সু চির একচেটিয়া বিজয়

0

মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনে একচেটিয়া জয় পেতে যাচ্ছে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)। দেশটির গণমাধ্যম মিয়ানমার টাইমসের সর্বশেষ তথ্য, দলটি ৩৯৯টি আসনে জয়লাভ করতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ৩৪৬টি আসনে জয় পেয়েছে। সরকার গঠন করতে তাদের প্রয়োজন ছিল ৩২২ আসন।

সু চির দলের এই বড় জয়ে আবারও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বাংলাদেশের একটি মহল বড় প্রত্যাশা দেখছে; বিশেষ করে সরকারপক্ষ মনে করছে, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সু চি হয়তো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এবার ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবেন। বিগত সময়ের সমালোচনা থেকে হয়তো নিজেকে মুক্ত করবেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা মনে করছেন, করোনা ও মিয়ানমারের নির্বাচনের জন্য ৮-৯ মাস রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা একেবারেই বন্ধ ছিল। এখন আবার প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে। তা ছাড়া চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও চীন সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছে। তাই সরকারের সিদ্ধান্ত সু চির এই নিরঙ্কুশ জয়কে তারা অভিনন্দন জানাবে এবং প্রত্যাবাসন শুরুর ওপর জোর দেবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এম এ মোমেন বলেছেন, সু চির এই জয়ে আমরা আশাবাদী। তাকে স্বাগত ও অভিনন্দন জানানো। এখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে অবশ্যই আলোচনা হবে। এর পাশাপাশি এই সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখা হবে।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সু চির বড় জয়ে প্রত্যাশার জায়গা একটাই। রোহিঙ্গা নিধনে তিনি বিশ^ব্যাপী সমালোচিত হয়েছেন। শান্তিতে নোবেল পাওয়া এই নেতার কাছ থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর যে নিপীড়ন ও নির্যাতন করা হয়েছে সেটি কেউ আশা করে না। তাই ধারণা করা হচ্ছে, সু চি হয়তো নিজের ইমেজের কথা চিন্তা করে একটা ভালো সমাধানে যাবেন। তবে সেটি খুব সহজেই হবে না। আর আশার বিষয় হলো চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের সরকারপ্রধানকে এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে এ ব্যাপারে সহায়তা করার আশ্বাস দিয়েছেন এ বছরের শুরুতেই।

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক ওয়ালি উর রহমান বলেন, কূটনৈতিক শিষ্টাচারের অংশ হিসেবেও সরকারকে অভিননন্দন জানাতে হবে। আর প্রত্যাবাসনের ওপর জোর দিতে হবে। নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে বাংলাদেশের প্রধান ইস্যুই যেন হয় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। জো বাইডেন যদি এ ব্যাপারে চীনের প্রেসিডেন্ট শিকে বলেন মধ্যস্থতা করার জন্য তাহলে আমাদের জন্য অনেক বেশি সুবিধা হয়। তিনি বলেন, সরকারপ্রধান ইতিমধ্যে চীনের প্রেসিডেন্টের কাছে সহায়তা চেয়েছেন। এখন আন্তর্জাতিক মহল যদি সোচ্চার হয় তাহলে সমস্যার সমাধান হবে।

নির্বাচনকে পক্ষপাতদুষ্ট আখ্যা দিয়ে ইতিমধ্যে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে দেশটির সেনাসমর্থিত বিরোধী রাজনৈতিক দল ইউনিয়ন সোলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিসহ (ইউএসডিপি) ১৬টি রাজনৈতিক দল। তারা স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে পুনরায় ভোট গণনার দাবি জানিয়েছে। তবে এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে দেশটির নির্বাচন কমিশন।

নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়ে উৎসবে মেতেছে এনএলডির সমর্থকেরা। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই তারা জড়ো হচ্ছেন পার্টি অফিসের সামনে। সরকার গঠনের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন দলটির নেতারা। একটি সামঞ্জস্য ও ভারসাম্যপূর্ণ দেশ গঠনের জন্য ইতিমধ্যে তারা কাজ শুরু করেছেন। এর অংশ হিসেবে দেশটির জাতিগত ৩৯ দলকে সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠনের চিন্তা করেছে সু চির দল। এর মধ্যে রাখাইন রাজ্যের আঞ্চলিক দলও আছে। দলটির মুখপাত্র মন্যয়া অং সান বিবিসিকে বলেছেন, ‘এটি একটি ভূমিধস’ বিজয়। তবে আমরা একটি ঐকমত্যের সরকার গঠনের জন্য কাজ করছি।

