এত সাহস কোথা থেকে পেতেন সাবরিনা
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জেকেজির চেয়ারম্যান সাবরিনা আরিফকে পুলিশ সোমবার ঢাকার একটি আদালতে হাজির করে তিন দিনের রিমাণ্ডে নিয়েছে।
পরীক্ষা এবং চিকিৎসায় প্রতারণার অভিযোগে আলোচিত আরেকজন রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো: শাহেদকে পুলিশ এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি।
করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে জালিয়াতির অভিযোগে এই অভিযুক্তদের সাথে সরকার বা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীদের সম্পর্ক এবং রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয়ে আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
যখন পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দেয়ার অভিযোগ উঠেছে, তখন সরকারি কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব কতটা বিবেচনায় আসে- নতুন করে সেই প্রশ্ন এসেছে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, স্বাস্থ্যখাতসহ যেকোনো সরকারি কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক যোগাযোগ বা প্রভাবের বিষয়টিই মূল বিবেচনায় আসে এবং সেজন্য এই সুযোগ নিয়ে অনেকে দুর্নীতি বা অনিয়ম করার সাহস পাচ্ছে।
জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত জেকেজির কর্ণধার সাবরিনা আরিফ এবং তার স্বামী আরিফুল হক চৌধুরী, দু’জনকেই জিজ্ঞাসাবাদ করছে ঢাকার তেজগাঁ থানা পুলিশ।
পুলিশের তেজগাঁ অঞ্চলের উপ কমিশনার হারুন অর রশিদ বলেছেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অভিযুক্ত দু’জনেই করোনাভাইরাস পরীক্ষার কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব খাটানোর বিষয়টি দাবি করেছেন।
“তারা ধরেন, তারা গোপনে টাকার বিনিময়ে স্যামপল কালেকশন করছে এবং অবৈধভাবে ভুয়া রিপোর্ট দিচ্ছে। সব কিছু মিলিয়ে এত সাহস তো হঠাৎ করে হওয়ার কথা না।”
জেকেজির প্রভাব খাটিয়ে কাজ পাওয়ার অভিযোগ পুলিশের তদন্তে অগ্রাধিকার পাচ্ছে বলে কর্মকর্তারা বলেছেন।
প্রতারণার নানা অভিযোগে অভিযুক্ত রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো: শাহেদ ওরফে শাহেদ করিম নিজেকে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপকমিটির সদস্য বলে দাবি করতেন।
যদিও আওয়ামী লীগ নেতারা বলে আসছেন, মো: শাহেদের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী অনেক নেতার সাথে মো: শাহেদের ছবি নিয়ে ফেসবুকে নানা আলোচনা চলছে।
দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড: ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, সরকারি ক্রয় এবং যে কোনোখাতে কাজ দেয়ার ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রভাব মূল বিবেচনার সংস্কৃতি হয়ে গেছে। সেখানে মহামারি পরিস্থিতির কারণে স্বাস্থ্যখাতে যেহেতু জরুরিভিত্তিতে মৌখিকভাবেই কেনাকাটা বা কাজ দেয়া হচ্ছে, সেজন্য তাতে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো ও অনিয়ম বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
“রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা, রাজনৈতিক ব্লেসিং, পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিকভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত-এই ধরণের উপাদানগুলো কার্যাদেশ থেকে শুরু করে, যারা কাজ পেয়ে থাকেন, এই পুরো প্রক্রিয়াটার মধ্যেই কিন্তু একটা সাংস্কৃতিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেছে।”
ভুয়া রিপোর্ট দেয়ার অভিযোগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আরো পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন সাময়িক সময়ের জন্য স্থগিত করেছে।
এর আগেও সরকারি কাজে বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর অভিযোগ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে।
এমনকি গত বছর ঢাকায় দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে অবৈধ ক্যাসিনো বাণিজ্যের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে যুবলীগের বেশ কয়েকজন নেতা গ্রেফতার হন। সেসময়ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে টেণ্ডারবাজির অভিযোগ উঠেছিল।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড: ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, “এটা এখন আর গোপনীয় বিষয় নয় যে কারা লাইসেন্স পাবে বা কারা কোন কন্ট্রাক্ট বা কাজ পাবে এবং সেজন্য তাদের রাজনৈতিক যোগাযোগ। সমস্যা দেখা দেয়ার পরই আমরা দেখি, এসবের পিছনে যে সব ব্যক্তি থাকে, তাদের সাথে রাজনৈতিক যোগাযোগগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।”
তিনি আরো বলেছেন, “যেহেতু রাজনৈতিক যোগাযোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে, সুতরাং তারা রাজনৈতিক আশ্রয় এবং প্রশ্রয়ে দুর্নীতি এবং অনিয়মের মতো কাজে জড়িয়ে পড়ে। এবং তারা মনে করে, তারা সে সমস্ত কাজ করে পার পেয়ে যাবে।”
জেকেজি হেলথ কেয়ার এবং রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে যখন পরীক্ষার ভূয়া রিপোর্ট দেয়ার অভিযোগ উঠেছে, তখন সরকারি কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব কতটা বিবেচনায় আসে- নতুন করে সেই প্রশ্ন এসেছে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, রাজনৈতিক প্রভাব থাকলে পার পাওয়া যাবে- এমন চিন্তা যেহেতু কাজ করে, সেজন্য র্যাব যখন রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালায়, সে সময়ই হাসপাতালটির মালিক মো: শাহেদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন করার সাহস পেয়েছিলেন।
তবে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, সাম্প্রতিক ঘটনাসহ আগের ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রেও সরকার অপরাধের সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
তিনি দাবি করেছেন, আওয়ামী লীগ কাউকে ছাড় দিচ্ছে না।
“সাম্প্রতিক সময়ে যারা ধরা পড়লো বা যাদের অপকর্ম উদ্ঘাটিত হলো, কোনো পত্রিকার হেডলাইন দেখে কিন্তু সরকার এটা করতে বাধ্য হয়নি। শেখ হাসিনার সরকার নিজস্ব উদ্যোগে এই সমস্ত কালপ্রিটদের চেহারা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেছে এবং দে হ্যাভ ব্রট দেম টু দ্য বুক।”
কিন্তু যখন কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি বা অপরাধ প্রকাশ পাচ্ছে, তখন সরকার বা আওয়ামী লীগ নেতারা নানা ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলে থাকেন। পরে আর তৎপরতা থাকে না। ফলে বার বার এ ধরণের ঘটনা ঘটছে- এমন অভিযোগ তারা বিবেচনা করেন কিনা?
এমন প্রশ্নে মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, “রাজনৈতিক কোনো প্রভাব নয়। আওয়ামী লীগ সরকার একদিকে নিজেরা এগুলো উন্মোচন করছে এবং শুধু উন্মোচন করে থেমে যায়নি। তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ আইন অনুযায়ী স্বচ্ছ্বতার সাথে এগুচ্ছে।”
আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্য হচ্ছে, রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর বহু বছরের পুরোনো সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা তারা করছেন।
কিন্তু বিশ্লেষকদের তাতে সন্দেহ রয়েছে।
সূত্র : বিবিসি