সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না এনে অর্থনীতি সচল করার ঝুঁকি

0

করোনার দিনে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না এনে অর্থনীতি সচল করা বলতে আমরা আসলে কী বুঝি? স্বাভাবিক সময়ে উৎপাদকেরা যা উৎপাদন করেন ও সেবাদানকারীরা যেই সেবা দেন সেগুলো ভোক্তারা তাদের চাহিদা অনুযায়ী কিনবেন। এই উৎপাদন ও চাহিদার যত সমন্বয় হবে তত উৎপাদকেরা ও ভোক্তারা এই কেনাবেচা থেকে লাভবান হবেন এবং অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারীর সময় অনেক পণ্যের চাহিদা (সাবান, স্যানিটাইজার, পিপিই, মাস্ক, অক্সিজেন সিলিন্ডার, ভেন্টিলেটর, ইত্যাদি) যেমন বেড়ে গেছে, অনেক পণ্যের চাহিদা (বস্ত্র, রেস্তোরাঁর খাবার, আবাসিক হোটেল, যাতায়াত, ফার্নিচার, গৃহনির্মাণ সামগ্রী, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, সেলুন-পার্লার, ইত্যাদি) তেমন কমেও গেছে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে এই চাহিদা কম বা বেশি হলেও সামগ্রিকভাবে চাহিদা নিম্নমুখী। উৎপাদকেরা অপেক্ষা করছেন চাহিদা বাড়ার, তাতে তারা নিশ্চিত হবেন তাদের সেবা বা পণ্য ভোক্তারা কিনলে তাদের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে না। এদিকে ভোক্তাদের একটা বিশেষ অংশের আয় অনিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় তারা এখনো মৌলিক চাহিদা পূরণেই হিমশিম খাচ্ছেন। সরকারি সাধারণ ছুটির সময় খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ সচল ছিল বলে অর্থনীতির বৃহৎ একটি অংশ অচল হলেও কিছু দিক অন্তত সচল ছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে যখন ১০০টা টেস্ট করলে ২০ জন শনাক্ত পাওয়া যাচ্ছে আর মৃতের সংখ্যা ৫০০’র ওপর উঠে গেছে এবং আমরা অনেকেই কাছের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের মৃত্যু ও শনাক্তের খবর পাচ্ছি, তখন জোর করে সচল করতে চাইলেই কি অর্থনীতি সচল হবে?

করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার শুরু থেকে সাধারণ ছুটির কারণে অর্থনৈতিক কর্মকা- সীমিত হলেও এটাকে আসলে লকডাউন বলা যায়নি। জায়গায় জায়গায় অনির্দিষ্টভাবে শিথিল লকডাউন দেখা গেছে। কিন্তু আবার আশা করা হয়েছে যেন মানুষ ঘরে থাকে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখে। একঘরে ঠাসাঠাসি করে থাকা মানুষদের কথা বাদই দিলাম, কেউ যদি আশা করে মানুষের নিজের ঘরে ফেরারও প্রয়োজন হবে না, থাকার জায়গা না থাকলেও একদিনের নোটিসে রাস্তায় ঘর বাঁধতে হবে তাহলে কি বেশি আশা করা হয় না? সবকিছু বন্ধ ঘোষণা করলেও তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রয়োজনীয় খাদ্য, অর্থ ও আশ্রয়ের সহায়তা না দিলে কার্যকরভাবে সংক্রমণ রোধ করা যাবে না এটা একটি পরীক্ষিত সত্য। কিন্তু সব কিছু খুলে দিলেই অর্থনীতি সচল হয়ে যাবে সেটা এখনো পরীক্ষিত সত্য নয়। কাজেই সব অর্থনৈতিক কর্মকা- সচল করার আগে একটু ভেবে দেখা দরকার যে অর্থনীতি সচল করা বলতে কী বোঝানো হচ্ছে আর এর কার্যকারিতাই বা কী। এই বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তার খোরাক জোগাতে নিচে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করছি :

