দুঃসময়ে বাজারেও স্বস্তি নেই

0

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে সরকারি জমিতে গড়ে ওঠা বস্তিতে পরিবারসহ বাস করেন মালা বেগম। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে বাসার সামনের রাস্তায় ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতার কাছ থেকে পেঁয়াজ কিনছিলেন তিনি। গত সপ্তাহে ভারতীয় পেঁয়াজের প্রতি কেজির দাম ছিল ৩০ টাকা। এখন সেটা ৩৫ টাকা।

‘আমরা দুজন পাঁচ মাস ধরে ঘরে বসা’—আলাপের শুরুতেই জানালেন মালা বেগম, যিনি করোনাকালের আগে তিনটি বাসায় খণ্ডকালীন গৃহকর্মীর কাজ করতেন। আয় ছিল মাসে ৯ হাজার টাকা। দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে যেদিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা হলো (২৬ মার্চ), সেদিন থেকে তিনি বেকার। দূরপাল্লার বাসের চালক স্বামীরও এত দিন কাজ ছিল না।

মালা বেগম বললেন, সংসারের খরচ থেকে একটু একটু বাঁচিয়ে ৭০ হাজার টাকা জমিয়েছিলেন। করোনায় সব শেষ। কয়েক দিন আগে দুই হাজার টাকা বেতনে এক বাসায় খণ্ডকালীন গৃহকর্মীর কাজ পেয়েছেন। এ জন্য আগারগাঁও থেকে মণিপুরীপাড়া পর্যন্ত হেঁটে যান। বাসে যান না কেন? মালার জবাব, ‘এত ভাড়া দিয়ে বাসে চললে খাব কী?’বিজ্ঞাপন

মালা নিজেই বাজার করেন। জানালেন, তাঁর সংসারে যা নিয়মিত কিনতে হয়, সবকিছুর দামই বেশি। যা এখনকার কোনোরকমে বেঁচে থাকার সময়ে তাঁর সংসারের খরচ অনেকটাই বাড়িয়েছে।

মালা বেগমের কথা যে সত্যি, তা বাজারে গেলেই টের পাওয়া যায়। এখন চালের দাম চড়া। ভোজ্যতেলের কোম্পানিগুলো প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ৩–৪ টাকা বাড়িয়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষের অ্যাংকর ডালের দাম প্রতি কেজি ৫ টাকা বেড়েছে। বেশির ভাগের সবজির কেজি ৫০ থেকে ৭০ টাকা। ডিমের দাম কোনোভাবেই কমছে না। প্রতি ডজন ১১০ টাকা। দাম কম কেবল ব্রয়লার মুরগির। কিন্তু মুরগি রান্না করতে আদা কিনতে হবে প্রতি কেজি ১৮০ থেকে ২৪০ টাকা দরে, যা ঈদুল আজহার আগেও ১৪০ টাকার মধ্যে ছিল।

নিম্ন আয়ের মানুষেরা কেনাকাটা করেন, এমন দুটি বাজার (শেওড়াপাড়ার অলি মিয়ার টেক ও পশ্চিম আগারগাঁও কাঁচাবাজার) ঘুরে দেখা যায়, মোটা চালের সর্বনিম্ন দাম প্রতি কেজি ৪৩ টাকা। এই চাল আবার অনেক পুরোনো ও একটু গন্ধযুক্ত। ভালো মানের মোটা চাল কিনতে লাগছে প্রতি কেজি ৪৬ টাকা। যা সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে এক বছর আগের তুলনায় দাম ২৮ শতাংশ বেশি।

স্বস্তি নেই মাঝারি মানের বিআর–২৮ ও সরু মিনিকেট চালের দামেও। মাঝারি মানের বিভিন্ন চাল কিনতে প্রতি কেজি ৪৮ থেকে ৫৩ টাকা লাগছে। আর সরু মিনিকেট চালের কেজি বাজারভেদে ৫৬ থেকে ৬০ টাকা। টিসিবির হিসাবে, গত বছরের এ সময়ের তুলনায় এখন মাঝারি মানের চালের দাম ৯ শতাংশ ও সরু চালের দাম ১৫ শতাংশ বেশি।

বাজারে দাম যখন বাড়তি, তখন মানুষের আয় পরিস্থিতি খারাপ। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এবং ওয়াল্টার এলিজা হল ইনস্টিটিউট, অস্ট্রেলিয়ার এক যৌথ গবেষণা বলছে, করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে ঘরে থাকার নির্দেশনার সময়কালে ৯৬ শতাংশ পরিবারের গড় আয় কমেছে।

