যে ‘৪৮ ঘণ্টা’ আজও শেষ হয়নি
৪৮ ঘণ্টা।
ঠিক এই সময়-সীমার মধ্যেই ২০১২ সালে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার এবং মেহেরুন রুনির খুনিদের আটক করার ঘোষণা দিয়েছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন।
কিন্তু, এরপর পেরিয়ে গেছে প্রায় আট বছর। ৪৮ ঘণ্টার জায়গায় আট বছর পেরিয়ে গেলেও তদন্তকারীরা মামলার কোনো অগ্রগতি করতে পারেনি।
তদন্ত শেষ করতে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অন্যান্য শাখাগুলো আদালত থেকে ৭০ বার সময় নিয়েছে। কিন্তু, তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে তারা প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিবার শুনানির সময়ই তদন্তকারীরা যে কাজটি করেছেন তা হলো বাড়তি সময় চেয়ে আবেদন।
একই অবস্থা আরও তিনটি বহুল আলোচিত হত্যার ঘটনায়। ত্বকী, তনু ও মিতু হত্যার তদন্তেও কোনও দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।
ফেনীর মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির হত্যা ঘটনার মতো চাঞ্চল্যকর মামলাগুলো খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সমাধান করা হয়েছে এমন উদাহরণ আছে। মাদ্রাসায় নুসরতের গায়ে আগুন দেওয়ার কয়েক মাস পরেই তথা ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিলো ১৬ জন আসামিকে।
কিন্তু, এই চারটি মামলার তদন্তের ধীর গতি প্রশ্নবিদ্ধ করছে তদন্তকারীদের। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা থেকে হতাশ করছে।
বিচারের গতি নিয়ে হতাশ সাগর সারোয়ারের মা সালেহা মুনির গতকাল (১৪ জানুয়ারি) বলেছিলেন “ন্যায়বিচার একদিন হবে, তবে সম্ভবত আমি আমার জীবদ্দশায় তা দেখতে পারবো না।”
৬৮ বছর বয়সী এই মা অভিযোগ করেছিলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আগ্রহের অভাবেই এই মামলার তদন্ত দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
তিনি বলেছেন, “সাহারা খাতুন যা বলেছিলেন তা ঠিক ছিলো। তারা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই হত্যাকারীদের সনাক্ত করতে পারে। আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সব অপরাধীদেরকেই খুঁজে বের করার সক্ষমতা রাখে। তবে তাদের স্বদিচ্ছার অভাবই এই মামলা সমাধানের অন্তরায়।”
তিনি জানতেনও না বর্তমানে কে এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও)।
কেঁদে কেঁদে তিনি বলছিলেন, “অনেক আইও বদলানো হয়েছে। কিন্তু কোনো ফল নেই। এর ফল কখনোই আসবে না।”
বেসরকারি টিভি চ্যানেল মাছরাঙার বার্তা সম্পাদক সাগর এবং এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার তার স্ত্রী রুনি ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে তাদের ভাড়া বাড়িতে নিহত হন। এই দম্পতির পাঁচ বছর বয়সী শিশু মাহির সারোয়ার মেঘ তখন বাড়িতেই ছিলো।
শেরেবাংলা নগর পুলিশ এবং গোয়েন্দা শাখার তদন্তের পর, র্যাব এই মামলার তদন্ত শুরু করে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল।
এ পর্যন্ত মামলাটি তদন্ত করেছেন সাতজন কর্মকর্তা।
বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে রয়েছেন, র্যাবে কর্মরত পুলিশের অতিরিক্ত সুপার খোন্দকার শফিকুল আলম। তিনি এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কোনও নির্দিষ্ট তারিখ জানাতে পারেননি।
হাইকোর্টও হত্যার তদন্তে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না হওয়ায় গত মাসে হতাশা প্রকাশ করেছিলেন।
