খুলে দেওয়া নিয়ে উদ্বেগ

0

দেশে গত এপ্রিলে করোনায় মোট রোগী শনাক্ত হয়েছিল ৭ হাজার ২৪৩ জন। চলতি মে মাসের গত ২৮ দিনে শনাক্ত হয়েছে ৩২ হাজার ৮৩ জন। অর্থাৎ গত ১ এপ্রিলে যেখানে মোট রোগী ছিল ৫৪ জন, দুই মাস পর সে সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৩২১ জনে।

এমনকি গত দুই মাস ধরেই নমুনা পরীক্ষার অনুপাতে করোনা শনাক্ত ও আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যাও উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। গত ১ এপ্রিল যেখানে মোট নমুনা পরীক্ষা করে মাত্র ২ শতাংশের মধ্যে করোনার সংক্রমণ মিলেছিল, প্রায় দুই মাস পর বর্তমানে সে হার পৌঁছেছে ২২ শতাংশে।

একইভাবে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। এপ্রিলে যেখানে করোনায় মৃত্যু হয়েছিল ১৫১ জনের, এ মাসে এখনো তিন দিন বাকি থাকতেই মৃত্যুর সংখ্যা পৌঁছেছে ৩৮৯ জনে। এমনকি দেশে মোট মৃত্যু ৫৫৯ জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা গেছে গত ২৮ দিনে ১৭০ জন। পুরো এপ্রিলে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৬৮ জন। সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন ২৪ মে ২৮ জন, যা এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড।

এছাড়া গত সাত দিনে, অর্থাৎ ২২-২৮ মে পর্যন্ত মোট করোনায় শনাক্ত হয়েছেন ১০ হাজার ১১৬ জন, যা গত এপ্রিলের মোট শনাক্তের চেয়ে প্রায় তিন হাজার বেশি। এ সময় মারা গেছেন ১২৭ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন ঢাকা শহরে ৫৮ জন।

এমনকি গত ২৪ ঘণ্টায় এক দিনে সর্বোচ্চ আক্রান্তের রেকর্ড হয়েছে। ৯ হাজার ৩১০ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ২ হাজার ২৯ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ পাওয়া গেছে। এ সংখ্যা দেশে পরীক্ষা অনুপাতে করোনা শনাক্তের সর্বোচ্চ ২২ শতাংশ। পাশাপাশি মোট আক্রান্তের সংখ্যাও গতকালই প্রথম ৪০ হাজারের ঘর পেরিয়েছে। গতকাল পর্যন্ত দেশে করোনায় মোট শনাক্ত হয়েছেন ৪০ হাজার ৩২১ জন এবং মারা গেছেন ৫৫৯ জন।

করোনা পরিস্থিতির এমন ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের মধ্যেই সরকার ৩০ মে’র পর সাধারণ ছুটি আর না বাড়িয়ে সবকিছু সীমিত আকারে খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার এক প্রজ্ঞাপনে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ৩০ মে’র পর সরকারি ছুটি আর বাড়ছে না। সীমিত আকারে সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত এবং শিল্প-কলকারখানা খুলে দেওয়া হবে। সীমিত আকারে সীমিত যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন, যাত্রীবাহী নৌযান ও ট্রেনও চলবে। এমনকি স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিমান চলাচল করতে পারবে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আপাতত বন্ধ থাকবে। এ সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে ১৩ দফা নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।

সরকারের এ সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এখনো সবকিছু উন্মুক্ত করে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি আসেনি। বরং সাধারণ ছুটি বা লকডাউনকে আরও কঠোর করা উচিত। সরকারের এ সিদ্ধান্তের ফলে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে। সংক্রমণ আরও বেশি জায়গায় ছড়িয়ে পড়বে।

বিশেষজ্ঞরা এমনও বলেছেন, সংক্রমণ পরিস্থিতির এ সময়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে জরুরি প্রয়োজনীয় কাজের পরিসর আরও বাড়ানো যেত। ধাপে ধাপে সবকিছু খোলা উচিত ছিল। এমনকি যেসব সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত এবং শিল্প-কলকারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে, সেখানে সব কর্মীকে একসঙ্গে কর্মক্ষেত্রে আনাও উচিত হবে না। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনা এবং দেশের অভ্যন্তরীণ করোনা পরিস্থিতির তথ্য-বিশ্লেষণ ছাড়াই লকডাউন বা সাধারণ ছুটি তুলে নেওয়ায় বাংলাদেশকেও বিশ্বের সর্বোচ্চ আক্রান্ত ও মৃত্যুর শীর্ষে থাকা দেশগুলোর মতো খেসারত দিতে হতে পারে বলেও আশঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

