবরুদ্ধ অবস্থায় অনলাইনে সংবাদ সম্মেলনে গতকাল বলেছেন, ‘মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভালো নির্বাচন হয়েছে। বিএনপি কেন্দ্র দখলসহ সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মাধ্যমে সহিংসতার পথ বেছে নিয়েছে।’ আসলে আওয়ামী নেতারা আত্মমুগ্ধ, চাটুকারদের প্রতি খুব বেশি সংবেদনশীল আর লোভ আছে অতিমাত্রায়। যে কারণে তারা চোখ থাকতেও অন্ধ হয়ে আছে, শুধুমাত্র ক্ষমতার রুটির ভাগের জন্য।’

বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘ওবায়দুল কাদের সাহেবের আপন ছোট ভাই আবদুল কাদের মির্জা গতকাল কোম্পানীগঞ্জে নাগরিক সভায় বলেছেন, ’ওবায়দুল কাদের সাহেব ‘পদ বাঁচাতে’ অপশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন’। আপনি মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে কতদিন টিকে থাকবেন। কিসের সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে? চট্টগ্রামে কোন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। রক্তপাত হয়েছে। এটাকে মেনে নেওয়া যায় না। সেখানে জোর করে ইভিএম ব্যবহার করে একজন প্রার্থীর পক্ষে ভোট নিয়ে বিজয়ী ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ এখন পথহারা।’

স্বয়ং নির্বাচন কমিশনার জনাব মাহবুব তালুকদার সাহেব বলেছেন, ‘চসিক নির্বাচন হলো ‘অনিয়মের’ একটি মডেল। আগামীতে দেশব্যাপী যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তাতে এই মডেল অনুসরণ করা হলে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বসভায় আমরা আত্মমর্যাদা সমুন্নত রাখতে পারব না। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শতকরা সাড়ে ২২ ভাগ ভোটের মতো এত অল্পসংখ্যক ভোট গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নিয়ামক হতে পারে না। এই পরিস্থিতি নির্বাচনের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতার পরিচায়ক, যা গণতন্ত্রের জন্য এক অশনিসংকেত। সুষ্ঠু পরিবেশে অবাধ, নিরপেক্ষ, আইনানুগ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে ভোটার উপস্থিত অবশ্যই বেশি হতো।’

বিএনপির এই শীর্ষনেতা বলেন, ‘মুলত: গ্রীড, পাওয়ার ও ট্রেচারির সমাহার হচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। পদরক্ষার জন্য এবং জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে এরা বিবেককে বন্দি রেখে অন্ধের মতো প্রলাপ বকছেন। কাদের সাহেবদের নিশিরাতের সরকার নির্বাচনকে ‘ভোট ডাকাতির কালচারে’ পরিণত করেছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন হলো আওয়ামী ইতিহাসের ধারাবাহিক ভোট ডাকাতির আরেকটি নজীরবিহীন দৃষ্টান্ত। নির্বাচন কমিশনের আলাদা সত্তাই নেই, ওটা আওয়ামী লীগেরই একটি অঙ্গ সংগঠন।’

রিজভী বলেন, ‘কিছু দিন আগে ৪০ জন বিশিষ্ট নাগরিক নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য কমিশনের প্রতি যে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন এবং বিচার দাবি করে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকপত্র দিয়েছেন তার যৌক্তিকতার প্রমাণ তারা নিজেরাই বারবার দিচ্ছেন। নির্বাচন ব্যবস্থাকে যারা ধ্বংস করেছে তারা জবরদখলকারি বর্তমান সরকার। কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রণের কব্জায় সবকিছু রাখতে সকল প্রতিষ্ঠানে তালা দিয়েছে সরকার। নির্বাচন কমিশনের তালার চাবিটিও সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার হাতে। তিনি যখন ইচ্ছা যা মনে করেন সেটিই তালা খুলে নুরুল হুদার নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের মতো খাঁচার পাখিদের যা বলেন সেটিই তারা বাস্তবায়ন করেন।’

