ক্ষমতাদর্পীদের দাপট থামাতে হবে -খায়রুল কবীর খোকন

0

সরকারি দলের অনেকেই দখল-দস্যুতায় শক্তিশালী, তবে রাজধানীর উমরপুর এলাকার এক সংসদ সদস্য রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি দখলে মুন্সিয়ানা দেখিয়ে চলেছেন বহুদিন ধরে। সেটা বহুবার পত্রিকার পাতায় এসেছে, গণমানুষের আলাপ-আলোচনায় এসেছে বারবার। দেশবাসী অসহায় দৃষ্টিতে দেখেছে সেসব আর হয়তো নিজেদের কপাল চাপড়েছে। কারণ, এসবই প্রতিকারহীন। সংসদ সদস্য সাহেব পাকা খেলোয়াড়, তাই তার বিরুদ্ধে সরকারের কোনো ‘আইনগত ব্যবস্থা’ শেষ অবধি কার্যকর থাকে না। সর্বশেষ, আলোচ্য হচ্ছে-এই কয়েক দিন ধরে পত্রপত্রিকায় খবর আসছে, ঢাকা মহানগরীর এক-প্রান্তে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ সংলগ্ন এলাকায় প্রায় ৫৪ একর রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি তিনি দখল করে সেখানে নানারকম শিল্পকারখানা গড়ার চেষ্টা করছেন দীর্ঘকাল ধরে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন অপদখলকৃত জমি চিহ্নিত করে তা উদ্ধারের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে; কিন্তু দখলবাজের সঙ্গে পেরে উঠছে না-রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি পুনরুদ্ধারে। জাতীয় সম্পদ পুনরুদ্ধারে কমিশনের দায়িত্বশীল কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করে বিষোদগার করেছেন সেই সরকারদলীয় সংসদ সদস্য। জাতীয় নদী কমিশনকে ‘শত্রু ও দুশমন’ বলে ভর্ৎসনা করেছেন এবং কমিশনের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন ক্ষমতাদর্পী ওই সংসদ সদস্য। কথায় বলে, ‘চোরের মায়ের বড় গলা’! সারা দেশেই এরকম ক্ষমতাধরের অভাব নেই; তাদের সংখ্যা কত সে হিসাব কে রাখে! সরকারি দলের নেতারাও রাখেন না। তারা তো বিএনপিকে তুলাধুনা করতেই ব্যস্ত। পত্রিকার পাতায়, টিভি চ্যানেলের স্ক্রিনে তাদের কটুকথা দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে জনগণ ত্যক্ত-বিরক্ত। কিন্তু নিজ দলের দখলবাজদের অপকর্মের বিষয়ে তাদের অপরাধবোধও নেই; গ্লানিও নেই।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যে কোনো সাহসী-নিরপেক্ষ ব্যক্তির কাছে জিজ্ঞেস করে দেখুন-‘কোন আমলে কারা সারা দেশে হিন্দু-সম্পত্তি বেদখল করে আত্মসাৎ করেছে এবং অবিরাম আত্মসাতের চেষ্টা করে যাচ্ছে?’ তারা নিশ্চিত জবাব দিবেন- একটি বিশেষ দল ক্ষমতায় থাকার সময়কালে তারাই সর্বাধিক সংখ্যালঘু সম্পদ-সম্পত্তি দখল করে নিয়ে নিয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, হিন্দু নাগরিকরা কিন্তু ওই দল বিশেষের ভোট-ব্যাংক। সংখ্যালঘুদের কমপক্ষে সত্তর/আশি ভাগ ভোট পেয়েও দলটির নেতারা তাদের সম্পদ-সম্পত্তি বেদখল হওয়া থেকে রক্ষার গ্যারান্টি দিতে পারে না। অপরিসীম লোভাসক্ত এই দলটির নেতা-সংগঠকরা ক্ষমতায় থেকে সংখ্যালঘুদের জানমালের সুরক্ষা দেওয়ার পরিবর্তে তাদের জমিজমা, মালপত্র লুটে নিয়ে দেশ-ছাড়া করতেও ছাড় দেননি এতটুকু।পুরান ঢাকার সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ভূমি-দস্যুতা ‘কিংবদন্তিতুল্য’। সেসব কেচ্ছাকাহিনি সবাই জানে, এখন আরও প্রকাশ পাচ্ছে-তাঁর ছেলের গ্রেফতারের পরে। তাঁর দখল থেকে ঢাকা মহানগর এলাকা এবং সংলগ্ন বাইরের এলাকা থেকে বহু একর জমি উদ্ধার করা হয়েছে বা আংশিক উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। এরকম সংসদ সদস্য সারা দেশেই আছেন প্রচুর-সংখ্যায়, যারা ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছেন যুগ যুগ ধরে। তাঁরা প্রত্যেকেই কিন্তু কোটিপতি, কেউ কেউ শতকোটিপতি, কেউ-বা হাজার কোটিপতি, আবার কেউ-বা হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক, তারপরও তাদের রাষ্ট্রীয়-সম্পত্তি লুণ্ঠনের, দখলবাজির দস্যুতার লালসা এতটুকু সামাল দেন না তারা, বরং দিন দিন তা আরও লাগামহীন হচ্ছে। ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের কেন এই দস্যুতার নেশা? কেন তাদের এই বেসামাল পরিস্থিতি? কেন এসব রাষ্ট্র-সম্পদ আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে সময়মতো উপযুক্ত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয় না? কীভাবে হবে? কেবল চাপাবাজি দিয়ে তো সুশাসন চলে না, সুস্থ সমাজ গড়ে তোলা যায় না। দল বিশেষের নেতারা তাদের দলটিকে সৎ-মানুষের রাজনৈতিক দল বলে চিৎকার করে যাচ্ছেন অবিরাম। স্পষ্টভাবেই তা চাপাবাজি ছাড়া কিছু নয়। তাদের চোখেই তো পড়ে না-এসব দস্যু ডাকাতের কায়-কারবার। তারা তো দল-কানা। নিজ-দলের লোকদের কোনো দোষ দেখতে পান না তারা। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ঢালাও অপপ্রচার, কুৎসা রটাতে তারা অতিমাত্রায় পারঙ্গম, কিন্তু নিজ-দলের অপকর্মের হোতাদের তারা দেখতে পান না।

