অদৃশ্য আতঙ্ক

0

সরকারি তথ্যের কয়েক গুণ বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হওয়ার তথ্য এসেছে একটি আন্তর্জাতিক মানের জরিপে। এই জরিপ পরিচালনা করেছে খোদ সরকারি সংস্থা রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। জরিপ কাজে সহায়তা করেছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা সংস্থা-আইসিডিডিআর,বি’। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী ঢাকায় অন্তত ১৮ লাখ মানুষ করোনা আক্রান্ত। ঢাকার মতোই সারা দেশে এই হারে সংক্রমণ হয়ে থাকলে সারা দেশে আক্রান্তের সংখ্যা কোটির বেশি হতে পারে। সরকারি সংস্থার এ জরিপের ফলে দেশে নতুন করে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। অশনাক্ত এই লাখ লাখ আক্রান্তের মাধ্যমে পরিস্থিতি যে কোনো সময় খারাপ মোড় নিতে পারে। বিশেষ করে আসন্ন শীত মওসুমে সংক্রমণ হার বাড়ার আশঙ্কা জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা এখনই প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলছেন।

সংক্রমণ শুরুর সময় থেকেই বিশেষজ্ঞরা বলে আসছিলেন পরীক্ষা কম হওয়ায় শনাক্তের চেয়ে ১০ থেকে ৪০ গুণ বেশি সক্রিয় রোগী থাকতে পারে। বিশেষজ্ঞদের এমন ধারণার ফলই উঠে এসেছে জরিপে।  
মঙ্গলবার রাতে আইইডিসিআর থেকে জরিপের সংক্ষিপ্তসার গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। আগামী সপ্তাহে পূর্ণাঙ্গ জরিপের ফল প্রকাশ করা হবে বলে জানানো হয়েছে। জরিপে উঠে আসা তথ্য অনুযায়ী রাজধানীর মোট জনসংখ্যার ৯ শতাংশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ঢাকার জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি। সে হিসাবে আক্রান্তের সংখ্যা হবে রাজধানীতে অন্তত ১৮ লাখ। সার্বিকভাবে এ হার ৯ শতাংশ হলেও বস্তির জনসংখ্যার মধ্যে করোনা আক্রান্তের হার অপেক্ষাকৃত কম। বস্তিতে এ হার ৬ শতাংশ। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার মতোই সারা দেশে শনাক্তের বাইরে থাকা রোগী রয়েছে। এই সংখ্যা ঢাকার বাইরে আরো বেশি হতে পারে। সারা দেশে শনাক্ত রোগীর প্রায় অর্ধেক ঢাকায়। বাকি অর্ধেক সারা দেশে। সে হিসাবে ত্রিশ লাখেরও বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন সারা দেশে। তবে ঢাকায় ৯ ভাগ হারে সংক্রমণের যে তথ্য এসেছে সারা দেশে জনসংখ্যা বিবেচনায় এই হারে সংক্রমণ হয়ে থাকলে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
যৌথ জরিপটি পরিচালনায় আর্থিক সহায়তা করে ইউএসএইড ও বিল অ্যান্ড মিলেন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। গত ১৮ই  এপ্রিল থেকে ৫ই জুলাই পর্যন্ত ঢাকার দক্ষিণ ও উত্তর সিটিতে এ জরিপ পরিচালিত হয়। ১০ই আগস্ট এসব তথ্য জানিয়েছে আইইডিসিআর।
সরকারি হিসাবে দেশে এ পর্যন্ত করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন ২ লাখ ৬৩ হাজার ৫০৩ জন। এরমধ্যে রাজধানীতে এক লাখ ৩৩ হাজার ৫৫৫ জন। এ পর্যন্ত তিন হাজার ৪৭১ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন পরীক্ষা কম হওয়ায় সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের ধারণা সরকারি হিসাবের চেয়ে প্রকৃত সংক্রমণ ১০ গুণেরও বেশি হতে পারে। সরকারি সংস্থার সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থার যৌথ জরিপের এ ফল বিশেষজ্ঞদের ধারণাকেই প্রতিষ্ঠিত করল। জরিপ কার্যক্রমের জন্য রাজধানীর ৬টি বস্তি এলাকাসহ বিভিন্ন বাড়ি পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শনকালে যে কোনো একটি বাড়ির চারজনের মধ্যে একজনের শরীরে পরিদর্শনের দিন কিংবা পরবর্তীতে সাত দিনের মধ্যে করোনার চারটি উপসর্গের একটি পাওয়া গেলে তাকে উপসর্গের রোগী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
একইভাবে রাজধানীর ছয়টি বস্তি এলাকাসহ বিভিন্ন বাড়ি পরিদর্শনকালে যে কোনো একটি বাড়ির চারজনের মধ্যে একজনের পরিদর্শনের দিন কিংবা পরবর্তীতে সাত দিনের মধ্যে করোনার চারটি উপসর্গের একটিও না পাওয়া গেলে তাকে উপসর্গবিহীন রোগী ধরা হয়। মোট ৩ হাজার ২২৭টি বাড়ি পরিদর্শনকালে ২১১ জন করোনা উপসর্গের রোগী পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে ১৯৯ জনের নমুনা আরটি-পিসিআর ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়। উপসর্গ রয়েছে এমন বাড়ি থেকে উপসর্গবিহীন ৪৩৫ জনের মধ্যে ২০১ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। উপসর্গবিহীন বাড়ি থেকে ৮২৭ জনের মধ্যে থেকে ৫৩৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া রাজধানীর ছয়টি বস্তি এলাকার ৭২০ বাড়ি থেকে পৃথক নমুনা সংগ্রহ করা হয়। জরিপে দেখা গেছে, যেসব বাড়িঘর পরিদর্শন করা হয়েছে তাদের মধ্যে ৫ শতাংশ মানুষের মধ্যে করোনার উপসর্গ পাওয়া গেছে। মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশের মধ্যে উপসর্গ পাওয়া যায়। যত সংখ্যক বাড়ি পরিদর্শন করা হয়েছে তার ভিত্তিতে শতকরা ৯ শতাংশ করোনা পজিটিভ রোগী পাওয়া যায়। মোট করোনা পজিটিভ রোগীর মধ্যে ১৩ শতাংশের বয়স ৪০ বছরের বেশি, ১৫ থেকে ১৯ বছরের ১২ শতাংশ এবং ১০ বছরের কম বয়সী করোনা রোগী ৬ শতাংশ পাওয়া যায়।
জরিপকালে যাদের মধ্যে করোনার উপসর্গ পাওয়া যায় তাদের ৯৩ শতাংশের জ্বর, ৩৬ শতাংশের কাশি, ১৭ শতাংশের গলাব্যথা এবং ৫ শতাংশের শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা ছিল। যাদের করোনার উপসর্গ ছিল তাদের ১৫ শতাংশ হাসপাতালে ভর্তি হয়। জরিপের আওতাধীন লোকের মধ্যে উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া একজন রোগী মারা যায়।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর উপদেষ্টা এবং সংস্থাটির সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুস্তাক হোসেন এ ব্যাপারে মানবজমিনকে বলেন, জরিপের ফলাফলের আলোকে বলা যায় ঢাকা সিটিতে ২ কোটি জনসংখ্যা থাকলে কমপক্ষে ১৮ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। ঢাকা শহর ঘনবসতি এলাকা। সারা দেশের চিত্র প্রায় একই হবে। এ জরিপের একটি সঠিকতা প্রমাণ করে। তা হলো সংক্রমণে যত লোক চিহ্নিত হন তার ১০ গুণের বেশি বাইরে থাকেন। তারা পরীক্ষার আওয়তায় আসেন না। অনেকে মৃদু বা লক্ষণহীন উপসর্গ নিয়ে ঘোরাফেরা করেন। করোনা শনাক্ত হলে সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে থাকে। এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, গরিবরা পরীক্ষা করাতে আসেন না। কারণ রোগ চিহ্নিত হলে কে খাওয়াবে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় খাওয়ানোর কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, সরকারের উদ্যোগে আইসোলেশন করতে হবে। প্রত্যেক ওয়ার্ডে ডাক্তার নিয়োগ দিতে হবে। রোগীর সংখ্যা কমাতে হবে। ঘরে ঘরে গিয়ে রোগী শনাক্ত করে আইসোলেশন করতে হবে। কোয়ারেন্টিন করতে হবে রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের। স্বাস্থ্যবিধি মানাতে হবে। ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধৌত করা এবং মাস্ক পরার কথা বলতে হবে। তবে শাস্তির ভয় দেখিয়ে নয়। যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হলে এক মাসের মধ্যে করোনা কমে আসবে বলে আশা করেন তিনি। ডা. মুস্তাক হোসেন বলেন, এখনই প্রশিক্ষণ দিতে হবে। শীতে সংক্রমণ বাড়লে আইসোলেশন করতে হবে।
জরিপ প্রসঙ্গে জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য, দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, করোনার সন্দেহ ২৪ শতাংশ রোগীর সঙ্গে জরিপের ৯ শতাংশের মিল রয়েছে। তিনি বলেন, অনেক মানুষ আছেন উপসর্গ নেই। লক্ষণহীন, তারা পজিটিভ, পরীক্ষা করাচ্ছেন না। ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তারা ভাইরাসটি বহন করছেন। তাদের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে বেশি। এজন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মাস্ক পরা, ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধৌত করা এবং হাঁচি-কাশির সময় কনুই বা রুমাল দিয়ে মুখ ঢাকার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com