এর মধ্যে দিয়ে করোনাভাইরাসের কারণে দুই মাসেরও বেশি সময় বন্ধ থাকার পর অফিস-আদালত খুলছে। করোনাভাইরাসের কারণে গত ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি চলছে। ইতিমধ্যে সাত দফায় ছুটি বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ ৩০ মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটি বাড়ানো হয়। আগামীকাল শনিবার সর্বশেষ ঘোষিত সাধারণ ছুটি শেষ হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে ছুটি আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত এলো।

সবকিছু খুলে দেওয়ার ফলে করোনা পরিস্থিতিতে তিন ধরনের সংকট দেখা দেবে বলে মনে করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মুজাহেরুল হক। তিনি বলেন, একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও টেকনিক্যাল পারসন হিসেবে আমাদের কথা হলো সরকারের এ সিদ্ধান্ত একটা চরম ভুল। কারণ সংক্রমণ কীভাবে বাড়ছে, সেটা সবাই দেখছে। পরীক্ষা, নমুনা সংগ্রহসহ নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও যে হারে সংক্রমণ বাড়ছে, সেটা খুবই উদ্বেগের। আবার বাড়ার যে সংখ্যা, সেটা প্রকৃত সংখ্যা নয়। যাদের টেস্ট করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে থেকে শনাক্ত সংখ্যা। টেস্টের আওতা বাড়িয়ে দিলে সংক্রমণের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। সেটা যদি দেশব্যাপী হয়, তাহলে আরও বেড়ে যাবে। সেজন্য সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে এ সংক্রমণের মাত্রাটা আরও বাড়াবে। দ্রুত বাড়াবে।

এ বিশেষজ্ঞ বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা লকডাউন শিথিলের ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছে, যেটা সব দেশের জন্য প্রযোজ্য। তারা বলেছে, প্রত্যেক দেশেরই একটা লকডাউন এক্সিট প্ল্যান (লকডাউন থেকে বেরোনোর পরিকল্পনা) থাকবে। তার মানে হলো লকডাউন ওঠাতে হলে একটা পরিকল্পনা থাকতে হবে। এটা তখন থেকেই হবে যখন থেকে সংক্রমণ কমবে। আমাদের এখানে তো সংক্রমণ কমেইনি। আরও বাড়ছে। ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মানা হলো না। তাদের পরামর্শ না মেনে সিদ্ধান্ত দেওয়াটা আরেকটা ভুল হলো।

তিনি আরও বলেন, আমাদের যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, বর্তমানে করোনার যে পরিস্থিতি, তাতেই অনেক মানুষ করোনার বেড পাচ্ছে না, আইসিইউ-অক্সিজেন-ভেন্টিলেটর পাচ্ছে না। সংক্রমণের হার যখন আরও বেড়ে যাবে, সেই চাপ নেওয়ার মতো সামর্থ্য স্বাস্থ্যব্যবস্থার আছে কি না, সেটাও দেখতে হবে। তার মানে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর চাপ পড়বে। অধিকসংখ্যক লোকের মৃত্যুর আশঙ্কা থাকবে।

লকডাউন শিথিলের ব্যাপারে বাংলাদেশের মতো এমন ভুল অন্য কোনো দেশ করেনি বলেও উল্লেখ করেন এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, কোনো দেশ এমন ভুল করেনি। কোনো কোনো দেশ, যেমন ইতালি, আমেরিকা, স্পেনসহ কিছু দেশ যত তাড়াতাড়ি রিঅ্যাক্ট করার দরকার ছিল, ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ছিল, সেখানে কিছুটা শৈথিল্য দেখিয়েছে। তার খেসারত এসব দেশকে দিতে হয়েছে। এরপর তারা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে সেসব দেশে সংক্রমণ কমছে। সংক্রমণ যখন কমা শুরু করেছে, তখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যে পরামর্শ ছিল, সে অনুযায়ী তারা একটা এক্সিট প্ল্যান করে ধীরে ধীরে সবকিছু খুলছে।

