ধানমণ্ডিতে জোড়া খুন: পুলিশকে যা জানালো সুরভী
ঢাকা : ধানমণ্ডিতে জোড়া খুনের মামলায় গ্রেপ্তার সুরভী আক্তার নাহিদা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে বলেছেন, ‘বাসা থেকে বের হতে বাধা দেওয়ায়’ ওই হত্যাকাণ্ড ঘটান তিনি।
তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আব্দুল্লাহেল কাফি বলছেন, সুরভীর বক্তব্য শুনে তার ‘মানসিক ভারসাম্য নিয়ে সন্দেহ’ তৈরি হয়েছে তাদের। সোমবার গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, “মামলাটি গোয়েন্দা পুলিশের কাছে স্থানান্তর করা হয়েছে। তারা সবগুলো দিকই খতিয়ে দেখবে।”
শুক্রবার রাতে ধানমণ্ডির ২৮ নম্বর (নতুন ১৫) রোডের এক ভবনের পঞ্চম তলা থেকে গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান টিমটেক্স গ্রুপের এমডি ও ক্রিয়েটিভ গ্রুপের ডিএমডি কাজী মনির উদ্দিন তারিমের শাশুড়ি আফরোজা বেগম (৬৫) এবং তার গৃহকর্মী দিতির (১৮) রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। তাদের দুজনকেই গলা কেটে হত্যা করা হয়।
আফরোজা ও গৃহকর্মী যে ফ্ল্যাটে থাকতেন, আর তার উল্টো দিকের ফ্ল্যাট এবং তার ঠিক উপরে ছয়তলার ফ্ল্যাট নিয়ে ডুপ্লেক্সে বাসায় স্বামী-সন্তান নিয়ে থাকেন আফরোজার মেয়ে দিলরুবা সুলতানা রুবা।
রুবার স্বামী মনির উদ্দিন তারিম ঘটনার দিন বলেছিলেন, শুক্রবার তার শাশুড়ির বাসায় নতুন এক গৃহকর্মী কাজে এসেছিল। এলাকার এক পানের দোকানদারের মাধ্যমে নতুন ওই গৃহপরিচারিকার খোঁজ এনেছিল তাদের কর্মচারী মো. আতিকুল হক বাচ্চু।
নিরাপত্তাকর্মী বা কর্মচারীদের যোগসাজশে ওই ‘কাজের বুয়াই’ এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে সেদিন সন্দেহ প্রকাশ করেন তারিম। তার স্ত্রীর দায়ের করা মামলায় সেই গৃহকর্মীকে প্রধান আসামি করে কর্মচারী বাচ্চু ও নিরাপত্তাকর্মী নুরুজ্জামান, কেয়ার টেকার বেলায়েত এবং প্রিন্স নামে এক বৈদ্যুতিক মিস্ত্রিকে সন্দেহভাজন হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
এজাহারে বলা হয়, বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে মেয়ের ফ্ল্যাট থেকে গৃহকর্মী দিতিকে নিয়ে আফরোজা নিজের ফ্ল্যাটে যান। সাড়ে ৬টার দিকে ফোনে না পেয়ে রুবা গৃহকর্মী রিয়াজকে খোঁজ নিতে পাঠান। পরে রিয়াজ গিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় আফরোজাকে পড়ে থাকতে দেখেন।
তদন্তে নেমে পুলিশ ওই বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে। সেখানে সন্দেহভাজন সেই গৃহকর্মীকে সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একটি হাতলভাঙা ছুরি পাওয়া যায় ঘরের ভেতরে। আর বাসা থেকে একটু দূরে পাওয়া যায় একজোড়া রক্তমাখা জুতো, যা সেই গৃহকর্মীর বলে সন্দেহ করছিল পুলিশ।
হত্যাকাণ্ডের দুই দিনের মাথায় রোববার সন্ধ্যায় আগারগাঁও বস্তি থেকে ২৩ বছর বয়সী সুরভী আক্তার সুরভীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, তিনিই সেই সন্দেহভাজন গৃহকর্মী।
রোববার রাতভর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় জানিয়ে অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আব্দুল্লাহেল কাফি বলেন, বাচ্চুই যে ওই বাসায় কাজে নিয়ে গিয়েছিল, সে কথা সুরভীও বলেছেন। তবে বাচ্চুর আচরণ তার ‘ভালো লাগেনি’।
