ব্রেক্সিট: যুক্তরাজ্য ও ইইউ’র ঐতিহাসিক বাণিজ্য চুক্তিতে কী আছে?
ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধিরা দীর্ঘ দিনের আলোচনার পর বৃহস্পতিবার ব্রেক্সিট বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন করেছে। যুক্তরাজ্যের চূড়ান্তভাবে বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার ২৭টি দেশের এই ইউনিয়ন ছেড়ে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে এই চুক্তিটি সম্পন্ন হলো।
তবে বাণিজ্য চুক্তিতে লক্ষণীয় হলো, যুক্তরাজ্য ইইউ’র সদস্য থাকাকালে ব্যবসা-বাণিজ্য যে ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হতো তা আরো বেশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মুখোমুখি হবে।
এ রকম আরো অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেমন পহেলা জানুয়ারি থেকে যুক্তরাজ্য ইইউ’র বাণিজ্য ব্যবস্থাপনা ছেড়ে আসলে ইউরোপে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে দেশটির বৃহৎ আর্থিক পরিষেবা প্রতিষ্ঠানগুলো কী ধরণের বিধিনিষেধের মুখোমুখি হবে তা স্পষ্ট নয়।
ব্রেক্সিট কী ছিল?
ব্রেক্সিট এর পূর্ণরূপ হলো ‘ব্রিটিশ এক্সিট’। যার অর্থ ব্রিটেনের প্রস্থান। ব্রেক্সিট দ্বারা ৪৭ বছর পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বের হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে বুঝায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছাই থেকে তৈরী হয়েছিল ইউরোপীয় দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
২০১৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত একটি গণভোটে ‘ভোট লিভ’ প্রচারণাটি ৫২-৪৮ শতাংশের ভোটে জিতে গেলে প্রথম দেশ হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্য বের হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরী হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বর্তমানে আটলান্টিক থেকে রাশিয়া ও তুরস্কের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন নাগরিকের ইউনিয়ন।
ব্রেক্সিট সমর্থকরা ৩১ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে ইইউ থেকে ব্রিটেনের আনুষ্ঠানিক প্রস্থানকে ৬৬ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর দেশের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের পুনরুদ্ধার হিসেবে উল্লেখ করেছে।
অন্যদিকে বিরোধীরা ব্রেক্সিটকে দেখেছিল ইউরোপীয় ঐক্যে এক ঐতিহাসিক ধাক্কা হিসেবে। তাদের মতি এটি অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধন করতে পারে এবং ইইউ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যকার একমাত্র স্থলভাগ আয়ারল্যান্ড সীমান্তে নতুন করে ঝুঁকিপূর্ণ সংঘাতের ঝড় তুলতে পারে।
আনুষ্ঠানিক প্রস্থানের পর থেকে বাণিজ্য থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের বিনিময় পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার নীতি অনুসরণ করেছে লন্ডন। তবে এই রূপান্তর পর্বটি ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে শেষ হবে।
নতুন এই বাণিজ্য চুক্তিতে কী আছে?
পহেলা জানুয়ারি ২০২১ থেকে পণ্য বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার জন্য গত মার্চ মাস থেকে উভয় পক্ষই জটিল আলোচনা চালিয়ে আসছিল।
বৃহস্পতিবার ঘোষিত এই চুক্তির মানে হলো এই পণ্য বাণিজ্য, যা ৯০০ বিলিয়ন ডলারের ইইউ ও যুক্তরাজ্যের বার্ষিক বাণিজ্যের প্রায় অর্ধেক, শুল্ক এবং কোটা মুক্ত থাকবে।
তবে যুক্তরাজ্য ও ইইউ’র মধ্যে যেসব পণ্যগুলো আমদানি-রফতানি হবে তা শুল্ক এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে হবে। এছাড়া অতিরিক্ত কাগজপত্রের প্রয়োজন হবে, যা ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
গত বছর সম্পাদিত একটি আনুষ্ঠানিক প্রত্যাহার চুক্তির একেবারে শুরুতেই এই চুক্তির ব্যাপারে আলোচনা হয়েছিল, যাতে নিশ্চিত করা হয়েছিল ইইউ সদস্য আয়ারল্যান্ড এবং ব্রিটিশ প্রদেশ উত্তর আয়ারল্যান্ডের মধ্যস্থিত স্পর্শকাতর সীমান্তে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে না।
এই চুক্তির তৃতীয় মূল উপাদানটি হলো ব্রিটেন এবং ইইউর মধ্যে মাছ ধরার কোটা বণ্টন।
বাণিজ্য চুক্তি আর কোন কোন অঞ্চলকে প্রভাবিত করবে?
চুক্তিটি অনেক অঞ্চলে ব্রেক্সিটের মতো সমপর্যায়ের সহযোগিতার আশ্বাস দেয় না। এতে যুক্তরাজ্যের রফতানির মেরুদণ্ড হিসেবে স্বীকৃত আর্থিক এবং ব্যবসায়িক পরিষেবাগুলো স্বল্প পরিমাণে অন্তর্ভুক্ত।
উদাহরণস্বরূপ, চুক্তিতে কৃষি সংস্থাগুলোকে তাদের পণ্য লন্ডন শহর থেকে একক বাজারে বিক্রয় করার অনুমতি দেয়ার মতো তথাকথিত সমমান বজায়ের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেই। চুক্তিতে কেবল আর্থিক পরিষেবাদির উপর স্ট্যান্ডার্ড বিধান রাখা হয়েছে যার মানে এটি বাজারে প্রবেশের প্রতিশ্রুতি দেয় না।
বৈদেশিক নীতি, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়েও একই কথা। অন্যদিকে পরিবহন, জ্বালানি ও বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতা সরবরাহ বর্তমান স্তরের নিচে নেমে যাবে।
আর কোন সম্পর্কগুলোর অবনতি হতে পারে?