ওই সময় আয় কমে যাওয়া মানুষদের একজন পীরেরবাগের আফসানা সুজের বিক্রয়কর্মী আলামিন হোসেন। ওই সময় দুই মাস বেতন না পেয়ে যে ঋণ হয়েছিল, এখন বাজারে ব্যয় সাশ্রয় করে তা শোধ করছেন তিনি।

আলামিনের কৌশলটি খুব সাধারণ। সেটি হলো, ইচ্ছেমতো মাছ-মাংস কেনা বন্ধ রাখা। বললেন, ‘ধরেন আগে চিংড়ি কিনতাম, এখন তেলাপিয়া কিনি। বেশির ভাগ দিনই শাকসবজি ও ভর্তা দিয়ে খেয়ে নিই।’

খরচ বাড়ার আরও খাত

একটি কোম্পানির বিপণনকর্মী আসাদুজ্জামানকে প্রতিদিন মিরপুর থেকে ধানমন্ডি যেতে হয়। করোনাকালের আগে বাসভাড়া ছিল ২৫ টাকা। এখন সেটা ৪০ টাকা। দিনে তাঁর যাতায়াত খরচ বেড়েছে ৩০ টাকা, মাসে ৭৮০ টাকা। যা তাঁর বেতনের সাড়ে ৬ শতাংশ।

বাড়তি ভাড়া আসাদুজ্জামান মেনে নিতেন, যদি স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা হতো। তিনি বলেন, প্রায়ই বাসে বাড়তি লোক নেয়। ফলে বেশি ভাড়া দেওয়ার কোনো সুফল নেই।

ঢাকার গুলশানের একটি বায়িং হাউসে চাকরি করেন মো. কামরুজ্জামান। তাঁর বেতন কমেছে ১০ শতাংশ। কিন্তু খরচ বেড়েছে। কীভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জীবাণুনাশক ও মাস্ক কেনা এবং বাসের বদলে অটোরিকশায় চলতে এই বাড়তি খরচ।

আগারগাঁওয়ের গরুর খামারি মো. মানিকের খরচ বেড়েছে অন্যভাবে। তিনি বলেন, গরুর জন্য খুদ (ভাঙা চাল) কিনতে ৫০ কেজির বস্তায় দিতে হচ্ছে ১ হাজার ৩৫০ টাকা, যা ছয় মাস আগে ৯০০ টাকা ছিল। ফলে ৯০ টাকা লিটারে দুধ বিক্রি করে লাভ থাকছে না। তাঁর আয়ের উৎস গরুর দুধের ক্রেতাও এখন কম। করোনার ভয়ে ক্রেতারা তাঁকে অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকতে দেন না।

সরকারি উদ্যোগ বাড়াতে হবে

বাজারে দাম বেড়ে গেলে সাধারণত ট্রাকে খোলাবাজারে চাল বিক্রির কর্মসূচি (ওএমএস) নেওয়া হয়। এখন তা নেই। তবে বিভাগীয় শহরের ২৮১টি দোকানে দিনে এক হাজার কেজি করে চাল দেওয়া হচ্ছে।

সরকারের গুদামে চালের মজুত খুব বেশি নয়। বোরো মৌসুমে চাল সংগ্রহ হয়েছে লক্ষ্যের অর্ধেক। এ সময় ওএমএস চালুর কোনো পরিকল্পনা আছে কি না, জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (বণ্টন) আমজাদ হোসেন বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গেলে উচ্চপর্যায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

টিসিবি ৫০ টাকা কেজিতে চিনি ও ডাল এবং ৮০ টাকা লিটার দরে ভোজ্যতেল বিক্রি করত। সেই কার্যক্রম গতকাল শেষ হয়েছে। টিসিবি ভালো পণ্য বিক্রি করে সুনাম কুড়িয়েছিল। কিন্তু চাহিদার তুলনায় সামান্যই। টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির জানান, তাঁরা প্রতি মাসে ১২–১৩ দিন তেল, চিনি ও ডাল বিক্রি করেন।

বাজারে তেল ও চিনির দাম স্থিতিশীল রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর কমানোর সুপারিশ করেছিল, যা আমলে নেওয়া হয়নি। করোনাকালে বাসভাড়া বাড়ানোর বদলে জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে বাস মালিকদের ক্ষতি পোষানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন বিশ্লেষকেরা। কিন্তু তাতে কান না দিয়ে বাসভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়ানোর সুযোগ দেওয়া হয়।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, একদিকে বহু মানুষের আয় কমে গেছে। অন্যদিকে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। তিনি বলেন, সরকারের উচিত এখন চালের মজুত বাড়িয়ে খোলাবাজারে বিক্রি বাড়ানো। টিসিবির মাধ্যমে আরও বেশি পরিমাণে পণ্য বিক্রি করা, যাতে মানুষ স্বস্তি পায়।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com