বাজারজুড়ে সংকটের নাম আস্থাহীনতা
লবণ খেলে তেজস্ক্রিয়তা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, এই গুজবে চীনে ২০১১ সালের মার্চ মাসে এক দিনেই সব লবণ বিক্রি হয়ে যায়। লবণ কেনার হিড়িকে সেখানে দাম বেড়ে গিয়েছিল কয়েক গুণ। ভূমিকম্প ও সুনামিতে জাপানের ফুকুশিমার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঘটলে সেখান থেকে চীনে তেজস্ক্রিয়তা চলে আসবে, এটাই ছিল গুজবের উৎস। বিশাল দেশ চীনে সেই গুজব ঠেকানো সহজ হয়নি।
চীনের মানুষের লবণ কেনার ক্ষেত্রে গুজবের উৎস তো জানা যায়, কিন্তু বাংলাদেশে গত মঙ্গলবার কোন গুজবের কারণে লবণ কেনার হিড়িক পড়ল, সেই প্রশ্ন অনেকেরই। উত্তর একটাই, আস্থাহীনতা। বিশেষ করে পেঁয়াজ–কাণ্ডের সঙ্গে লবণকাণ্ডের একটা সম্পর্ক খুঁজে বের করাই যায়। পেঁয়াজ নিয়ে যা হলো, তাতে লবণ নিয়ে মানুষ সরকারের ওপর আস্থা রেখে চুপচাপ ঘরে বসতে থাকবে, এমন মনে করাটা ভুল। ফলে যাঁর বাসায় মাসে এক কেজি লবণের প্রয়োজন, তাঁকেও দেখা গেল পাঁচ কেজি লবণ নিয়ে বিশ্বজয়ের হাসিমাখা মুখে ঘরে ফিরছেন। এর সঙ্গে এখন তুলনা করেন ট্রাকের সামনে পেঁয়াজ কিনতে দাঁড়িয়ে থাকা সেসব অসহায় মুখ, যাঁদের ২০০ টাকা দিয়ে এক কেজি পেঁয়াজ কেনার সামর্থ্য কোনোকালেই ছিল না।
গুজবে কান দিয়ে যাঁরা হুড়োহুড়ি করে লবণ কিনেছিলেন, তাঁদের নিয়ে এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই হাসিঠাট্টা করছেন। এই লোকগুলোই কিন্তু পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে আছে বলে সরকারের বক্তব্যে আস্থা রেখেছিলেন। আস্থার ফল হাতেনাতেই পেয়েছেন। ফলে লবণের গুজবে তাঁরা যে বাজারের ওপর আস্থা রাখবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। এমনিতেই গুজব ছড়ায় দ্রুতগতিতে, আর হাতের মুঠোয় ফেসবুক থাকলে তো কথাই নেই, গুজব ছড়াবে বিদ্যুৎগতিতে।
আমেরিকার মনোবিজ্ঞানী রবার্ট এইচ ন্যাপ গুজব নিয়ে গবেষণা করেন। এ সাইকোলজি অব হিউমার গ্রন্থে তিনি বলেছেন, ‘গুজব ব্যবহার করে মানুষের ভাবাবেগকেই। সমাজের ভাবাবেগকে প্রকাশ ও তুষ্ট করার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে গুজবের।’ সুতরাং পেঁয়াজ নিয়ে যা যা হলো, তাতে ভাবাবেগ নিয়ন্ত্রণ করে সাধারণ মানুষের ঘরে বসে থাকার কথা নয়।
লবণ–কাণ্ডের আগে পেঁয়াজ–কাণ্ডের কথা বলা যাক। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে গত ২৯ সেপ্টেম্বর। এর আগে পেঁয়াজের দাম ছিল ৬৫ থেকে ৭৫ টাকার মধ্যে। বাংলাদেশ যত পেঁয়াজ আমদানি করে, তার ৯০ শতাংশই আসে ভারত থেকে। সেই ভারত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলেও সরকার আশ্বাস দিল পেঁয়াজের দর নিয়ন্ত্রণে থাকবে, অন্য উৎস থেকে পেঁয়াজ আমদানিও করা হবে। সেই পেঁয়াজ শতক ছাড়াল, এমনকি দ্বিশতকও ছাড়িয়ে গেল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রথম থেকেই পেঁয়াজের দাম বাড়ানোর জন্য অসাধু ব্যবসায়ীদের দায়ী করে আসছে। কিন্তু ভারত যে পেঁয়াজ উৎপাদন নিয়ে সংকটে আছে, এই তথ্য না জানার দায় তো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েরই। দুনিয়াজুড়ে ‘বিজনেস ইন্টেলিজেন্স’ বলতে একটা ব্যবস্থা চালু আছে। এটা কাজে লাগিয়ে দেশের ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ীরা ঠিকই খবর রাখেন কোথায় কোন ফসল মার খেয়েছে, কোথায় দাম বাড়ছে বা কোথায় দর কমছে। জানে না কেবল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
আবার দেশের ভেতরে উৎপাদনের পরিমাণ, বাংলাদেশের মানুষ কতটা পেঁয়াজ খায়, প্রকৃত চাহিদা, প্রকৃত আমদানি—কোনো তথ্যই তো ঠিক নেই। যখন যে পণ্য নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়, দেখা গেছে প্রতিটি ক্ষেত্রেই তথ্যের গরমিল। তাহলে কেন ক্রেতারা সরকারি তথ্য আর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আশ্বাসের ওপর আস্থা রাখবেন?
পেঁয়াজ নিয়ে গত দেড় মাস ধরে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের সংবাদ পরিবেশন করেছে বিভিন্ন গণমাধ্যম। প্রথম থেকেই আসন্ন সংকটের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বক্তৃতা-বিবৃতি ছাড়া কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে খুবই কম। আবার বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি যখন বলেন, পেঁয়াজের দর ১০০ টাকার নিচে আপাতত নামবে না, তখন ব্যবসায়ীরাও দাম বাড়ানোর সুযোগ পেয়ে যান। এ ধরনের বক্তব্যকে দাম বাড়ানোর ‘লাইসেন্স’ বলা যায়।
এটা পরিষ্কার যে পেঁয়াজ–সংকট মোকাবিলায় সরকার ব্যর্থ হয়েছে। কেবল যে ব্যর্থ হয়েছে তা নয়, পেঁয়াজ নিয়ে মানুষের দুর্ভোগ ও ভোগান্তি নিয়ে উপহাসও করা হয়েছে। এর মধ্যেই গুজবকে কেন্দ্র করে লবণ নিয়ে এদিনে যা হলো, তা আসলে আস্থাহীনতারই প্রকাশ।
বাজার কখনো পুলিশ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বাজার চলে আস্থার ওপর। আস্থা নেই বলে শেয়ারবাজারে চলছে দীর্ঘ মন্দাদশা। আস্থাহীনতায় বেড়ে গিয়েছিল ব্যাংক খাতের তারল্য–সংকট, আমানত রাখতে যাননি গ্রাহকেরা। আস্থার সংকটে বিনিয়োগ থেকে দূরে থাকেন উদ্যোক্তারা। আর আস্থার সংকটেই পেঁয়াজের দাম ২০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়, তৈরি হয় লবণ–কাণ্ড। এখানে সরকারের ভূমিকা নজরদারি ও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সব পক্ষ সে কাজটাই করুক।