যেভাবে অপরাধীদের অবৈধ লেনদেনের সুযোগ করে দিয়েছে শীর্ষ ব্যাংকগুলো
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেশ কয়েকটি বৈশ্বিক আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস হয়েছে। এবার সে ধারাবাহিকতায় ফাঁস হলো ‘ফিনসেন ফাইলস’। বিশ্বজুড়ে চলতি শতকের প্রথম ১৭ বছরে বিভিন্ন পৃষ্ঠা ২ কলাম ১
ব্যাংকে ২ লাখ কোটি ডলারের বেশি সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনের তথ্য রয়েছে ফাঁস হওয়া নথিপত্রগুলোয়। এতে দেখা গেছে, এইচএসবিসি, বার্কলেস, জেপি মরগ্যান, ডয়েচে ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডসহ বিশ্বের পরিচিত ব্যাংকগুলো কীভাবে অপরাধীদের টাকা লেনদেনে সহায়তা করেছে। ফাঁস হওয়া নথিপত্রগুলো অনুসারে, এমন সন্দেহভাজন লেনদেন হয়েছে বাংলাদেশের একাধিক ব্যাংক থেকেও। এমন অন্তত আটটি লেনদেনের কথা প্রকাশ পেয়েছে। এ খবর দিয়েছে ডয়েচে ভেলে ও বিবিসি।
খবরে বলা হয়, ফিনসেন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইমস এনফোর্সমেন্ট নেটওয়ার্ক। মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের এই বিভাগটি আর্থিক অপরাধ মোকাবিলা করে থাকে।
মার্কিন ডলারে করা সন্দেহভাজন লেনদেনগুলো সম্পর্কে তাদের কাছে রিপোর্ট জমা দেয় বিশ্বজুড়ে ব্যাংকগুলো। ফিনসেন ফাইলগুলো হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে তেমন ২ লাখ কোটি ডলার আর্থিক লেনদেনের ২ হাজার ৫০০’র বেশি নথিপত্র। এসব নথিপত্রের বেশির ভাগই ব্যাংকগুলো তাদের লেনদেনে কোনো অনিয়ম হয়েছে কিনা তা যাচাই করতে ২০০০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছিল। এসব নথিপত্র ব্যাংকগুলোর অত্যন্ত গোপন নথিপত্র। নথিপত্রগুলোর কেন্দ্রে রয়েছে ২ হাজার ১০০ ‘সাসপিসিয়াস অ্যাকটিভিটি রিপোর্টস’ বা এসআরএস। ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের সন্দেহভাজন কর্মকাণ্ড রিপোর্ট করতে এসব নথিপত্র ব্যবহার করে থাকে। তবে এগুলো অপরাধ বা নিয়ম লঙ্ঘনের কোনো প্রমাণ নয়। তবে এগুলোয় দেখা গেছে, কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কিছু ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়েছে। ফাঁস হওয়া নথিপত্রগুলো প্রথম প্রকাশ করে বাজফিড নিউজ। তা শেয়ার করা হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে)-এ। ৮৮টি দেশের ১০৮টি সংবাদ বিষয়ক সংস্থা এই সংগঠনটির সদস্য।
বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর ৮ লেনদেন:
ফাঁস হওয়া নথিপত্রগুলো উদ্ধৃত করে ডয়েচে ভেলে জানায়, ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে অন্তত ৮ লাখ ৩২ হাজার ডলারের সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে। এমন আটটি লেনদেনের বিষয়ে ফিনসেনকে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল ব্যাংকগুলো। লেনদেনের মধ্যে বাইরে থেকে দেশের ব্যাংকগুলোয় এসেছে ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৩ ডলার।
ডয়েচে ভেলে আরো জানায়, অন্যদিকে, চারটি পৃথক লেনদেনে বাংলাদেশের একটি রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাংক থেকে জার্মানির ডয়েচে ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে ৪ লাখ ৯৫ হাজার ডলার স্থানান্তর হয়েছিল। এই লেনদেনটি সম্পন্ন হয়েছে ২০১৬ সালের ১৫ ও ২২শে সেপ্টেম্বর। এই সম্পর্কেও ফিনসেনের কাছে রিপোর্ট করেছিল স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড।
লন্ডনের বারক্লেস ব্যাংকের মাধ্যমে যেভাবে অর্থ পাচার করেন পুতিনের বন্ধু