তিনি বলেন, ‘অবৈধ সরকারের পাপেট প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা একজন রুচিহীন ব্যক্তি। সরকার যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই তাকে ব্যবহার করে নিচ্ছেন। মানুষের স্বাধীনতা তথা গণতন্ত্র ধ্বংসের বর্তমান সরকারের শক্তিশালী ফ্রন্ট হিসেবে কাজ করছে নির্বাচন কমিশন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে আওয়ামী লীগের নির্ধারিত ব্যক্তিকে ‘মেয়র’ ঘোষণা দেয়ার আনুষ্ঠানিকতা। নির্বাচন এখন শুধুমাত্র একটি আনুষ্ঠানিকতা।’

রিজভী বলেন, ‘অর্থ ও মানব পাচারের দায়ে কুয়েতে আটক থাকা লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলকে চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে সেই দেশটির আদালত। পাশাপাশি ১ দশমিক ৯ মিলিয়ন কুয়েতি দিনার জরিমানা করা হয়েছে। এ অর্থদণ্ড বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫৩ কোটি ২০ লাখ টাকার সমান। কুয়েতের আদালতে বর্তমান সংসদের একজন এমপির সাজা হওয়ার ঘটনায় বর্তমান সরকারের দুর্নীতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এটিতে সরকারের টনক না নড়লেও এটি দেশের জন্য লজ্জার। বর্তমান রাতের ভোটের সরকার এর দায় এড়াতে পারে না। তাদের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া পাপুলের মতো এমপিরা বেপরোয়া দুর্নীতি করার সাহস পেতো না। বন্ধুরা, আপনারা দেখেছেন পাপুলের স্ত্রী, কন্যা ও শ্যালিকার বিরুদ্ধেও শত শত কোটি টাকার দুর্নীতির সুনির্দ্দিষ্ট প্রমাণ হওয়ার পর দুদক ও সরকারের ভূমিকা কিছুদিন আগে জাতির কাছে পরিষ্কার হয়েছে। মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগে যেখানে বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের জামিন দেয়া হয় না, নানাভাবে হয়রানি করা হয়। সেখানে সরকারের নির্দেশে নিম্ন আদালতেই তাদের জামিন দেয়া হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘গতকালও টিআইবি রিপোর্ট দিয়েছে দুর্নীতির ধারণা সূচকে আগের বছরের তুলনায় আরো দুই ধাপ নীচে নেমে এসেছে বাংলাদেশ। বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কর্তৃক পরিচালিত ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০২০’ এর বৈশ্বিক প্রকাশ উপলক্ষে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়। সিপিআই ২০২০ অনুযায়ী ১৮০টি দেশের মধ্যে তালিকার নীচের দিক থেকে বাংলাদেশ ১২তম অবস্থানে আছে। যেটা সিপিআই-২০১৯ এর তুলনায় দুই ধাপ নীচে নেমেছে বলে উল্লেখ করা হয়। ২০১৯ সালে নিম্নক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪ তম। এর পেছনে করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যেও বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক দুর্নীতির বিষয়টিকে অন্যতম কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার, বিচারহীনতা, মতপ্রকাশ ও জবাবদিহিতার অভাবকে অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেছে টিআইবি। টিআইবি আরও বলেছে- বাংলাদেশে দুর্নীতি দমনে দুদক কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। বন্ধুরা, আমরা আগেও বলেছি- দুদক হলো বিরোধী দল নির্যাতনের হাতিয়ার। আর সরকারি দলের দুর্নীতি ধোয়ার মেশিন। মূলতঃ গণতন্ত্রহীনতার কারণেই বর্তমানে দেশে দুর্নীতি মহামারি আকার ধারণ করেছে।’

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক হাবিবুল ইসলাম হাবিবসহ বিএনপির বেশ কিছু নেতাকর্মীকে মিথ্যা মামলায় সাজা দেয়ার উদ্দেশ্যে কারাগারে আটকিয়ে রাখা হয়েছে। এটিকে জঘন্য চক্রান্তের পূর্বাভাস বলে সকলেই মনে করছে। হাবিবসহ নেতৃবৃন্দকে উদ্দেশ্যমূলক সাজা দেয়ার জন্য সরকার সুপরিকল্পিত রোডম্যাপ অনুযায়ী এগুচ্ছে। সরকার একটি সর্বনাশা খেলায় নেমেছে। আমি অবিলম্বে কারান্তরীণ বিএনপি নেতৃবৃন্দের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারসহ মুক্তির জোর দাবি জানাচ্ছি।’

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবুল খায়ের ভূঁইয়া, শাহিদা রফিক, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ ও আব্দুল খালেক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com