সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনে অবশেষে টনক নড়ল বিশ্বের

0

গত এক যুগ ধরে এমন কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নেই, যা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ দ্বারা সংঘটিত হয়নি। ২০০৮ সালে সেনাবাহিনীর সাজানো নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর প্রথমেই গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরতে নীল নকশা প্রণয়ন করে শেখ হাসিনার সরকার। তাঁবেদার গণমাধ্যমের চাটুকার সাংবাদিকদের আনা হয় হয় সামনের কাতারে। সরকারের চাপে কিছু সাংবাদিক আত্মসমর্পণ করে চুপ হয়ে যান।
বিচারবিভাগকে কুক্ষিগত করে শুরু হয় বিরোধী দলের উপর দমন-পীড়ন।

২০১৩ সালের মে মাসে হেফাজত ইস্যুকে পুঁজি করে বন্ধ করে দেয়া হয় বিরোধীমতের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম। এর আগেই দুই দফা দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়। ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের জুন মাসের প্রথম তারিখে আমার দেশ বন্ধ করে পত্রিকাটির সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পত্রিকা অফিস থেকে। তাঁর উপর চালানো হয়েছিল নিষ্ঠুর নিপীড়ন। আইনি লড়াইয়ে পত্রিকার প্রকাশনা ফিরে পাওয়া গিয়েছিল তখন। কিন্তু ২০১৩ সালে আবারো পত্রিকাটি বেআইনিভাবে বন্ধ করে দেয় ফ্যাসিবাদি সরকার। এরপর থেকে পত্রিকার প্রেস দখলে রেখেছে আওয়ামী তাবেদার পুলিশ।

সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী থেকে শুরু করে ইসলামকে ভালোবাসে এমন অনেক তরুণকে ধরে নিয়ে গুম করা হয়েছে। আর শেখ হাসিনার প্রভুরাষ্ট্র ভারতের বিরুদ্ধে যারাই কথা বলেছে, তাদেরকে হয় গুম করা হয়েছে, না হয় দুর্বৃত্ত দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সবশেষ জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ভারতের স্বার্থ রক্ষার বিরুদ্ধে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ায় বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেছে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের গুণ্ডারা।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে মধ্যরাতের নির্বাচনে সেনাবাহিনী, বিডিআর, র‌্যাব, পুলিশ আর ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুণ্ডাদের দিয়ে ব্যালট বাক্স ভরে এখন হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর মতো জনগণের বুকের উপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে আওয়ামী লীগ।

গত এক যুগ ধরে এমন অনেক অপকর্ম নির্বিচারে করে গেলেও, নিজেদের স্বার্থেই আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেনি ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকার বা আমেরিকাসহ পশ্চিমা কোন রাষ্ট্র।
বাংলাদেশের সুশীল সামাজের প্রতিনিধিত্ব করার দাবিদাররাও গত এক যুগে সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিয়ে অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে চলেছে।
আর মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অবস্থাও গত এক যুগে অত্যন্ত যাচ্ছেতাই দেখা গেছে। সুলতানা কামাল চক্রবর্তী নেতৃত্বাধীন আইন ও সালিশ কেন্দ্র বিএনপির আমলে র‌্যাব ও পুলিশের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে যতো সোচ্চার ছিলেন, আওয়ামী লীগের অন্ধকার সময়ে ততোটাই চুপ রয়েছেন। দুর্নীতিতে আওয়ামী লীগ সরকার পূর্বের সকল রেকর্ড অতিক্রম করলেও দায়সারা প্রতিবেদন প্রকাশ করেই দায়িত্ব শেষ করছে তথাকথিত দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা টিআইবি। তাদের ভূমিকা ঠুঁটো জগন্নাথের মতো।

আমেরিকা বিশ্বব্যাপী তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রসারিত করতে ‘ওয়ার অন টেরর’ এর ছলে গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ইসলামের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে বিভিন্ন সময় সমর্থন যুগিয়েছেন শেখ হাসিনা ও তার সরকার। ফলে এতোদিন আমেরিকার নেক নজরেই ছিলেন শেখ হাসিনা। মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন করলেও শেখ হাসিনার প্রশংসা করতে কার্পণ্য করেনি সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা।
ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকার কৌশলগত বন্ধু ভারতকে দিয়ে বিভিন্ন সময় সরাসরি সহায়তা করে শেখ হাসিনার জুলুমকে টিকিয়ে রেখেছে তারা।

কিন্তু, বিগত কয়েক মাসে বাংলাদেশের সাথে চীনের বন্ধুত্বের হাত বাড়ানোর খবর চাউর হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তি বা ভারতের মতো হিন্দুত্ববাদী অক্ষশক্তি নড়েচড়ে বসেছে। নিজেদের স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটতে পারে আশঙ্কায় এখন তারা আওয়ামী লীগের সাথে নতুন করে দেন-দরবার শুরু করেছে। একই সাথে স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটায় এখন তারা আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদি মুখোশ উন্মোচন করতে শুরু করেছে।
এরই ধারাবাহিকতায় গত মঙ্গলবার বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‌্যাব এর শীর্ষ কমান্ডারদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনে প্রমাণ এনে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের চিঠি দিয়েছেন সিনেট।
শীর্ষ র‌্যাব কমান্ডারদের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও হেফাজতে নির্মম নির্যাতনের তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এ নিষেধাজ্ঞা আরোপের চিঠি লেখেন উভয় দলের প্রভাবশালী ১০জন সদস্য।
দেরিতে হলেও,অবশেষে তাদের ঘুম ভেঙ্গেছে