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও বাল্যকালের বন্ধু বিলিয়নিয়ার আরকাদি রোটেনবার্গের বিরুদ্ধে অবরোধ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি সেই অবরোধকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে লন্ডনের বারক্লেস ব্যাংকের মাধ্যমে কোটি ডলার পাচার করেছেন। ফাঁস হওয়া নথিপত্র অনুসারে, ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। এর অর্থ হলো, পশ্চিমা কোনো ব্যাংক যদি তার সঙ্গে ব্যবসা করা নিষিদ্ধ। কিন্তু বারক্লেস ব্যাংক সেই নিয়মকে উপেক্ষা করে তাকে লাখ লাখ ডলার পাচারে সহায়তা করেছে। বারক্লেস ব্যাংক বলেছে, তারা আইন এবং নিয়ন্ত্রণমূলক দায়িত্ব বজায় রেখে কাজ করেছে।
ফিনসেন্ট নথি অনুসারে, ২০০৮ সালে বারক্লেস ব্যাংক এডভানটেজ এলায়েন্স নামে একটি কোম্পানির নামে অ্যাকাউন্ট খোলে। এই কোম্পানিটি ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে সরিয়ে নিয়েছে ৬ কোটি পাউন্ড। ২০১৬ সালে বারক্লেস ব্যাংকের সন্দেহ হয় রোটেনবার্গসের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নিয়ে। এই বছরই এক তদন্তের পর সন্দেহজনক উপায়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের জন্য ওই ব্যাংকটি এডভানটেজ এলায়েন্টের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ফাঁস হওয়া এসএআর অনুসারে, রোটেনবার্গসদের সঙ্গে সন্দেহজনক সম্পর্ক আছে এমন বেশ কিছু অ্যাকাউন্ট ২০১৭ সাল পর্যন্ত সচল ছিল।
প্রতারকদের লাখ লাখ ডলার স্থানান্তরে অনুমোদন দিয়েছে এইচএসবিসি
জানা সত্ত্বেও প্রতারকদের লাখ লাখ ডলার বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তরে অনুমোদন দিয়েছে এইচএসবিসি। ফাঁস হওয়া ফাইলে এসব তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়েছে। এতে বলা হয়েছে, বৃটেনের সবচেয়ে বড় ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার মাধ্যমে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে হংকংয়ে এইচএসবিসি অ্যাকাউন্টে সরিয়ে নিয়েছে ওই অর্থ। ফাঁস হওয়া এক নথিপত্রে দেখা গেছে, এভাবে ৮ কোটি ডলার প্রতারণায় ভূমিকা আছে তাদের। এইচএসবিসি বলেছে, এমন সব কর্মকাণ্ডের বিষয়ে রিপোর্টিংয়ে সব সময়ই তারা আইনগত দায়িত্ব পালন করে এসেছে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি। ফাঁস হওয়া ফাইলে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে এই ব্যাংককে অর্থপাচারের জন্য ১৯০ কোটি ডলার জরিমানা করার পর পরই পোঞ্জি স্কিম হিসেবে পরিচিত বিনিয়োগ শুরু হয় ।
ইরানকে অবরোধ এড়াতে সহায়তা করেছে আমিরাতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক
অর্থ পাচার কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে গেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সতর্কতা দেয়া হয়েছিল সেখানে। বলা হয়েছিল, সেই প্রতিষ্ঠানটি ইরানকে অবরোধ এড়াতে সহায়তা করছে। এ জন্য ওই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। কিন্তু আমিরাতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
ফিনসেন নথি অনুসারে, ২০১১ ও ২০১২ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আর্থিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সন্দেহজনকভাবে ১৪ কোটি ২০ লাখ ডলার পাচার করে দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গানেস জেনারেল ট্রেডিং। বিষয়টি আঁচ করতে সক্ষম হয় বৃটিশ একটি ব্যাংক। কিন্তু স্থানীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অব্যাহতভাবে ব্যবহার করে অর্থ পাচার চালিয়ে যেতে সক্ষম হয় ওই প্রতিষ্ঠানটি।