আদালত বলেছে, সন্ত্রাসবাদ, মাদক, অবৈধ অস্ত্র এবং খাদ্যে ভেজাল মোকাবেলায় প্রশংসিত এলিট ও সব ধরনের প্রযুক্তিতে সজ্জিত বাহিনী হিসেবে র্যাবের সাফল্য কিছুটা হলেও ম্লান হয়ে যাবে যদি তারা সাগর-রুনির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করতে না পারে।
শুনানিতে খোন্দকার শফিকুল আলম আদালতকে বলেছিলেন, ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এফবিআই পরীক্ষাগার থেকে আসেনি।
হাইকোর্ট তদন্ত কর্মকর্তাকে তার তদন্তের সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে চলতি বছরের মার্চ মাসের মধ্যে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এছাড়াও ঢাকার একটি আদালত র্যাবকে আগামী ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছে।
গতকাল যোগাযোগ করা হলে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা প্রতিটি মামলা সমাধান করতে আগ্রহী। তবে কিছু কিছু মামলা অধিকতর তদন্তের জন্য আটকে থাকতে পারে।
তিনি বলেছেন, “আমি এই মামলার বিবরণ না জেনে মন্তব্য করতে পারি না। সাগর-রুনি হত্যা মামলার জন্য হাইকোর্ট নির্দেশনা দিয়েছেন এবং র্যাব তা অনুসরণ করছে। সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে এই মামলাগুলো এখনও বিচারাধীন থাকতে পারে।”
মন্ত্রী আরও বলেছেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওপর সেসব মামলার তদন্তে জন্য রাজনৈতিক চাপ নেই।
ত্বকী হত্যা
নারায়ণগঞ্জের কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কোনও অভিযোগপত্রও দাখিল করা হয়নি।
তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে সাংবাদিকরা যোগাযোগ করলে তিনি শুধু বলে যাচ্ছেন “তদন্ত চলছে।”
এবিসি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থী ত্বকী ২০১৩ সালের ৬ মার্চ বিকাল ৪টার দিকে নারায়ণগঞ্জের শায়েস্তা খান রোডের বাসা থেকে স্থানীয় লাইব্রেরি সুধীজন পাঠাগারের দিকে যাওয়ার সময় নিখোঁজ হয়।
নিখোঁজ হওয়ার পরদিন তার এ-লেভেল পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। সে পদার্থবিজ্ঞানে ৩০০ নম্বরের মধ্যে ২৯৭ পেয়ে সারাবিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পায়।
এরপর দিন ৮ মার্চ তার লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায়।
২০১৪ সালের ৬ মার্চ হত্যার এক বছর পূর্তির আগে তদন্ত প্রতিবেদনের একটি খসড়া ফাঁস হয়েছিলো। সেই প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে বিভিন্ন পত্রিকা ত্বকী হত্যায় ১১ জন জড়িত বলে সংবাদ প্রকাশ করেছিলো।
তৎকালীন র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, তারা এই নির্মম হত্যাকাণ্ডে আজমেরী ওসমান ও তার দশ সহযোগীর জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে।
তিনি আরও বলেছিলেন, যেকোনও দিন চার্জশিট জমা দেওয়া হবে।
কিন্তু, সেই ‘যেকোনও দিন’ আজও আসেনি।
প্রসিকিউশন আইনজীবী প্রদীপ ঘোষ বাবু সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, তারা আদালতে চিঠি দিয়েছেন যাতে আদালত তদন্ত কর্মকর্তাকে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।
গতকাল দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে অসংখ্য বিক্ষোভ ও জনসমাবেশে অভিযোগ করা ত্বকীর বাবা রাফিউর রাব্বি বলেছিলেন, এটি তদন্তকারীদের ব্যর্থতা না। এটা রাজনৈতিক প্রভাব।
রাব্বি আরও বলেছেন, “আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ইতোমধ্যে কে খুনি তা খুঁজে বের করেছে। তারা এক বছরের মধ্যে অভিযোগপত্র তৈরি করেছিলো। যখন আমরা দেখলাম অভিযুক্তরা নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য, তখন তদন্ত থেমে গেছে।”