বঙ্গবন্ধু আফসোস করে তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন সেই ১৯৭৩-৭৪ সালে- ‘আমি সারা-দুনিয়া থেকে ভিক্ষা করে আনি আর ‘চাটার দল’ সব খেয়ে ফেলে।’ তিনি দলীয় নেতা-কর্মী-সংগঠকদের একাংশের মধ্যে সীমাহীন লোভ-লালসা দেখে ক্ষোভে-অভিমানে প্রায় কেঁদেই দিয়েছিলেন সেই ভাষণের সময়ে। দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু চাটার দল নামধারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার ফুসরত পাননি।

বর্তমান সরকারও একইভাবে দল-কানা-দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠিন কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছে। ইসমাইল-সম্রাট, জি কে শামীম, এনু-রূপন (ভ্রাতাদ্বয়), মো. শাহেদ, সাবরিনা কিংবা সাম্প্রতিক গোল্ড মনির, এরকম দুই/দশজন বা দুই/একশো ধরলেও কিছুই হবে না। দল বিশেষের মধ্যে এরকম চাটার দল আছেন হাজার নয়, লাখের অঙ্কে-কয়জনকে ধরবেন প্রধানমন্ত্রী? জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে দলবাজ অপরাধীর সংখ্যাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। এসব অপরাধীর বড়-সুবিধা হচ্ছে-তাদের সমর্থকের অভাব নেই, কারণ, তারা অবৈধ উপার্জনের টাকা-পয়সার ভাগ দিতে পারে, দখলকৃত জমির অংশ দিয়ে কিংবা মোটা-অঙ্কের টাকা ঘুষ দিয়ে আপসরফা করতে পারে দলীয় নেতা, মন্ত্রী-মিনিস্টারদের সঙ্গে, নিজেদের অবৈধ উপার্জন আর নিজেদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা (আইনের হাত থেকে) নিশ্চিত করতে পারে।

উন্নত বিশ্বে, আধুনিক সমাজে, মানবিক, গণতান্ত্রিক, সুশাসনের রাষ্ট্রে কোনো দলে এত অপরাধী প্রশ্রয় পায় না। কারণ, সেইসব রাষ্ট্রে জননেতা বা সরকার প্রধান কঠোর-হাতে দুর্নীতি দমনের ব্যবস্থা শুরু থেকেই করে যান, কখনো কাউকে ছাড় দেন না, অপরাধ করলে শাস্তি পাওয়াই সেসব দেশের রেওয়াজ, নিয়মনীতিতে পরিণত। এর অন্যথা কদাচিৎ ঘটে। ব্যতিক্রম ছাড়া অপরাধী-মাত্রই বিচারের মাধ্যমে শাস্তি পেতে বাধ্য। তাই, নতুন অপরাধীর জন্ম নিতে নব্বইবার ভাবতে হয়। সেইসব দেশের মানুষের ভিতরে মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতাবোধ, সততার প্রতি অঙ্গীকার সেই সংস্কৃতি দৃঢ়ভাবে ভিত্তি পেয়ে বসে গেছে।

আর আমাদের দুর্ভাগ্য-আমাদের সমাজে দুর্নীতিবাজ জন্মায় ঘণ্টায় ঘণ্টায়। স্তাবকতা, চাটুকারিতায় ভুলে যান আমাদের বড় নেতারা। যে যত বড় দুর্নীতিবাজ সে তত বড় চাটুকার, আর বড় মোসাহেব। বড় নেতারা প্রত্যেকেই চাটুকার আর মোসাহেবকে প্রশ্রয় দেন, আশ্রয় দেন। তার ফলেই অবিরাম দুর্নীতিবাজ জন্ম হয়, প্রতিনিয়ত অসাধু আর লুটেরা দস্যুর জন্ম হয়। এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরোতে হবে। রাষ্ট্রিক ও সামাজিক শীর্ষ-বৃত্তটিকে আমাদের সততা ও নিষ্ঠার নিয়মের মধ্যে নিয়ে যেতে হবে। প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে উপযুক্ত অ্যাকাডেমিক শিক্ষালাভ ও সমাজ-অনুশাসনের মূল্যবোধের দীক্ষা লাভ এবং প্রতিটি মানুষের মধ্যে মানবিক নীতি-নৈতিকতা শক্ত-ভিতের ওপরে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তার আগে রাষ্ট্রের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে লুটেরাদের দল থেকে বের করে দিতে হবে, জেলখানায় ঢুকিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

লেখক : বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক ডাকসু সাধারণ সম্পাদক।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com