“বাচ্চু বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর সুরভীও চলে যেতে চায়। তখনও ওই বাসার পুরনো গৃহকর্মী দিতি বাধা দেয়। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়। তখন সুরভী রান্নাঘর থেকে নেওয়া ছুরি দিয়ে দিতির গলা, পিঠ আর বুকে আঘাত করে বলে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে।
“এরপর সুরভী আরেক ঘরে গিয়ে আফরোজাকে বলে, সে বাসা থেকে চলে যাচ্ছে। আফরোজা তখন জানতে চায়, অন্য ঘরে দিতি চিৎকার করল কেন। সুরভী তখন বলে, সে যেতে চাওয়ায় ঝগড়া হয়েছে। আফরোজাও তখন বলেন-‘ তোকে তো বাচ্চু যেতে না করেছে, তুই এখন যেতে পারবি না।’
“এ সময় সুরভী একই কায়দায় অফরোজাকে ঘাড়ে ছুরি দিয়ে আঘাত করে বলে জিজ্ঞাসাবাদে আমাদের জানিয়েছে। সুরভী বলেছে, সে যখন বেরিয়ে আসে, অফরোজা তখনও মারা যায়নি, তখনও বিছানায় ছিল।”
বাসা থেকে বের হতে না দেওয়াই হত্যার কারণ- এমন বক্তব্য পুলিশের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে করছে কি না জানতে চাওয়া হয়েছিল আব্দুল্লাহেল কাফির কাছে।
তিনি বলেন, “সুরভীকে মানসিক ভারসাম্যহীন মনে হচ্ছে। হঠাৎ এরকম ঘটনা ঘটানোর এটা একটা কারণ হতে পারে।”
ঘটনার দিন পুলিশ জানিয়েছিল, দিতির লাশ পড়েছিল বাসার গেস্ট রুমের মেঝেতে। আর আফরোজার লাশ ছিল তার ঘরে সোফার কাছে। বিছানা ও আশপাশে রক্ত ছিল।
আব্দুল্লাহেল কাফি বলেন, “হয়ত মৃত্যুর আগে ওই বৃদ্ধা বিছানা থেকে নেমে ক্রল করে বাসা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তার আগেই তিনি মারা যান।”
আফরোজার জামাতা তারিম সেদিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, হত্যাকাণ্ডের সময় তার শাশুড়ির বাসা তছনছ করা হয়েছে। টাকা, তিনটি ফোন, সঞ্চয়পত্র, সোনাসহ অনেক মূল্যবান জিনিস খোয়া গেছে। মামলাতেও কোনো পরিমাণ উল্লেখ না করে খোয়া যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছিল।
গ্রেপ্তার সুরভী আক্তার সুরভীর কাছে সেসব কিছু পাওয়া গেছে কি না জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তা কাফি বলেন, “সে বলেছে, ওই বাসা থেকে একটা আইফোন সে নিয়েছিল। চার হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে। সেই টাকার বেশিরভাগটাই খরচ করে ফেলেছে।”
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, ওই হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দিন আগে বাচচুর সঙ্গে সুরভী আক্তার সুরভীর পরিচয় হয়। তাদের মধ্যে মোবাইলে যোগাযোগের সূত্র ধরেই রোববার সন্ধ্যার পর আগারগাঁও এলাকায় ওই নারীর সন্ধান মেলে।
“সুরভীর মোবাইল নম্বর মেলে বাচ্চুর মোবাইল থেকে। এরপর ওই নম্বরের সূত্র ধরে ভোলায় তার পরিবারের সন্ধান পায় পুলিশ। শনিবার পুলিশ ভোলায় গিয়ে খোঁজ নেওয়া শুরু করে। স্বজনদের দিয়ে যোগাযোগ করানো হয় সুরভীর সঙ্গে। আর এদিকে পুলিশ ঢাকার আগারগাঁও বস্তিতে তার অবস্থান শনাক্ত করে।”
ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, বাচ্চু প্রথম থেকে অনেক তথ্য গোপন করেছেন। তিনি বলেছিলেন, সুরভীকে তিনি সেভাবে চিনতেন না। অথচ ঘটনার আগে ও পরে অন্তত অর্ধশতবার তাদের কথা হয়েছে।