বাইডেন আমলে পাক-মার্কিন সম্পর্ক নির্ধারণ করবে যেসব বিষয়

0

মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের উত্থানকে একটা সন্ধিক্ষণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার দায়িত্ব গ্রহণ আফগানিস্তান, ইরান, চীন ও ইউরোপে বিভিন্ন ইস্যুতে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

পররাষ্ট্র নীতির অনেক বিষয়ে বাইডেন আর ট্রাম্পের মধ্যে যদিও গভীর মতপার্থক্য রয়েছে, তবে যুক্তরাষ্ট্র যদি মনে করে যে আফগানিস্তানে পাকিস্তান তাদের পক্ষে কাজ করছে, তাহলে নতুন প্রশাসনের অধীনেও পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্কের উপরও আফগানিস্তানের ঘটনাবলীর প্রভাব পড়বে। 

ট্রাম্পের সাথে মতভিন্নতা সত্বেও বাইডেন আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার অব্যাহত রাখবেন বলেই ধারণা করা যায়। যদিও দ্রুত, তড়িঘড়ি করে দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে সেটা তিনি করবেন না। তার বদলে সতর্ক কৌশল অবলম্বন করবেন তিনি এবং কিছু সেনা পেছনে রেখে আসবেন। অন্যভাবে বললে সেনাপ্রত্যাহারের ধরনটা হয়তো সামান্য বদলাবে, কিন্তু এতে কোন সন্দেহ নেই যে, বাইডেন নিজেও আমেরিকার দীর্ঘতম যুদ্ধের ইতি টানতে চান। 

যুক্তরাষ্ট্রে যুদ্ধের ব্যাপারে কোন আগ্রহ নেই। এখন দুই দলের মধ্যেই একটা মতৈক্য তৈরি হয়েছে যে তালেবানদের সামরিকভাবে পরাজিত করা যাবে না এবং একমাত্র উপায় হলো আলোচনা এবং পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে ক্ষমতা ভাগাভাগির ফর্মুলা। তালেবানদেরকে রাজনীতির মূলধারায় নিয়ে আসার ব্যাপারেও একটা ঐক্যমত তৈরি হয়েছে। 

যে প্রশ্নগুলো এখনও রয়ে গেছে, সেগুলো হলো: ক) কিভাবে একটা আন্ত:আফগান সমঝোতা হবে, এবং খ) এখনও শক্তিশালী আইসিসকে কিভাবে দমন করা হবে। 

এই অবস্থায় যুদ্ধ হয়তো শেষ হতে যাচ্ছে, কিন্তু তথাকথিত ‘আফগান গোলকধাঁধা’ থেকেই যাচ্ছে। আর সে কারণেই আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পাকিস্তানের প্রাসঙ্গিকতা থেকেই যাচ্ছে। 

ট্রাম্প-উত্তর সময়ে গুরুত্বপূর্ণ যে উপাদানটি হাজির থাকবে, সেটি হলো যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের বিপরীতে তার গতানুগতিক ‘মূলা ঝোলানোর’ নীতিতে ফিরে যাবে। 

পাকিস্তানের কিছু কর্মকর্তা বিশ্বাস করেন যে, পাকিস্তানের ব্যাপারে বাইডেনের একটা বাস্তবমুখী ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তবে তার এই বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গির শিকড় রয়েছে এই বিশ্বাসের মধ্যে যে, ‘আফগান গোলকধাঁধা’ সমাধানে পাকিস্তানই প্রধান চাবিকাঠি। বাইডেন যতক্ষণ পর্যন্ত দেখবেন যে, পাকিস্তান মার্কিন পক্ষে খেলছে, ততক্ষণ তার এই অনুকূল অবস্থান বজায় থাকবে। 

বর্তমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের জন্য এটা চরম গুরুত্বপূর্ণ যাতে পাকিস্তান আফগানিস্তানে মার্কিন পক্ষ নিয়ে কাজ করে। আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যহারের মার্কিন নীতির সাথে পাকিস্তানের মিল রয়েছে, কারণ পাকিস্তানে একটা ব্যাপক ও জোরালো আকাঙ্ক্ষা রয়েছে যাতে আফগান যুদ্ধের একটা সমঝোতামূলক পরিসমাপ্তি ঘটে। আফগানিস্তানকে আরেকটি গৃহযুদ্ধের মধ্যে তলিয়ে যেতে দেখার কোন আকাঙ্ক্ষা পাকিস্তানের মধ্যে নেই। 

এই কারণেই পাকিস্তানও আলোচনার ব্যাপারে এমন নীতি গ্রহণ করেছে, যেখানে তালেবানদের বিজয়কে শতভাগ সমর্থন দেয়া হচ্ছে না। নব্বইয়ের দশক থেকে এই অবস্থান অনেকটাই আলাদা। সে সময় পাকিস্তান পুরোপুরি তালেবানদের বিজয়ের পক্ষে সমর্থন দিতো। দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানের এই বাস্তবমুখী কৌশলের কারণে পাকিস্তান আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বৃহত্তর বিনিময়ের একটা স্থান তৈরি হয়েছে। 

এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধের ইতি টানার সিদ্ধান্তটা ছিল ট্রাম্প প্রশাসনের। আর ট্রাম্পই পাকিস্তানকে দেয়া সব কোয়ালিশান সাপোর্ট তহবিল দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এতে বোঝা যায় যে, ২০১৬ সালে ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় আসেন তখন পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কতটা তলানিতে চলে গিয়েছিল। তবে, পরবর্তীতে ‘আফগান প্রশ্নে’ পাকিস্তানের গুরুত্বটা নতুন করে বুঝতে পারে ওয়াশিংটনের কিছু বাস্তববাদী মানুষ, যারা ট্রাম্পকেও বিষয়টি বোঝাতে সক্ষম হয়। 

তখন যে বাঁক বদল ঘটেছিল, সেটা এখনও জারি আছে। এতে যে সত্যটা আরও জোরালো হয়ে উঠেছে, সেটা হলো বাইডেন তার নিজস্ব বাস্তববাদী চিন্তার কারণে আফগানিস্তানে পাকিস্তান কি করেছে বা করেনি, সেটা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবেন। 

আগেই যেমনটা বলেছি পাকিস্তানের মধ্যে আফগানিস্তানের যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করার বা সেখানে তালেবানদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কোন আকাঙ্ক্ষাই নেই। আফগান-অভ্যন্তরীণ শান্তি প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে তার জন্য কোন দায় নিতে চায় না পাকিস্তান। 

পাকিস্তান সে কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আরও গভীরভাবে বিনিময়ের অপেক্ষায় থাকবে। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যাতে দায়িত্বশীলতার সাথে যুদ্ধ শেষ করতে পারে, সে জন্য পাকিস্তানের সত্যিকারের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, যাতে যুদ্ধের কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অবশিষ্ট না থাকে। পাকিস্তান চায় না যে সন্ত্রাসবাদের আরেকটি ঢেউ দেশে আঘাত হানুক। 

দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক কারণেও পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেবে। যুক্তরাষ্ট্র এখনও পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় দ্বিপাক্ষিক রফতানি বাজার। পাকিস্তান সেন্ট্রাল ব্যাংকের তথ্য মতে গত অর্থবছর দুই দেশের মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৬.১৬ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৩.৯ বিলিয়ন ডলারই হলো পাকিস্তানের রফতানি। 

পাকিস্তানে যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, এই অবস্থায় আফগানিস্তানে পাকিস্তানের ‘ভূমিকা দুর্বল’ হলে পাকিস্তান বলির পাঁঠা হয়ে যাবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্যের উপরও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। 

পাকিস্তানের কর্মকর্তারা সে কারণে আরও ইতিবাচক ভূমিকার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। পাকিস্তানের কিছু কর্মকর্তা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় যেমনটা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র উদ্ভুত পরিস্থিতিতে – যেখানে নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে এবং ব্যাপকভাবে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়েছে, সে অবস্থায় সম্ভাবনা রয়েছে যে বাইডেন প্রশাসন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোতেই বেশি মনোযোগ দেবে এবং আফগানিস্তানসহ পররাষ্ট্রনীতির ইস্যুগুলো ততটা মনোযোগ দেবে না। 

এ রকম একটা পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো আফগানিস্তানের ভঙ্গুর শান্তি প্রক্রিয়ায় এখন পর্যন্ত যেটা অর্জিত হয়েছে, সেই অর্জনটা জারি রাখা। 

অন্যভাবে বললে যুদ্ধ বন্ধের জন্য পাকিস্তানকে নিজের স্বার্থেই আরও প্রকাশ্য, আরও বাস্তবমুখী ও আরও গতিশীল কৌশল গ্রহণ করতে হবে, যাতে শরণার্থীথের অনুপ্রবেশ ঠেকিয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শক্তিশালী বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রেখে আরেকটা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি এড়ানো যায়। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, পাকিস্তান এটাকে এফএটিএফ কালোতালিকা থেকে স্থায়ীভাবে বেরিয়ে আসার একটা চাবি হিসেবে দেখছে। 

এখানে অনেক কিছুতেই সহায়তা করবে বাইডেনের নিজের আফগান নীতি। এর মধ্যে বড় মাপের সেনা প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানে অবশিষ্ট সেনাদের রেখে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও রয়েছে। এই বিতর্কিত ইস্যু নিয়ে তালেবানদের সাথে দেন দরবারের ক্ষেত্রে বাইডেনের অবশ্যই পাকিস্তানকে প্রয়োজন হবে, যে তালেবানরা সবসময়ই পুরোপুরি মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে এসেছে। 

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com