পৃথিবীজুড়ে এখন মন্দা বিরাজ করছে। যাতায়াত, ভ্রমণ, সামাজিকতা কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পণ্য ও সেবার চাহিদাও কমে গেছে। সম্প্রতি ঠড়মঁব এর ওয়েবসাইটে একটি প্রবন্ধ মারফত জানতে পারলাম প্রতি বছর গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি ১০০ বিলিয়ন গার্মেন্টস উৎপাদন করে, কিন্তু কেনা হয় মাত্র ৮০ বিলিয়ন। বাকি ২০ বিলিয়ন পুড়িয়ে ফেলা হয়, কেটে ফেলা হয়, অথবা পুড়িয়ে ফেলা হয়। ২০১৫ সালে চ্যারিটি বার্নারডোর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে উন্নত দেশে একজন ভোক্তা একটি জামা গড়ে সাতবার পরিধানের পর চ্যারিটিতে দিয়ে দেয়। প্রবন্ধের লেখক ডানা থমাস বলছেন যে কভিড-১৯ এর সংক্রমণের পর ভোক্তাদের অভ্যাস যদি পরিবর্তন করা যায় তাহলে একটু বেশি দামে উন্নতমানের পোশাক ক্রয়ে ও তা বেশিদিন পরিধানে তাদের উৎসাহী করা যেতে পারে। অর্থাৎ ভোক্তার ক্রয় অভ্যাসে পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। কভিড-১৯ সংক্রমণের পর অনেক রিটেইল স্টোর ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ বস্ত্রের চাহিদা কমে গেছে। এই চাহিদা চট করে বাড়ানোর কোনো উপায় নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি না কমবে, মানুষের জীবনযাপন স্বাভাবিক না হবে, ততদিন পর্যন্ত কোনো দৈব উপায়ে এই চাহিদা বাড়ানো সম্ভব না। আর এই চাহিদার সঙ্গে জড়িত বিশাল ইন্ডাস্ট্রিরও চট করে উঠে দাঁড়ানোর কোনো সহজ পথ নেই। এটা শুধু বস্ত্র খাত নয়, অন্যান্য রপ্তানি খাতের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে পারে। অর্থাৎ চাহিদা না থাকলে, সংক্রমণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে না এনে জীবিকার তাগিদ দেখিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকা- চালু করতে চাইলেই কি তা আশানুরূপভাবে চালু হয়ে যাবে? আর যদি ধরি উন্নত দেশগুলো ক্ষতি কাটিয়ে উঠছে আর সেই সঙ্গে চাহিদা বাড়ছে তখন যদি সেই দেশগুলো দেখে বাংলাদেশের মতো দেশ কভিড-১৯ মোকাবিলায় পিছিয়ে আছে তারা কি আমাদের দেশের পণ্য কিনবে?

গত এক দশকে ঢাকা শহরের বিপণিবিতানগুলো তৈরি হয়েছে প্রায় একই বৈশিষ্ট্য নিয়ে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, আলোয় ঝলমল, ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা নেই। লিফটে গাদাগাদি করে উঠতে হয়। পুরনো বিপণিবিতানগুলোয় দোকান গায়ে গায়ে ঘেঁষে বানানো, গায়ে গা লাগিয়ে এক দোকান থেকে বের হয়ে অন্য দোকানে যেতে হয়। অথচ ঢাকায় একটা ঐতিহ্যবাহী নিউ মার্কেট ছিল যেখানে খোলা বাতাসে শপিং করা যেত। নতুন দোকান তৈরি হয়ে সেগুলোও এখন আর মানুষের চাপ নিতে পারছে না। আগের দিনে খোলা মাঠে হাট বসত, সেগুলো এখন সুপার মার্কেট দখল করে নিয়েছে। এসির বাতাসে এসব বদ্ধ জায়গায় কেনাকাটা আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাড়িতে বাড়িতে মৃত্যুর মিছিল সত্ত্বেও এগুলো খুলে দিলেই কি কেনাকাটার ধুম পড়ে যাবে? শপিংমলের বৈশিষ্ট্যগুলো বাদ দিলেও যদি ক্রেতাদের আয় রোজগারের কথা ভাবি তাহলে প্রশ্ন জাগে মানুষের হাতে কেনাকাটা করার মতো টাকা আছে তো? আমরা জানি অনেক মানুষ চাকরিচ্যুত হয়েছেন এই কয়েক মাসে। অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে, এবং নতুন করে মাথা তুলে দাঁড়াবার সক্ষমতা হারিয়েছে। ক্রেতাদের চাহিদা স্বাভাবিক না হলে দোকান খুলে বসলেই যে জিনিসপত্র বিক্রি হবে, রেস্তোরাঁ খুলে বসলেই কাস্টমার এসে বসবে সেটাই বা কী করে জানলাম? আর একজন দোকানদার কভিড আক্রান্ত হলে এর আশপাশের সবাই যখন ঝুঁকির মধ্যে থাকবেন তখন দোকান খুলেই বা কী পাওয়া যাবে কিছু করোনা আক্রান্ত রোগী ও করোনা বাহক ছাড়া?

অর্থনীতি চাঙ্গা করার মানে উৎপাদন ও বেচাকেনা বাড়ানো। খাদ্য ও ওষুধ ছাড়া অন্যান্য যেসব পণ্য বদ্ধ কারখানায় উৎপাদিত হয় সেখানে একজন শ্রমিক বা কর্মচারী আক্রান্ত হলে তার কারণে আরও অনেকেই আক্রান্ত হতে পারেন। রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আমলে না নিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে বেশি সময় লাগবে কি? স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পক্ষে অনেকেই উপদেশ দিচ্ছেন কিন্তু এর স্বাস্থ্যবিধি আয়ত্ত করার বাস্তবতা যদি ভিন্ন হয় তাহলে সমস্ত রকম সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক, পিপিই সবকিছু দেওয়া সত্ত্বেও একজন আক্রান্ত হলেই তো পুরো কারখানা ঝুঁকিতে পড়বে।

