বিপাকে ব্যাংকের আমানতকারীরা

0

রাজধানীর বনশ্রীর বাসিন্দা রাহেলা বেগম। জমি বিক্রির ৩০ লাখ টাকা একটি বেসরকারি ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করেছিলেন তিন বছর আগে। প্রতি মাসে ব্যাংক থেকে মুনাফা পেতেন প্রায় ২৬ হাজার টাকা। ওই টাকায় চলতো সংসার। এখন আমানতের মুনাফার হার অনেক কমে গেছে। গত চার মাস ধরে ডিপোজিট থেকে রাহেলা বেগম পাচ্ছেন মাত্র ১৪ হাজার টাকা। জীবনযাত্রাসহ সব ধরনের ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু আয় প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। এখন বাড়তি খরচ মেটাতে বাড়তি আয়ের বিকল্প চিন্তা করছেন তিনি।

রাহেলা বেগম বলেন, সংসারের ব্যয় মেটাতে জমি বিক্রি করে ব্যাংকে টাকা রেখেছি। প্রতি মাসে ২৬ হাজার টাকা পেতাম। সেই টাকায় কোনোমতে সংসার চলতো। এখন একদিকে সবকিছুর ব্যয় যেমন বেড়েছে, অন্যদিকে আয় কমে গেছে। অন্য কোনো আয়ের পথ নেই। কী করবো? এখন সঞ্চয়পত্রে একটু বেশি লাভ পাওয়া যাবে। তবে কিছু কাগজপত্র লাগবে। তা সংগ্রহ করে এ মাসেই সঞ্চয়পত্র কিনবো।

রাহেলা বেগমের মতো একই অবস্থা পুরান ঢাকার আব্দুর রহমানের। চার বছর আগে বেসরকারি একটি ইসলামী ব্যাংকে পেনশনের ২৫ লাখ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করেছিলেন। সেখান থেকে প্রতি তিন মাস অন্তর মুনাফা তুলতেন ৬৬ হাজার টাকা। মুনাফার হার কমিয়ে এখন ব্যাংক দিচ্ছে মাত্র ২৭ হাজার টাকা। অর্থাৎ অর্ধেকের চেয়ে কম।

স্বল্প টাকার আমানতকারীরা আরও বেশি সমস্যায় আছেন। বেসরকারি চাকরিজীবী আসাদুজ্জামান ২০১৫ সালে সঞ্চয় হিসাব খোলেন। প্রতি মাসে জমানো অর্থ মেয়াদ শেষে সুদ-আসলে সঞ্চয় দাঁড়িয়েছে তিন লাখ টাকা। এখন ফিক্সড ডিপোজিট করার জন্য কয়েকটি ব্যাংকে খোঁজ নিয়েছেন। সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ অফার করেছে কয়েকটি ব্যাংক। বেশিরভাগ ব্যাংকই ডিপোজিট রেট ৫ থেকে সাড়ে ৫ শতাংশের কথা বলেছে।

তিনি বলেন, চার লাখ টাকা ব্যাংকে রাখলে বিভিন্ন চার্জ কাটার পর মাসে সর্বোচ্চ পাবো ১৫শ’ থেকে ১৬শ’ টাকা। তাহলে ব্যাংকে টাকা রেখে লাভ কী?

আমানতের সুদের বিষয়ে বেসরকারি এনসিসি ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় খোঁজ নিতে গেলে দায়িত্বরত কর্মকর্তা জানান, এখন আমানতে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সুদ দেয়া হচ্ছে। কোনো গ্রাহক যদি এক লাখ টাকা এক বছরের জন্য ফিক্সড ডিপোজিট করেন, তাহলে প্রতি মাসে সুদ বাবদ পাবেন ৪৫০ টাকা। আর পাঁচ লাখ টাকা রাখলে পাবেন দুই হাজার ২৫০ টাকা। টিআইএন না থাকলে সুদের টাকা আরও কমবে।

বাণিজ্যিক ব্যাংকের সুদ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের করা হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই মাসে বেশিরভাগ ব্যাংক সঞ্চয়ী আমানতের সুদ দিচ্ছে ৫ থেকে ৬ শতাংশের মতো। তবে কয়েকটি ব্যাংক ৭ শতাংশও আমানত সুদ অফার করেছে। এর মধ্যে রয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ও পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক)। বাকি ব্যাংকগুলো আমানতের ৬ শতাংশের নিচে সুদ অফার করছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এখন ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদহার ৬ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। আমানতের সুদহারের চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি। যদি মূল্যস্ফীতির চেয়ে আমানতের সুদ কম হয় তাহলে ব্যাংকে আমানত রাখা মানে টাকা কমে যাওয়া। এমন অবস্থা চলতে থাকলে মানুষ এখন ব্যাংকে আমানত রাখা তো কমিয়ে দিচ্ছে, আগামীতে আরও কমিয়ে দেবে। বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজবে তারা।

আমানতের সুদহার কমতে থাকলে অনুৎপাদন খাতে বিনিয়োগ বেশি হবে। কারণ সাধারণ মানুষ কম মুনাফায় ব্যাংকে টাকা না রেখে জমিতে বিনিয়োগ করবে। গাড়ি-বাড়ি-ফ্ল্যাট কিনবে। এতে অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ বেড়ে যাবে। তাই মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় আমানতের সুদ যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার পরামর্শ দেন এ অর্থনীতিবিদ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট আমানত দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৮১ হাজার ২৫ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১০ লাখ ৬৪ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা। সেই হিসাবে আমানত প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৯৮ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতের আমানত ছিল ১১ লাখ ৩৬ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা। যা আগের বছরের (২০১৮) একই সময়ের তুলনায় ১২ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেশি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, নতুন অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ, যা জুনে ছিল ৫ দশমিক ২৭ শতাংশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সাধারণ মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখে মুনাফার আশায়। অনেকের সংসার চলে এ মুনাফার টাকায়। এখন মুনাফার হার কমায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ আমানতকারীরা। কারণ এখন বেশিরভাগ ব্যাংক মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম সুদ অফার করছে। এর অর্থ হলো, ব্যাংকে টাকা রাখলে বছর শেষে প্রকৃত আয় কমে যাবে। এতে সমস্যায় পড়বে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তরা। যাদের সম্পদ মূলত টাকা। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে মানুষের মধ্যে সঞ্চয়ের অভ্যাস কমে যাবে। তাই আমানতের মুনাফা না কমিয়ে ব্যাংকগুলোর উচিত স্প্রেড (আমানত ও ঋণের সুদ হারের ব্যবধান) কমানো। পাশাপাশি যেকোনো মূল্যে মূল্যস্ফীতির চেয়ে আমানতের রেট বেশি রাখা।

এ বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, কোভিড-১৯ এর কারণে ব্যাংকের ব্যবসা কমে গেছে। এখন আমাদের টিকে থাকতে হলে ব্যয় কমাতে হবে। এ কারণেই আমানতের সুদহার কমাতে হচ্ছে, এছাড়া উপায় নেই। কারণ আমাদের সিঙেল ডিজিটে ঋণ দিতে হচ্ছে।

‘যদিও এটি আমানতকারীদের জন্য খুবই কষ্টের। তারপরও আমাদের কিছুই করার নেই। তবে যতটুকু সম্ভব আমানতের সুদহার ৬ শতাংশের ওপরে রাখার চেষ্টা করছি’— বলেন মাহবুবুর রহমান।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com