অবশ্য সরকার একসঙ্গে সবকিছু খুলে না দিয়ে ধাপে ধাপে খুলতে পারত বলে মনে করেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও রোগতত্ত্ববিদ ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, আজ (গত ২৪ ঘণ্টায়) যত রোগী শনাক্ত হয়েছে, তা মোট নমুনা পরীক্ষার ২২ শতাংশ। এটা এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ শনাক্তের হার। এমন অবস্থায় সরকারের একসঙ্গে সবকিছু খুলে দেওয়া খুবই বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত। ধাপে ধাপে খোলা উচিত ছিল। সব অফিস একসঙ্গে খোলা মানে মেলামেশা বাড়াবে, সংক্রমণ বাড়াবে। বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যদি সংক্রমণ বাড়ে, শহরাঞ্চলে কোনো এলাকা বা স্পটে যদি সংক্রমণ বাড়ে, তাহলে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়, মৃত্যু হার বাড়ে। কাজেই এ সিদ্ধান্তটা সঠিক হয়নি।

এ বিশেষজ্ঞ বলেন, এমনিতেই ঈদের সময় আমরা মেলামেশা করেছি। যাত্রাপথে, ঈদের জামাত, দাওয়াত খাওয়া কোনোটাই কমেনি। এরই মধ্যে সবকিছু খুলে দেওয়া হচ্ছে। তার মানে সংক্রমণ বাড়তেই থাকবে। আর রোগী বাড়া মানে ক্ষয়ক্ষতি বাড়া। হাসপাতালগুলো এখনো সামাল দিতে পারছে। কিন্তু এই হারে যদি রোগী বাড়তে থাকে, হাসপাতালগুলোয় উপচে পড়বে। বিশেষ করে ক্রিটিক্যাল রোগীদের জন্য সমস্যা বেশি হবে। হাসপাতাল ভরে গেলে আরেকটা আতঙ্ক সৃষ্টি হবে। আক্রান্তের সংখ্যার চেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে অর্থনীতি।

কাজেই এখনো সময় আছে খোলার যে সিদ্ধান্ত সেটা সীমিত করা হোক পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সব প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে না খুলে ভাগ ভাগ করে খোলা হোক। খোলা প্রতিষ্ঠানে সব ওয়ার্কার একসঙ্গে না গিয়ে দূরত্ব বজায় থাকে এমনসংখ্যক কর্মী যেন যায়।

ডা. মুশতাক হোসেন আরও বলেন, হাল ছেড়ে দেওয়ার মনোভাব না নিয়ে বিজ্ঞানসম্মতভাবে এগুলো দেখা উচিত। রোগী বাড়ছে। এমন অবস্থায় লকডাউন তুলে নেওয়া বিপজ্জনক। এখনো বাসাবাড়িতে গিয়ে যাদের জ¦র আছে, তাদের পরীক্ষা করতে হবে। শনাক্ত হলে আলাদা করে ফেলতে হবে। রোগ ছড়াতে থাকলে সংক্রমণ কমবে না।

একইভাবে বর্তমান পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিনের পরিচালক অধ্যাপক ডা. একেএম শামছুজ্জামান বলেন, লকডাউন বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। যেসব এলাকা লকডাউন, ধীরে ধীরে সেগুলো উন্মুক্ত করার জন্য প্রথম নির্দেশক হচ্ছে জাতীয় পর্যায়ে সংক্রমণের হার কমের দিকে আসতে হবে। এখন যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, এ বৃদ্ধিটা যখন ক্রমান্বয়ে নিম্নমুখী হতে থাকবে, তখন এলাকাভিত্তিক লকডাউনের চিন্তাটা করতে হবে। সেটা হলো ‘রিপ্রেজেন্টেটিভ স্যাম্পল’ (একটা জনসংখ্যার কিছু অংশ যদি পরীক্ষিত হয়, তাহলে ওই পুরো জনসংখ্যাকে প্রতিফলিত করে) পরীক্ষা করে দেখা যায় যে সংক্রমণের হার কম, তখন কিন্তু বিজ্ঞানসম্মতভাবেই ওইসব এলাকার লকডাউন ধীরে ধীরে খুলে দিতে পারবে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com