এদিকে নির্বাচনে বিজয় লাভ করলেও স্বস্তিতে নেই সু চির দল। ২০০৮ সালের প্রণীত সংবিধানের ক্ষমতাবলে পার্লামেন্টের চার ভাগের এক ভাগ আসন সেনাবাহিনীর জন্য বরাদ্দকৃত। কয়েকটি মন্ত্রণালয়েও রয়েছেন তারা। এবারের নির্বাচনে এনএলডি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করায় সেনাবাহিনীকে পাশ কাটিয়েই আইন পাস করতে পারবে এনএলডি। এতে সেনাবাহিনীর আধিপত্য অনেকটাই খর্ব হবে। আর এ কারণে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট ইউএসডিপি। অবস্থা এতটাই জটিল যে ৮ নভেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও গতকাল পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ ফলাফল ঘোষণা করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। এ ছাড়া নতুন করে ভোট গণনা না হলে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে ইউএসডিপির নেতৃত্বে ১৬ রাজনৈতিক দল। জনসমর্থনে এই দলগুলো পিছিয়ে থাকলেও সেনাবাহিনীর সমর্থন থাকায় বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখছেন না দেশটির রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করছেন, নতুন সরকার গঠন করতে হলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে রফা করেই সু চিকে ক্ষমতায় বসতে হবে।

দীর্ঘ ৫০ বছরের সামরিক সাশনের অবসানের পর ২০১০ সালে দেশটিতে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে সেনাবাহিনীর মদদে নির্বাচন হচ্ছে দাবি করে ওই নির্বাচন বয়কট করে সু চির দল। ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জয়লাভ করেছিলেন সু চি। তবে ওই নির্বাচনে সেনাবাহিনীর জন্য চার ভাগের এক ভাগ আসন নির্ধারিত। আর সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী কোনোটাই হতে পারেননি সু চি।

৮ নভেম্বর করোনার মধ্যেই দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে আরাকান অঞ্চলের প্রায় ১৫-২৫ লাখ মুসলিম ভোটারকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। এ কারণে এই নির্বাচনকে প্রকাশ্য ত্রুটিপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইট ওয়াচ। আর এই নির্বাচনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হবে বলে মনে করছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস।

সাড়ে ৫ কোটি নাগরিকের দেশটির প্রায় ১২ লাখ বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। মিয়ানমারে মোট ভোটার ৩ কোটি ৬০ লাখের কিছু বেশি। নির্বাচনে মোট ১ হাজার ১৭১টি জাতীয়, রাজ্য ও আঞ্চলিক আসনে ৯০টি দলের ৫ হাজার ৬৪৩ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ভোট গ্রহণের জন্য সারা দেশে ৫০ হাজার ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। দেশটির উচ্চকক্ষে আসনসংখ্যা ২২৪টি এবং নিম্নকক্ষে আসন রয়েছে ৪৪০টি।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমারে দীর্ঘ দিন ধরে সংকট চলছিল। ২০১৫ সালে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করে সু চি ক্ষমতায় আসার পর থেকে আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গাসংকট তীব্র হতে শুরু করে। ২০১৬ সালে দেশটির সেনবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালায়। তখন অনেক রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। ২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর রাখাইন রাজ্যজুড়ে নির্যাতন শুরু করে সেনাবাহিনী। এ সময় তারা ধর্ষণ, হত্যা ও বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। জীবন বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করে। সরকার মানবিক বিবেচনায় তাদের কক্সবাজারে বিভিন্ন ক্যাম্প স্থাপন করে আশ্রয় দেয়। সেই সময়ে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সারা বিশ্ব থেকে নিন্দার ঝড় উঠলেও আমলে নেয়নি সু চির প্রশাসন। প্রতিবাদে অনেক সংস্থা ও সংগঠন সু চিকে দেওয়া সম্মাননা তুলে নেয়। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। এই জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন এখনো অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনায় জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিয়ানমার সরকার ও তার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মামলা চলছে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com