সাড়ে চার বছরে ৪৫০০ ধর্ষণ

0

উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে ধর্ষণের ঘটনা। মহামারি করোনার মধ্যেও কমেনি ধর্ষণ। দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটছে একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। এই তো শুক্রবারে সিলেটের এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে এক নারীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। তার আগে স্বামীর জন্য রক্ত যোগাড় করতে গিয়ে আরেক নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তার আরো কিছুদিন আগে খাগড়াছড়িতে মা-বাবাকে ঘরে বেঁধে রেখে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী এক মেয়েকে ধর্ষণ করেছে দুর্র্বৃত্তরা।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেয়া তথ্যমতে, গত সাড়ে চার বছরে প্রায় সাড়ে চার হাজার নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আর চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত সারা দেশে ৮৮৯টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।

চলতি মাসে দেশব্যাপী চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে এমন কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা রয়েছে। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, নীতি নৈতিকতার অভাব, মাদকের কুফল, আইনের শাসনের যথাযথ প্রয়োগ, বিচারহীনতা, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এ ধরনের কুৎসিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত সারা দেশে ৮৮৯টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে জানুয়ারি মাসে সারা দেশে হয়েছে ৯৮টি ধর্ষণ। আর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে হয়েছে ২৫৭টি। এ ছাড়া এপ্রিল মাসে হয়েছে ৭৬টি, মে মাসে ৯৪টি। জুন মাসে সেই হিসাব বেড়ে হয়েছে ১৭৪টি। জুলাই মাসে ১৪০টি ও আগস্ট মাসে ১৪৮টি। আসকের তথ্যমতে ২০১৬ সালে সারা দেশে ৬৫৯টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে একক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৪৪টি। গণধর্ষণ হয়েছে ১৯৭টি। এর বাইরে ধর্ষণের ধরন জানা যায়নি এমন ঘটনা ঘটেছে আরো ১৮টি। এসব ঘটনায় ৩৭ জন নারী-শিশুকে হত্যা করা হয়েছে এবং ধর্ষণের অপবাদ সইতে না পেরে ৮টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। একই বছর ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে আরো ৬৫ জন নারীকে। বছরজুড়ে দেশের বিভিন্ন থানা ও আদালতে এসব ঘটনায় ৩৯৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ২০১৭ সালে সারা দেশে ৮১৮ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে একক ধর্ষণ ৫৯০টি ও ২০৬ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের ধরন জানা যায়নি এমন আরো ২২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ওই বছর ধর্ষণের পরে ৪৭ জনকে হত্যা করা হয়েছে। আত্মহত্যা করেছেন ১১ জন। একই বছর ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে আরো ১০৪ জনকে। এসব ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের হয়েছে ৫১৭টি। ২০১৮ সালে সারা দেশে ৭৩২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে একক ধর্ষণ হয়েছে ৫০২টি। গণধর্ষণ হয়েছে ২০৩টি। আর ধর্ষণের ধরন জানা যায়নি এমন আরো ২৭টি ঘটনা ঘটেছে। একই বছর ১০৩ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা করা হয়েছে ৬৩ জনকে। এ ছাড়া ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন আরো ৭ জন। এসব ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে ৫০৯টি। তবে ২০১৯ সালে সারা দেশে রেকর্ড ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ওই বছর সারা দেশে ১ হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে একক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৬৬টি। ৩২৭টি গণধর্ষণ হয়েছে। ধর্ষণের কারণ জানা যায়নি এমন আরো ২০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। একই বছর ২২৪ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে। আত্মহত্যা করেছেন ১০ জন। এসব ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে ৯৯৯টি।

শুক্রবার সিলেটের এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক নারী। তার স্বামীকে গাড়িতে আটকে রেখে কলেজ ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের একটি কক্ষের সামনে ওই নারীকে গণধর্ষণ করা হয়। কলেজ ক্যাম্পাসে এ ধরনের ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড় ও নিন্দার ঝড় বইছে। অভিযোগ উঠেছে, ওই কক্ষে থাকা ছাত্রলীগের একটি পক্ষের ৬-৭ জন কর্মী এ ঘটনা ঘটায়। ঘটনার পরপরই ভুক্তভোগী ওই নারী বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন।

২৩শে সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত ৩টার দিকে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের গোলাবাড়ি ইউনিয়ন এলাকায় ঘরে প্রবেশ করে চাকমা সম্প্রদায়ের এক বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়েকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। মুখে মাস্ক পরে দরজা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে পরিবারের সবাইকে বেঁধে ওই মেয়ের ওপর নির্যাতন চালায় দুর্বৃত্তরা। নয় জন মিলে অসহায় এই মেয়েকে ধর্ষণের পর তারা ওই বাড়ির নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কারসহ আরো অনেক কিছু লুটে নিয়ে যায়। ঘটনার পর পুলিশ অভিযান চালিয়ে এ পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে।

