আফগানিস্তানে আমেরিকার ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় ঝুলছে

0

মার্কিন-তালেবান শান্তি আলোচনার ভবিষ্যৎ নিয়ে মন্তব্য করতে হলে প্রথমে এটা বোঝা জরুরি যে, আফগানিস্তানে ১৯ বছরের দীর্ঘ যুদ্ধে আমেরিকা কেন ব্যর্থ হলো। একই সাথে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি সেখানে সক্রিয় আঞ্চলিক ও স্থানীয় খেলোয়াদের প্রতিযোগিতাপূর্ণ স্বার্থের দিকে নজর দেয়াটাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

২০০১ সালে, প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র আর তার মিত্র দেশগুলোর চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল ওসামা বিন লাদেনকে পরাজিত করে আল কায়েদাকে বিলুপ্ত করা। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় জাতি গঠন ও রাষ্ট্র গঠনকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছিল, এবং বর্তমানে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অধীনে আলোচনা চালিয়ে নেয়ার পেছনে শান্তি আর স্থিতিশীলতাই যেন মূল মন্ত্র হিসেবে কাজ করছে।

চূড়ান্ত লক্ষ্যের ব্যাপারে এই স্বচ্ছতার অভাব, সেই সাথে একের পর এক মার্কিন সরকারগুলোর অভ্যন্তরীণ কর্মকৌশলের ব্যর্থতা, এই সবকিছুই সেখানে আজকের পরিস্থিতির জন্য দায়ি। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের সামগ্রিক সংস্কৃতি বুঝতে এবং বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে জাতি পরিচয় আর ধর্ম কিভাবে পরস্পরের সাথে যুক্ত সেটাও তারা বোঝেনি, এবং মাঠের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশীদার পাকিস্তানকে তারা সন্দেহ করেছে। অংশীদারের জাতীয় স্বার্থকে বিবেচনায় না নিয়ে, বল প্রয়োগের কৌশল ব্যবহার করেছে তারা। আর ২০১৭ সালে ওয়াশিংটন যখন ব্যর্থতা আর বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে, তখন ইসলামাবাদকে তারা বলির পাঁঠা বানিয়েছে।

কিন্তু আজ পাকিস্তানের সাথে একই অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এখন তারা বলছে যে, একমাত্র রাজনৈতিক সমঝোতাই সব পক্ষের জন্য একটা ইতিবাচক ভবিষ্যৎ তৈরি করতে পারে। এর পর কি হবে, সেটা বেশ কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করছে। সেনা প্রত্যাহারের পর যুক্তরাষ্ট্র আর তার আন্তর্জাতিক অংশীদারেরা কি আফগানিস্তানকে আর্থিত সহায়তা দেয়া অব্যাহত রাখবে? কারণ, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দরিদ্র দেশ এটা। না কি, সেই সোভিয়েত আমলের মতো এলোমেলোভাবে সেনা প্রত্যাহার করা হবে, যার পরে দেশে বহু বছর গৃহযুদ্ধ বজায় ছিল এবং একপর্যায়ে তালেবানদের উত্থান ঘটে। সেটা যদি হয়, তাহলে আফগানিস্তানের সেনাবাহিনী ভেঙ্গে পড়বে এবং সকল যুদ্ধরত পক্ষগুলোর তালেবানদের হাতে পতন হবে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসনের অধীনে মনে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চল ছেড়ে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। এবং একমাত্র এই কারণেই চীন, পাকিস্তান, রাশিয়া ও ইরানের মতো আঞ্চলিক খেলোয়াড়কে এখানে সহযোগিতা করছে। ভারতও এখানে বৃহত্তর আঞ্চলিক খেলোয়াড় হিসেবে প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে চায়, এবং সেটাই যৌক্তিক। ইসলামাবাদের দিক থেকে এটা একটা সন্দেহজনক বিষয়, কারণ মোদি সরকার খোলামেলা ঘোষণা দিয়েছে যে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তারা সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করবে।

এই সবকিছুর প্রেক্ষিতে, বর্তমান ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিকতায় তিনটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। প্রথমত, মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর সবগুলো জাতিগত অংশ এবং যুদ্ধরত পক্ষগুলোর মধ্যে এক ধরণের ঐক্যমত তৈরি হতে পারে এবং তারা সম্মিলিতভাবে একটা সংবিধান গ্রহণ করতে পারে, এবং সেখান থেকে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ পরিবাহিত হবে। দ্বিতীয়ত, তালেবানরা শান্তি আলোচনায় আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে। তারা এই প্রক্রিয়ায় ধৈর্য ধরে আছে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে সেনা প্রত্যাহারে তারাই রাজি করিয়েছে। যে দিক থেকেই দেখা যাক, আফগানিস্তানকে তারা নিজেদের মনে করছে।

আর সবশেষে, বাস্তববাদী ও যৌক্তিক মানুষেরা যেটার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি দেখছেন, সেটা হলো আংশিক মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের প্রেক্ষিতে জাতিগত বিভিন্ন অংশগুলো নিজেদের মধ্যে লড়াই অব্যাহত রাখবে, যতক্ষণ না তালেবানরা তাদের অবস্থান সংহত কে এবং নিজেদের মতো করে সরকার গঠন করে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে কোন অর্থায়ন না থাকায় আফগান সেনাবাহিনী ভেঙে পড়বে। কিন্তু সাম্প্রতিক দুটো বিষয় এর উপর প্রভাব ফেলতে পারে: সেনাদের দেশে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অভ্যন্তরীণ চাপ বৃদ্ধি, এবং বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারীর প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক শক্তি হ্রাস। এই বিষয়গুলোর কারণে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র আর তার মিত্রদের অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তার ধারা সম্ভবত অব্যাহত থাকবে।

পুরো সেনা প্রত্যাহার মনে হয় যেন সম্ভব হবে না। কেউই এ রকম একটা চরম মুহূর্তে এসে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চল ছেড়ে যেতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক ঘাঁটি এবং কিছু সেনা মোতায়েন রাখার মাধ্যমে দিক নির্দেশনার একটা পথ খোলা রাখবে। এখান থেকে তারা ইরানের উপর, এমনকি চীনের উপরও নজর রাখতে পারবে, আবার একই সাথে আইসিসের পরবর্তী তৎপরতার জায়গাতেও উপস্থিত থাকতে পারবে। রাজনৈতিক সমঝোতা হলে হুমকি আর সহিংসতার মাত্রা কমে আসতে পারে, কিন্তু সেটা শেষ হবে না। আফগানিস্তানে যে বিশাল মাদক আর মানব পাচারের নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে, সেটার প্রভাবকেও অবহেলা করা যাবে না। সবগুলো পক্ষই তাদের সমর্থন অর্জনের চেষ্টা করবে। চূড়ান্ত ফল যাই হোক না কেন, আমাদের প্রত্যাশা থাকা উচিত যাতে সেটা আফগানদের নেতৃত্বে এবং আফগানদের কর্তৃত্বের অধীনে হয়, কারণ একমাত্র সেটাই দীর্ঘস্থায়ী শান্তি আর স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা দিতে পারবে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com