তনু হত্যা
থিয়েটার কর্মী তনুকে ২০১৬ সালের ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাসের ভিতরে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিলো। এই ঘটনায় এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
তনুর মা আনোয়ারা বেগম বলেছিলেন, “মনে হচ্ছে হত্যাকাণ্ডটি ইচ্ছাকৃতভাবে ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে।”
তিনি অভিযোগ করে বলেছেন, “তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে প্রায় দুই বছর আগে। আমি তার সঙ্গে ফোনে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু, তিনি ফোন ধরেননি।”
এই ঘটনায় সারাদেশে ক্ষোভের জন্ম দেয়। হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে অসংখ্য বিক্ষোভ-সমাবেশ করা হয়।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ দুইবার ময়নাতদন্ত করেও তার মৃত্যুর কারণ নির্ধারণ করতে পারেনি। মেয়ের দেহ একটি ঝোপের মধ্যে পরে থাকতে দেখেন তনুর বাবা ইয়ার হোসেন। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, তার মেয়ের মাথার পিছনের অংশে ও নাকে আঘাতের চিহ্ন আছে।
পুলিশের প্রতিবেদনে আঘাতের কোনও চিহ্নের কথা উল্লেখ করা হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তার লম্বা চুলগুলো কাটা ছিলো এবং চোখ-মুখ বন্ধ ছিলো।
তদন্তকারীরা এ পর্যন্ত আদালত থেকে ২৩ বার সময় নিয়েছেন। তাদের দাবি সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্যসহ প্রায় ২০০ জনেরও বেশি লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোনো ফল হয়নি। কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
২০১৬ সালের ১৮ মে সিআইডি জানিয়েছিলো, খুন হওয়ার আগে মেয়েটিকে ধর্ষণ করা হয়। ডিএনএ পরীক্ষার পর তারা তনুর পোশাকে তিনজন পুরুষের শুক্রাণুও পেয়েছেন।
গতকাল দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে ফৌজদারি তদন্ত বিভাগের এএসপি জালাল উদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, তারা ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের অপেক্ষায় ছিলেন।
দেরি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে সেই সিআইডি কর্মকর্তা বলেছিলেন, “আমরা নমুনাগুলো ঢাকার ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবে পাঠিয়েছি। ল্যাবই আমাদের অপেক্ষায় রেখেছে। আমরা তাদের জিজ্ঞাসাও করতে পারি না।”
তনুর মা জানিয়েছেন, মেয়ের হত্যার ঘটনায় মানসিক চাপ তনুর বাবা ইয়ার হোসেনকে অসুস্থ করে ফেলেছে। তিনি শারীরিকভাবে সুস্থ নন।
তিনি বলেন, “সময় পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ন্যায়বিচার পাওয়ার আশাও ম্লান হচ্ছে।”
মিতু হত্যা
প্রাক্তন এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার প্রায় সাড়ে তিন বছর পরও পুলিশ তদন্ত শেষ করতে পারেনি।
মিতুকে ২০১৬ সালের ৫ জুন চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করা হয়েছিলো।
পুলিশ জানিয়েছে, বাবুলের সোর্স কামরুল ইসলাম মুসা ওরফে মুসা সিকদারের নেতৃত্বে মিতুকে ছুরিকাঘাত ও গুলি করে হত্যা করা হয়।
এক বছর আগে পুলিশ জানিয়েছিলো, তারা প্রতিবেদন দাখিলের চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। তবে এখনও পর্যন্ত আর কোনও অগ্রগতি নেই।
গতকাল ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের কোনও নির্দিষ্ট তারিখ দিতে পারেননি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. কামরুজ্জামান।
বিস্তারিত কিছু না বলে তিনি শুধু বলেন, “তদন্ত চলছে।”