১৬ই সেপ্টেম্বর মুমূর্ষু স্বামীকে বাঁচাতে রক্ত আনতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক নারী। সাতক্ষীরা থেকে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে এনে চিকিৎসা করাচ্ছিলেন ওই নারী। মিরপুরের মণিপুরীপাড়ার শিফা ভিলার মাশনু আরা বেগম শিল্পীর বাসায় নিয়ে তাকে মনোয়ার হোসেন সজীব নামের এক ব্যক্তি ধর্ষণ করেছে। পরে ভুক্তভোগীর স্বামীর এমন অভিযোগের ভিত্তিতে সজীবকে ও ধর্ষণে সহযোগিতা করার অভিযোগে এক নারীকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ৭ই সেপ্টেম্বর রাতে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার কাদিরজঙ্গল ইউনিয়নের সাঁতারপুর গ্রামের এক রিকশা চালকের ছয় বছরের শিশুকন্যাকে মা-বাবার সঙ্গে ঘুমন্ত অবস্থায় ঘরে সিঁদ কেটে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছে এক দুর্র্বৃত্ত। ধর্ষণের পরে শিশুটিকে তার বাড়ির পাশের একটি ধানক্ষেতে ফেলে যায় ধর্ষক।

করোনাকালেও দেশব্যাপী চাঞ্চল্যকর ধর্ষণের ঘটনায় মানবাধিকার সংগঠনগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সংগঠনগুলো জানিয়েছে, দেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নেই। ধর্ষণের ঘটনায় মামলা থেকে শুরু করে তদন্ত, বিচার সবখানেই নারীকে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে অনেক সময় ভুক্তভোগী বাদীকে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। অন্যদিকে ধর্ষক যদি প্রভাবশালী হয় তাহলে ভুক্তভোগীকে উল্টো নানান চাপের মধ্যে থাকতে হয়। ফলে একসময় বাধ্য হয়ে বাদী- বিবাদীর সঙ্গে আপোষ করে মামলা তুলে নেয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারা দেশে যে সংখ্যক ধর্ষণের ঘটনা ঘটে সেই তুলনায় মামলার ঘটনা নিতান্তই কম। যখন ধর্ষণের ঘটনা ঘটে তখন ধর্ষকের পক্ষে প্রভাবশালীরা বলপ্রয়োগ করেন। এক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর পরিবার যদি কম শক্তিশালী হয় তবে ধর্ষকের সঙ্গে আইনি লড়াই করাটা কঠিন হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত স্থানীয় থানা পুলিশের মাধ্যমে ভুক্তভোগীর সঙ্গে আপোষ করে নেয় ধর্ষক। আবার সম্প্রতি ধর্ষকের সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ে দেয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। একাধিক ভুক্তভোগীর সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, ধর্ষণের ঘটনা ঘটার পর এমনিতেই তার পরিবার, আত্মীয়-স্বজনরা মানসিক বিপর্যস্ত থাকেন। তার ওপর সামাজিকভাবে ধর্ষিতার পরিবারকে হেয় করতে দেখা যায়। থানায় মামলা করলে তার তদন্তের জন্য পুলিশি জেরা, দফায় দফায় পরীক্ষাসহ ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, সাক্ষী যোগাড় করা, আদালতে হাজিরা, আদালতে উদ্ভট পরিস্থিতির সম্মুখীন সব মিলিয়ে একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। দৈনন্দিন অন্যান্য কাজকর্ম রেখে মামলার পেছনে ছুটতে হয়। ভুক্তভোগীর পরিবার আর্থিকভাবে দুর্বল হলে মামলা চালানোর টাকার বিষয়টিও সামনে উঠে আসে। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষণ মামলা একটা পর্যায়ে গিয়ে থেমে যায়।

এদিকে, ধর্ষণ মামলার চার্জশিট জমা দেয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করতে হয়। এরই প্রেক্ষিতে মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা মেডিকেল টেস্টসহ, ভুক্তভোগীর জবানবন্দিসহ অন্যান্য কার্যক্রম শেষ করেই আদালতে চার্জশিট জমা দেন। কিন্তু বিচারকার্য শুরু হওয়ার পর অনেক মামলাই আদালতে টিকে না। এক্ষেত্রে অনেক সময় মামলার তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠে।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পুলিশের হাইকমান্ড থেকে ধর্ষণ মামলার তদন্ত গুরুত্বসহকারে দ্রুত সময়ে শেষ করার তাগিদ রয়েছে। কিন্তু মামলার তদন্ত শুরু হলে বাদীই একসময় নানা কারণে তদন্তে অসহযোগিতা ও মামলা নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত নেন।

সমাজ বিজ্ঞানী নেহাল বলেন, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয়ের জন্য ধর্ষণ ও গণধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে। অনেক বাবা-মা-ই স্বল্প শিক্ষিত। তারা যদিও সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত হতে ও ধর্মীয় শিক্ষা দেয় তবে নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা দেয় না। ফলে দেশে দিন দিন এমন ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, যদি আইনের শাসনের যথাযথ প্রয়োগ ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত না হয় তবে আগামী ২০ বছরে এমন সমস্যার সমাধান হবে না।

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়ার কারণে ছাত্ররা অপরাধ করেও আইনের ঊর্ধ্বে। সেজন্যই সম্ভবত তাদের মধ্যে ধারণা জন্মেছে যে, অপরাধ করলে তাদেরকে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে না। সম্প্রতি ক্যাসিনো, পাপিয়া, শাহেদসহ কয়েকটি ঘটনায় সরকারের সঙ্গে জড়িতরা আইনের মুখোমুখি হচ্ছে। কিন্তু তাদের সংখ্যা এত নগণ্য ও হাতেগোনা যে, সেটি অন্যদের বেলায় প্রভাব পড়ছে না।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com