দীর্ঘ সময় ধরে কার্যক্রম পরিচালনা করার পরও কেবল গ্রামীণফোন ছাড়া দেশের অন্য কোনো টেলিকম অপারেটর লাভজনক অবস্থানে আসতে পারেনি। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই গ্রাহক সংখ্যা ও আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে টেলিকম খাতে শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে অপারেটরটি।
গ্রামীণফোনের এই আধিপত্যের কারণে অন্য অপারেটরদের জন্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়েছে।
এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটিয়ে টেলিকম খাতে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করতে তৎপর হয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি।
২০১৮ সালের নভেম্বরে এই লক্ষ্যে প্রণয়ন করা হয় সিগনিফিকেন্ট মার্কেট পাওয়ার বা এসএমপি নীতিমালা।
এই নীতিমালা অনুসারে, কোনো টেলিকম অপারেটর গ্রাহক সংখ্যা, রাজস্ব ও তরঙ্গের যেকোনো একটির ক্ষেত্রে বাজারের ৪০ শতাংশ দখল করলে সেটিকে এসএমপি হিসেবে ঘোষণা করে সেটির কার্যক্রমের ওপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
উপরোক্ত শর্ত অনুযায়ী চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রামীণফোনকে এসএমপি হিসেবে ঘোষণা করে বিটিআরসি। পরবর্তীতে বিজ্ঞাপন প্রচার, প্যাকেজ, অফার ও কলরেট সংক্রান্ত বিষয়ে গ্রামীণফোনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
গ্রামীণফোনের পক্ষ থেকে এরপর দুইটি নিষেধাজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়। হাইকোর্ট পরবর্তীতে বিজ্ঞাপন প্রচারের নিষেধাজ্ঞাটি স্থগিত করে। এরপর বিটিআরসি জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় এবং গ্রামীণফোনকে বিধিনিষেধ সম্পর্কে তাদের মতামত জানাতে বলে।
মতামত জানার পর নতুনভাবে গ্রামীণফোনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নেয় বিটিআরসি।
নিষেধাজ্ঞাগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল ভয়েস ট্যারিফ, আন্তঃসংযোগ চার্জ, এমএমপি লক ইন পিরিয়ড ও সেবার অনুমোদন সংক্রান্ত বিষয়। আবারও বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ালে আদালতের পক্ষ থেকে এসএমপি অপারেটর ঘোষণা করে গ্রামীণফোনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের বিষয়ে স্থগিতাদেশ দেয়া হয়।
এছাড়া এ বিষয়ে কারণ দর্শাতে বিটিআরসিকে নির্দেশ দেয় আদালত। এরপর থেকে এসএমপি নীতিমালার ব্যাপারে আর কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি।
এ ব্যাপারে খাত সংশ্লিষ্ট সংগঠন অ্যামটবের সাবেক একজন শীর্ষ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর না হওয়ায় ক্রমশ আরও বেশি শক্ত অবস্থানে চলে যাচ্ছে শীর্ষস্থানীয় অপারেটর গ্রামীণফোন। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে কোণঠাসা হয়ে পড়বে অন্যান্য অপারেটরগুলো। অসম প্রতিযোগিতায় অপেক্ষাকৃত ছোট অপারেটরগুলো টিকে না থাকতে পারলে তার প্রভাব পরবে গ্রাহকদের ওপর।
তিনি বলেন, এসএমপি নীতিমালার বাস্তবায়ন থেমে থাকায় সার্বিকভাবে টেলিকম খাতে বিরূপ প্রভাব পরতে পারে। একটি খাতে একাধিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা থাকলে প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহক বাড়াতে মানসম্মত ও বিভিন্ন নতুন সেবা দিতে প্রতিনিয়ত প্রচেষ্টা চালায়। প্রতিযোগিতা ক্রমাগত অসম হতে থাকলে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ফলে সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গ্রাহকরাই।
এ ব্যাপারে রবি আজিয়াটা লিমিটেডের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম যুগান্তরকে বলেন, বাজারে শীর্ষ অবস্থানে থাকা অপারেটরকে সিগনিফিকেন্ট মার্কেট পাওয়ার (এসএমপি) হিসেবে চিহ্নিত করার পর অনেক দিন চলে গেলেও আইনি জটিলতার কারণে তার ওপর বিশেষ রেগুলেটরি বিধিনিষেধ আরোপ করা সম্ভব হয়নি। এ বিলম্ব নিঃসন্দেহে টেলিযোগাযোগ বাজার ব্যবস্থাকে আরও বেশি ভারসাম্যহীন করে ফেলেছে।
শুধু তাই নয়, যেখানে মার্কেট লিডারকে নতুন নম্বর সিরিজ (০১৩) দেয়া হয়েছে, সেখানে মার্জারের পর থেকে রবির ব্যবহৃত ০১৬ নম্বর সিরিজ স্থগিত করার মাধ্যমে বিদ্যমান অসম বাজার প্রতিযোগিতা আরও বেশি ঘনীভূত হয়েছে। আমরা এই বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দ্রুত পদক্ষেপ আশা করছি।
এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বাংলালিংকের চিফ কর্পোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান বলেন, বিটিআরসি ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে এসএমপি নীতিমালা চালু করলে আমরা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছিলাম। এই উদ্যোগের মাধ্যমে টেলিকম খাতে ছোট অপারেটরগুলোর প্রতিযোগী হয়ে ওঠার চেষ্টাকে যে বিষয়টি দীর্ঘ সময় ধরে প্রভাবিত করে আসছিল সেটি সমাধান করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকারের আগ্রহের বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছিল।
তাইমুর বলেন, তবে দুর্ভাগ্যবশত এই নীতিমালা প্রণয়নের পর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও এখনো তা বাস্তবায়িত হয়নি। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মতপার্থক্যের কারণে বিষয়টি এখন আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। বিষয়টি অমীমাংসিত থাকলে টেলিকম খাতে সবার জন্য সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। এর ফলে এই খাতের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবে গ্রাহকরা।
তিনি বলেন, আমরা আশা করছি, সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে এবং আইনগত বিষয়গুলো দ্রুত মীমাংসা করে ছোট অপারেটরগুলোর জন্য ব্যবসা উপযোগী সুষম প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করবে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান মো. জহুরুল হককে এসএমপির বর্তমান কার্যক্রম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি যুগান্তরকে বললেন, বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। আমরা আদালতের সিদ্ধান্ত আসার পর এসএমপির বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
এদিকে এসএমপি নীতিমালার প্রসঙ্গে জানতে যুগান্তর থেকে গ্রামীণফোনের মিডিয়া বিভাগের হোসাইন সাদাতের কাছে লিখিত প্রশ্ন পাঠানো হয়। কিন্তু তিনদিনেও গ্রামীণফোন থেকে এ বিষয়ে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
টেলিকম খাতের সার্বিক উন্নতির জন্য গত কয়েক বছরে বেশ কিছু কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর সঙ্গে এসএমপি নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে তা টেলিকম খাতের অগ্রগতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।