মোবাইল রোমিং, পেশাগত যোগ্যতার পারস্পরিক স্বীকৃতি, আইনি সেবা, ডিজিটাল বাণিজ্য এবং সরকারি কেনাকাটা- এমন অনেকগুলো ক্ষেত্রে সহযোগিতা হ্রাস পাবে।
ভ্রমণ ভিসা না দেয়ার ব্যাপারে ইইউ এবং যুক্তরাজ্য একমত হওয়ায় দু’ অঞ্চলের মানুষের অবাধ চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে।
এর অর্থ হলো, যুক্তরাজ্যগামী ইউরোপের নাগরিকরা এবং ইউরোপগামী যুক্তরাজ্যের নাগরিকরা সীমান্ত স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে যেতে হবে এবং ইলেক্ট্রনিক গেটগুলো দ্রুত পার হওয়ার জন্য তারা আর বায়োমেট্রিক পাসপোর্ট ব্যবহার করতে পারবে না।
পেশাগত সেবাগুলো কীভাবে প্রভাবিত হবে?
ইউরোপীয় ইউনিয়নের চুক্তির পাঠ অনুযায়ী এই চুক্তির মাধ্যমে পেশাগত যোগ্যতার স্বয়ংক্রিয় পারস্পরিক স্বীকৃতি আর থাকবে না।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে, ‘চিকিৎসক, নার্স, দন্ত চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট, পশু চিকিৎসক, প্রকৌশলী বা স্থপতিরা যেসব দেশে কাজ করতে ইচ্ছুক, তাদের যোগ্যতা অবশ্যই সেসব সদস্য দেশ কর্তৃক স্বীকৃত হতে হবে।’
এটি যুক্তরাজ্যের পক্ষে ক্ষতি। দেশটি নিয়ন্ত্রিত সেবাগুলোতে কোনো ‘অপ্রয়োজনীয়’ বাধা না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে ‘ব্যাপক প্রচারণা’ চেয়েছিল। তবে যুক্তরাজ্যের চুক্তির সারাংশ অনুযায়ী চুক্তিটি পেশাগত যোগ্যতার স্বীকৃতির জন্য একটি ‘কাঠামো’ প্রদান করছে।
‘সম খেলার মাঠ’ বজায় রাখার ব্যাপারে চুক্তিতে কী বলা হয়েছে?
বাণিজ্য চুক্তিটি উভয় পক্ষকে নিজেদের পরিবেশগত, সামাজিক, শ্রম এবং করের স্বচ্ছতার মানদণ্ডগুলো ধরে রাখার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেয় যাতে তারা একে অপরকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে।
খুব বেশি মতপার্থক্য বা সালিশের মতো পরিস্থিতি তৈরী হলে উভয় পক্ষই শুল্ক আরোপ করতে পারবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের যেকোনো ভর্তুকির বিষয়ে অসন্তুষ্ট হলে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো সেগুলো খতিয়ে দেখতে যুক্তরাজ্যের আদালতের স্মরণাপন্ন হতে পারবে।
রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি কী পরিমাণে হলে তা সমস্যা তৈরী করতে পারে তার নির্ধারিত কোনো সীমারেখা দেয়া হয়নি। এটি ‘কেস-বাই-কেস’ ভিত্তিতে ধরা হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের সারাংশে বলা হয়েছে, ভর্তুকির ব্যাপারে উভয় পক্ষই স্বচ্ছ হতে হবে। রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি যাছাই করার জন্য ইইউ ও যুক্তরাজ্য উভয়েরই একটি স্বাধীন কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন হবে।
আদালত অবশ্যই যেকোনো অবৈধ ভর্তুকি পরিশোধের ব্যাপারে আদেশ দিতে পারবে। এতে একটি পুনঃভারসাম্যকারী কলা-কৌশল অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ব্রেক্সিট কি তাহলে হয়েই গেল?
হ্যাঁ, কারণ ব্রিটেন ইইউ থেকে, ইইউ’র শুল্ক ইউনিয়ন এবং একক বাজার থেকে বেরিয়ে গেলো এবং দেশটি আর এদের নিয়ম-নীতিতে আবদ্ধ নয়। এখন বৃহস্পতিবার সম্পন্ন হওয়া ২০২০ সালের বিচ্ছেদ নিষ্পত্তি এবং বাণিজ্য ও সহযোগিতা চুক্তির উপর ভিত্তি করে উভয় পক্ষের বর্তমান সম্পর্ক চলবে।
তবে ব্রেক্সিট গণভোটের পরে যারা ঘনঘন আলোচনার অবসানের প্রত্যাশা করছেন তারা হতাশ হয়েছেন।
চুক্তিতে স্থানান্তরের সময়সীমা ও পর্যালোচনার শর্তাদি জুড়ে দেয়া হয়েছে যার মানে হলো মাছ ধরা, বাণিজ্য নীতি এবং আরো কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা আরো গড়াবে।
সূত্র : আলজাজিরা