চিঠিতে বলা হয় ২০১৫ সালের পর থেকে ৪০০ জনেরও বেশি মানুষকে বিনা বিচারে খুন করেছে র‌্যাব।

পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং অর্থমন্ত্রী স্টিভেন নুচিনকে উদ্দেশ্য করে এই চিঠি দেন তারা। চিঠিতে সিনেটররা বলেন যে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ছাড়াও অন্যান্য পন্থায় মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রয়েছে র‌্যাবের বিরুদ্ধে।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব ঘটনা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভিন্নমতের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নেরই অংশ বলে প্রতীয়মান হয়েছে, এবং এসব ক্ষেত্রে র‌্যাবকে কখনও জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়নি।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর র‌্যাবের নেতৃত্বে নতুন করে আবার গুমের ঘটনা শুরু হয়। বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন-সংগ্রাম দমনের নামে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী ফ্যাসিবাদী সরকারকে সুরক্ষা দিতে র‌্যাব কর্তৃক গুম, খুন ও ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের গল্পের আড়ালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নূতন মাত্রা পায়। বিরোধী নেতাদের গুম ও খুনের অভিযোগ রয়েছে অসংখ্য।
দেশে কথিত ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার বা বন্দুকযুদ্ধের গল্পের আড়ালে কী ঘটে এটা এখন সবাই জানেন। র‌্যাবে আসা সেনা সদস্যদের কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে বিরোধী নেতাকর্মীদের খুন এবং গুম করায় উৎসাহিত করতে রাষ্ট্রীয় পদকও দেয়া হয়। গুম, খুনে অনুপ্রেরণা দানকারী রাষ্ট্রীয় পদক প্রাপ্তির জন্য বরং নিজেদের গর্বিত মনে করেন র‌্যাবে আসা সেনা সদস্যরা।

শেখ হাসিনা সরকারের আমলে র‌্যাবের এক সময়ের উপপ্রধান জিয়ার নামটি গুম খুনের জন্য মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ২০১৩ সালে সরকার বিরোধী আন্দোলন দমনে বিরোধী নেতাদের গুম এবং খুনে নেতৃত্ব দেয় র‌্যাব। আর এর মূল দায়িত্ব পালন করেন তখনকার র‌্যাবের উপ-প্রধান জিয়া। মনে করা হত র‌্যাবের জিয়া মানেই গুম খুনের নায়ক, রাষ্ট্রীয় খুনি বাহিনীর কমান্ডার। ২০১০ থেকে এ পর্যন্ত র‌্যাবের নেতৃত্বে বিরোধী দল গুলোর বহু নেতাকর্মীকে গুম করা হয়েছে। যাদের খোঁজ আজো মেলেনি। শেখ হাসিনা সরকারকে টিকিয়ে রাখতে এসব গুম এবং খুনের দায় ঘুরে ফিরে জিয়াদের মত র‌্যাবের নেতৃত্বে আসা সেনাবাহিনীর সদস্যদের উপরই বর্তায়।

২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিএনপির ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচি বানচাল করতে এবং বিরোধী দল নিধনের মূল হাতিয়ার ছিল সেনাবাহিনী থেকে র‌্যাবে আসা জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত ইউনিট। এছাড়া ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিতে রাস্তার বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাতের অন্ধকারে অভিযানও পরিচালিত হয়েছিল ৩ জনের নেতৃত্বে। এর মধ্যে তৎকালীন বিডিআর প্রধান এম এ আজিজ (বর্তমানে সেনাপ্রধান), র‌্যাবের তৎকালীন উপ-প্রধান জিয়া ছিলেন সেনাবাহিনী থেকে আসা। অন্যজন ছিলেন, ঢাকার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার ও বর্তমান আইজি বেনজির আহমদ।

এখানে উল্লেখ্য যে, বেনজির আহমেদ ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারী থেকে ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত র‌্যাবের মহাপরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। র‌্যাবের ডিজি থেকেই বেনজির আহমেদ সরাসরি পুলিশের আইজি হন। বর্তমানে র‌্যাবের মহাপরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল থেকে র‌্যাবের মহাপরিচালক হিসাবে দায়িত্বে রয়েছেন।

গুম হওয়া মানুষদের পরিবার গুলোর সমন্বয়ে ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি সংগঠন তৈরি হয়েছে। মায়ের ডাক সংগঠনের অনেক পরিবার আপনজনদের ধরে নিয়ে গুম করার পেছনে র‌্যাবকে দায়ী করেন। তাদের অনেকেই দাবী করেন র‌্যাবের তৎকালীন উপ-প্রধান জিয়ার নেতৃত্বেই এসব গুম সংগঠিত হয়।

মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, র‌্যাবের শীর্ষ কমান্ডারদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে সিনেটের সদস্যরা দেরিতে সাড়া দিলেও এর ইতিবাচক ফলাফল রয়েছে। তারা বলছেন, ক্রসফায়ার, গুম বা নির্যাতনে শুধু র‌্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তারই নন, পুলিশ বা এসব গুম খুনে জড়িত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের তালিকা করেও তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা দরকার।

সূত্রঃ আমার দেশ

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com