গত কয়েক দশক ধরে ইরানের বহু নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এসব পদক্ষেপের মধ্যে ইরানের ব্যাংকিং খাতকে টার্গেট করা হয়। মার্কিন প্রসিকিউটররা অভিযোগ করেন যে, গানেস জেনারেল ট্রেডিং হলো তুরস্ক বংশোদ্ভূত স্বর্ণ ব্যবসায়ী রেজা জারাবের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি নেটওয়ার্কের অংশ। এই কোম্পানি ইরান সরকার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কোটি কোটি ডলার স্থানান্তর করছে। যুক্তরাষ্ট্রে জারাবকে গ্রেপ্তারের পর ওই কোম্পানির কর্মকাণ্ড নিয়ে আর কোনো উদ্বেগ দেখা দেয়নি। ২০১৭ সালে রেজা জারাব জালিয়াতি, ষড়যন্ত্র ও অর্থ পাচারের অভিযোগ স্বীকার করেন।
এ ছাড়াও, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর বহু ব্যাংকের সন্দেহভাজন লেনদেনের কথাও উঠেছে ফাঁস হওয়া নথিগুলোয়। এতে দেখা যায়, মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগ্যান এক প্রতিষ্ঠানকে লন্ডনের একটি অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ১০০ কোটি ডলার সরিয়ে নেয়ার অনুমোদন দিয়েছে। যদিও জেপি মরগ্যান জানতো না, লন্ডনের ওই অ্যাকাউন্টটির মালিক কে। পরবর্তীতে জানা যায়, অ্যাকাউন্টটির মালিক এফবিআইয়ের শীর্ষ ১০ অপরাধীর একজন হতে পারে।
যুক্তরাজ্যের ৩ হাজারের বেশি কোমপানির নাম উঠে এসেছে ফিনসেন নথিগুলোয়। অন্যকোনো দেশের এতসংখ্যক সন্দেহভাজন লেনদেনের নাম ওঠেনি। দেশটিকে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সাইপ্রাসের সঙ্গে তুলনা করেছে ফিনসেনের গোয়েন্দা বিভাগ। দেশটির এক ব্যক্তি ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টিকে ১৭ লাখ পাউন্ড অনুদান দিয়েছিল। গোপন নথি অনুসারে, ওই ব্যক্তিকে গোপনে অর্থ দিচ্ছিল রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের ঘনিষ্ঠ এক সহযোগী।
এছাড়া, জার্মানির ডয়েচে ব্যাংক মাদক পাচারকারী, সন্ত্রাসী সংঘটিত অপরাধ সংগঠনের কালো টাকা হস্তান্তরে সহায়তা করার প্রতিবেদনও ওঠে এসেছে ফিনসেন ফাইলসে।
ফিনসেন ফাইলসের গুরুত্ব
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেশকিছু আর্থিক কেলেঙ্কারির খবর ফাঁস হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, পানামা পেপারস, প্যারাডাইজ পেপারস, সুইস লিকস ইত্যাদি। কিন্তু ফিনসেন নথিগুলো সেগুলোর চেয়ে কিছুটা আলাদা। এর ভিন্ন গুরুত্ব রয়েছে। কেননা, এটি কোনো একক প্রতিষ্ঠানের কেলেঙ্কারি নয়। বিশ্বের অসংখ্য দেশের ব্যাংক থেকে সন্দেহভাজন লেনদেনের নথি ফাঁসের ঘটনা এটি। এতে প্রশ্ন জাগে, ব্যাংকগুলো সন্দেহভাজন লেনদেন চিহ্নিত করার পরও সেগুলো নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কেন? এসআরএস জমা দেয়া কোনো যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নয়। তবে কোনো ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে এমন প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর, ওই লেনদেন চালু রাখলেও তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়া বেশ কঠিন। যদিও আইন অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর জানা উচিত যে, তাদের গ্রাহক কারা। এসব নিয়ে যাচাই করতে গিয়ে যদি কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের প্রমাণ ধরা পড়ে তাহলে তাদের উচিত অর্থ চলাচল বন্ধ করে দেয়া।