ধরুন আমরা সব খুলে দিলাম। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে সাপ্লাই চেইনের বিভিন্ন স্তরে মানুষ একে একে অসুস্থও হয়ে গেল। পণ্য ঠিকই উৎপাদন হলো, কিন্তু তা জায়গামতো পৌঁছে দেওয়া গেল না, মাঝপথে পণ্যটি নষ্ট হয়ে গেল, অথবা তার গুণগত মানের অবনতি ঘটল। অথবা উৎপাদন হলো কিন্তু ক্রেতা নেই। কিছু কিছু ব্যবসা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও জনসংযোগের ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল। পুরো সাপ্লাই চেইনের মাঝখান থেকে দুই একজন নাই হয়ে গেলে পুরো ব্যবসায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিছু কিছু ব্যবসা গড়েই ওঠে বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন মানুষদের শ্রমের ভিত্তিতে। তাদের বিশেষায়িত দক্ষতা সহজে প্রতিস্থাপনও করা যায় না। তিনি হতে পারেন একজন পাকা রাঁধুনি, দক্ষ দর্জি, দক্ষ শিল্পী বা কুশলী, দক্ষ নাপিত, কর্মকার বা মিস্ত্রী। এদের একজনের জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অর্থ হতে পারে একটা ব্যবসা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়া। চিকিৎসা ব্যবস্থা ঠিক না করে এই মানুষগুলোকে ঝুঁকিতে ফেলে কি দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিকে সচল করা যাবে?

আমাদের অনেক প্রবাসী নারী-পুরুষ দেশে ফিরে এসেছেন। পুরো পৃথিবী যখন মন্দা অবস্থা থেকে একটু একটু করে বের হয়ে আসবে, শ্রমিকের চাহিদা তখন একটু একটু করে বাড়বে। বাংলাদেশ যদি সংক্রমণ থেকে বের হয়ে না আসতে পারে, এমনকি তথ্য গোপন করেও নিজেদের অবস্থা ভালো জাহির করতে চায় তবুও অনেক দেশ বাংলাদেশকে নিষিদ্ধের তালিকাতেই রাখতে পারে। তখন চাইলেও বাংলাদেশের পণ্যই শুধু না প্রবাসীদেরও বিদেশে পাঠানো যাবে কী করে সেটাও প্রশ্ন।

অর্থনীতি এখন স্থানীয় ও বৈশ্বিক উভয় স্বার্থের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেশের অর্থনীতিতে স্থানীয় ক্রেতাদের ক্রয়সক্ষমতা, ইচ্ছা, পছন্দ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমন বৈশ্বিক চাহিদার পরিবর্তন, পছন্দ, অপছন্দ, ক্রয়ক্ষমতা, বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা সত্যি যে অর্থনৈতিক কর্মকা- বেশিদিন বন্ধ রাখা যাবে না। চালু করতেই হবে। কিন্তু কখন করতে হবে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্যকে ভঙ্গুর দশায় রেখে আদৌ অর্থনীতি স্বাভাবিক সময়ের মতো সচল হবে কি না এটা এখনো পরীক্ষিত নয়। যেসব দেশ অর্থনৈতিক কর্মকা- সচল করেছে তাদের বেশিরভাগই সংক্রমণ কমিয়ে, নিয়ন্ত্রণে এনে, প্রস্তুতি নিয়ে করেছে। এই মুহূর্তে সংক্রমণের শীর্ষে ওঠার আগেই সব চালু করে দিয়ে সাফল্য অর্জন করেছে এরকম উদাহরণ আমরা এখনো পৃথিবীতে দেখিনি। এই বিপজ্জনক পথে হেঁটে বাংলাদেশ কি এমন কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাইছে যা দেখে অন্য দেশগুলো ভবিষ্যতে সাবধান হতে পারে? আমরা কি কোনো এক্সপেরিমেন্টের বস্তু হয়ে গিয়েছি? নাকি আমরা না দেখলেও সরকার বাংলাদেশের সমতুল্য এমন কোনো রোল মডেল কোথাও দেখেছে যা দেখে অর্থনীতি সচলের সিদ্ধান্ত নিতে পারে?

মহামারীর সময় আমরা একটি অজানা পৃথিবীর সম্মুখীন হয়েছি। শুধু সরকার নয়, আমরা কেউই এখন প্রকৃত পরিস্থিতি জানি না। যা জানি না তাকে স্বীকার করাই প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার লক্ষণ। প্রতি মিলিয়নে মাত্র ১৬২০টি (ওয়ার্ল্ডোমিটার, ২৭ মে, ২০২০) টেস্ট করে যেভাবে অর্থনীতি সচলের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বাংলাদেশ তাতে ভেবে দেখা প্রয়োজন এই অর্থনীতি সচল করা আসলে অর্থনীতিকে কতটুকু সচল করবে? জনস্বাস্থ্যের উন্নতি না ঘটিয়ে, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না এনে, সমস্ত কার্যকারণ বিবেচনা না করে সব কিছু খুলে দেওয়ার উদ্যোগ মানুষকে নিয়ে অনৈতিক খেলায় মত্ত হওয়ার মতো ব্যাপারই।

লেখক

সহযোগী অধ্যাপক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com