দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি ‘ভারত-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা চুক্তি ২০২০’
গত ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নয়া দিল্লি সফরকালে সই হওয়া ভারত-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা চুক্তিটি ২১ শতকের সূচনায় সূচিত ইন্দো-মার্কিন কৌশলগত অংশীদারিত্বের আরেকটি মাইলফলক। সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামার উদীয়মান চীন-ভারত জায়ান্টের মধ্যে মার্কিন অগ্রাধিকার এবং ইউএস এশিয়া প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির পিভোট হিসেবে ভারত সম্পর্কে যত কথা বলা হয়েছে, এশিয়ান শতক নিয়ে বক্তব্য কম উল্লেখিত হয়েছে।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠতা তাদের রাজনৈতিক-কূটনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে যতটা বোঝা যায়, তার চেয়ে বেশি গভীরতা রয়েছে ইতিহাসে। ১৯৫০-এর দশকের প্রথম দিকে বাড়তে থাকা ভারত-সোভিয়েত সম্পর্ক ভণ্ডুল করতে ব্যাটল অ্যাক্ট ১৯৫১ আইনের আওতায় ভারত থেকে কৌশলগত কাঁচামাল আগাম ক্রয় করে। কিন্তু এতে কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি। ভারত স্নায়ুযুদ্ধে যোগ দিতে চায়নি। ফলে ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকের আগে ইন্দো-মার্কিন সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়নি। ১৯৬২ সালে ভারতের চীন যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে এবং ভারতকে মার্কিন অস্ত্র সহায়তায় তা স্পষ্টভাবে দেখা যেতে থাকে। আবার ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর আরোপিত অবরোধেও তা ফুটে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্র এসবের মাধ্যমে পরিষ্কারভাবে বলে দেয় যে পাকিস্তানের নিরাপত্তা তার প্রথম ও একমাত্র অগ্রাধিকার নয়।
এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে সাম্প্রতিক ইন্দো-মার্কিন প্রতিরক্ষা চুক্তিতে পাকিস্তানের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি অপেক্ষা করছে। এটা কেবল ৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র চুক্তি বা অত্যাধুনিক অস্ত্রের ব্যাপার নয়, বরং এই চুক্তিতে থাকা মতাদর্শগত বিষয়বস্তুই আসল কথা। ২৪টি ইউএস লকহিড মার্টিন থেকে এমএইচ-৬০আর সিহক হেলিকপ্টার ভারতীয় নৌবাহিনীর সাবমেরিনবিধ্বংসী সক্ষমতা বাড়িয়ে দেবে অনেক। তবে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত যৌথ বিবৃতি অনুযায়ী, এসব হেলিকপ্টার অভিন্ন নিরাপত্তা স্বার্থ জোরদার করবে, চাকরি বাড়াবে, দুই দেশের মধ্যে শিল্প সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে।
আবার ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য ছয়টি এএইচ-৬৪ই অ্যাপাচি অ্যাটাক হেলিকপ্টার কেবল শক্তিই বাড়াবে না, সেইসাথে সুনির্দিষ্ট সামরিক প্রযুক্তি হস্তান্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনীহার অবসান ঘটাবে। আর ১০টি এজিএম-৮৪ এল বিমানচালিত হারপুন ক্ষেপণাস্ত্র ও ১৬টি এমকে ৫৪ লাইটওয়েট টর্পেডো সজ্জিত করা হবে পি-৮১ বিমান। এসব অস্ত্র গেম চেঞ্জার না হরেও ভারতের হাতে এসব প্রযুক্তি আসা মানে তারা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অধিকারী হওয়া।
এসব অস্ত্র ব্যবস্থা মোতায়েন কেবল ভারত মহাসাগর এবং আরব/পারস্য মহাসাগরের কাছাকাছি এলাকায় নিরাপত্তা স্বার্থই বাড়াবে না, সেইসাথে পাকিস্তান নৌবাহিনীর জাহাজগুলোর ঘাড়ের ওপর তরবারিও ঝুলিয়ে রাখবে। ভারত আগেই রুশো-সোভিয়েত উৎস থেকে অত্যাধুনিক সামরিকব্যবস্থা সংগ্রহ করেছিল। এখন মার্কিন প্রযুক্তি তাদেরকে আরো এগিয়ে দেবে। এসব অস্ত্রকে প্রতিরোধ করার মতো সক্ষমতা পাকিস্তানের নেই, বিষয়টি তেমন নয়। তবে পাকিস্তান বাহিনী আগে থেকেই প্রচলিত অস্ত্রে পিছিয়ে থাকায় এখন তাকে তার নিরাপত্তা নিয়ে আরো উদ্বেগে থাকতে হবে। কারণ ভারসাম্য প্রবলভাবে ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়বে এবং পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্র মোতায়েনও সীমাবদ্ধ করে দেবে।
ইন্দো-মার্কিন প্রতিরক্ষা চুক্তিটি এমন এক সময়ে হলো, যখন পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে উষ্ণ রাজনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। তালেবানের সাথে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করিয়ে দেয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তান সন্তুষ্টও করতে পেরেছিল।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিটি ভারত ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আঞ্চলিক সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার বৃহত্তর লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত দৃশ্যত এই ধারণায় একসাথে কাজ করছে যে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সিপিইসি ও চীন-পাকিস্তান নৌ সামরিক সহযোগিতা তাদেরকে কোণঠাসা করে ফেলতে পারে। তাছাড়া পাকিস্তানের নৌবাহিনীকে চীনের অস্ত্র সরবরাহ করার বিষয়টিও তাদের নজরে এসেছে।
গত ৫ বছরে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক হিসেবে পরিচিত হচ্ছে। ২০১৯ সালে তারা প্রথমবারের মতো সামরিক ব্যয়ে বিশ্বে তৃতীয় স্থানে ওঠে আসে। তারা ওই বছর বৈশ্বিক সামরিক ব্যয়ের ৩.৭ ভাগ করে। ভারতের ব্যাপক অস্ত্রসজ্জা, আগ্রাসী প্রচলিত সামরিক সক্ষমতা এবং আগাম পরমাণু হুমকি সরাসরি দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে।