ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি : আমেরিকার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়
সময়টা ১৯৭২ সাল। আমেরিকায় তখন বইছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের হাওয়া। ওয়াশিংটন ডিসির ওয়াটারগেট হোটেলের ছ’তলায় ছিল ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির কার্যালয়। এখান থেকেই ডেমোক্র্যাটদের নির্বাচনী কৌশল আর প্রচার সবকিছু নির্ধারণ করা হতো। ডেমোক্র্যাটদের নীতিনির্ধারকদের নিয়মিত আনাগোনায় মুখরিত এই অফিসেই ১৯৭২ সালের ১৭ জুন খুব ভোরে ঢুকে পড়েন পাঁচ ব্যক্তি।
তারা সেই অফিসে থাকা টেলিফোনে ছোট মাইক্রোফোন লাগাতে শুরু করেন, যার মাধ্যমে নজরদারি করার পরিকল্পনা করা হয় ডেমোক্র্যাটদের নির্বাচনী কৌশলের উপর। পাশাপাশি, দরকারি কাগজপত্রের ছবি তুলতে গিয়ে অফিসে থাকা ফাইল ক্যাবিনেট তছনছ করে দেয়া হয়। সেদিন ভোরে নিরাপত্তাকর্মী ফ্রাঙ্ক উইলস তার রুটিন টহল দিচ্ছিলেন। ছয় তলায় টহল দিতে গিয়ে তিনি খেয়াল করলেন ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির অফিসের দরজায় লাগানো লক ডাক্ট টেপ। এই টেপ লাগানো থাকলে দরজা এমনভাবে বন্ধ হয় যাতে লকটা আটকে না যায়। সেটা দেখে সহজেই বোঝা যায় ভিতরে কেউ রয়েছে। কিন্তু এত ভোরে কারো অফিসে থাকার তো কথা নয়। তাই উইলস শুধু সেই টেপটা খুলে দিলেন দরজার লক থেকে। গুরুতর কিছু মনে না হওয়ায় তিনি চলে যান তার রুটিন টহলে। ঘণ্টাখানেক পরে দরজায় আবার সেই একই টেপ দেখতে পেয়ে তিনি খবর দেন পুলিশকে। এরপরই পুলিশ আটক করে সেই দলটিকে। ৫ জনের সেই দলের কাছে পাওয়া যায় নগদ ২,৩০০ ডলার, যার প্রায় সবই ১০০ ডলারের। পরবর্তী সময়ে এই ১০০ ডলারের নোট নিয়ে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে অনেক কিছু। এই ঘটনা নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলোর আঙুল ওঠে রিপাবলিকান প্রার্থী রিচার্ড নিক্সনের দিকে। ওয়াশিংটন পোস্টের দুই তরুণ সাংবাদিক কার্ল বার্নস্টেইন আর বব উডওয়ার্ড পাঁচ অনুপ্রবেশকারী আর ওই ১০০ ডলার নোটের সিরিয়াল নিয়ে রীতিমত তদন্ত শুরু করেন।
১৯৭২-র ১০ অক্টোবর। ওয়াশিংটন পোস্টে ‘Deep Throat’-এর গোপন সূত্র তুলে ধরে বলা হয় প্রেসিডেন্ট নিক্সন ওয়াটারগেটের এই ঘটনার জন্য দায়ী। প্রথম মেয়াদের দায়িত্বের শেষপ্রান্তে থাকা নিক্সন এই ঘটনাকে অস্বীকার করেন এবং পুরো ঘটনাটা ষড়যন্ত্র বলেই চালিয়ে দেন। এই ঘটনাকে নিক্সন তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার বলে আখ্যা দেন। আর সবকিছু ছাপিয়ে একই বছরের ৭ নভেম্বর রিচার্ড নিক্সন ৫০ রাজ্যের ৪৯টিতেই জয়ী হয়ে দ্বিতীয়বার মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
সাংবাদিক বার্নস্টেইন আর উডওয়ার্ড কিন্তু থেমে যাননি। প্রেসিডেন্ট নিক্সন নির্বাচিত হওয়ার পরও রীতিমতো ওয়াশিংটন পোস্টে তাদের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করতে থাকেন। চাঞ্চল্যকর তথ্যগুলোর সূত্র হিসেবে ‘Deep Throat’ ছদ্মনামের এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন তারা। তাদের রিপোর্টে বেরিয়ে আসে ওয়াটারগেটে ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির অফিসে মোট চারবার ঢুকেছিল অনুপ্রবেশকারী সেই দলটি। পুলিশের হাতে ধরা পড়া সেই দলের অনেকেরই পরিচয় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে মিডিয়ায় সাড়া পড়ে যায়।
অনুপ্রবেশকারীদের একজন ছিলেন জেমস ম্যাককর্ড। অবসরপ্রাপ্ত এই সিআইএ কর্তা ছিলেন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নির্বাচনী ক্যাম্পেনের নিরাপত্তা কর্তা! তাদের কাছে ১০০ ডলারের যে নোট পাওয়া যায় সেগুলোর সিরিয়াল নম্বর নিয়ে তদন্ত শুরু করেন দুই সাংবাদিক। দেখা যায় এই সিরিয়াল নম্বারের নোটগুলো ব্যাংক থেকে নিক্সনের নির্বাচনী প্রচারের ব্যয়ের জন্য তোলা নোটগুলোর সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। সন্দেহ আরো জোরালো হতে থাকে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের প্রশাসনের দিকে। নিক্সন প্রশাসনের মুখপাত্ররা বরাবর একে ষড়যন্ত্র বলেই উল্লেখ করছিলেন। সংবাদপত্রের সঙ্গে নিক্সনের মুখপাত্রদের এই লড়াই পরিচিত ‘নিক্সন বনাম প্রেস’ নামে। সিআইএ আর এফবিআই তদন্ত শুরু করে এই ঘটনার। নিক্সন প্রশাসনের ধামাচাপা দেওয়ার সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে এই ঘটনা গড়ায় সেনেট পর্যন্ত। ওয়াটারগেটের কীর্তিকলাপ নিয়ে সিনেটে তদন্ত কমিটি গঠিত হওয়ার প্রস্তাব ৭৭-০ ভোটে গৃহীত হয়। মিডিয়াতে ব্যাপক প্রচার পাওয়ায় এই ঘটনা জনমনে ব্যাপক আগ্রহের জন্ম দেয়। প্রথমে রুদ্ধদ্বার শুনানির ব্যবস্থা করলেও পরে টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের সিদ্ধান্ত নেয় মার্কিন সেনেট।
প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের সময়কাল থেকেই মার্কিন প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের ওভাল অফিসসহ হোয়াইট হাউজের গুরুত্বপূর্ণ সব টেলিফোনিক কথাবার্তা রেকর্ড করে গোপনে সুরক্ষিত রাখা হতো। কিন্তু, নিক্সন ক্ষমতায় আসার পর থেকে তিনি হোয়াইট হাউজের যাবতীয় কথা রেকর্ড করার ব্যবস্থা চালু করেন। আর তখন কে জানত নিজেরই পাতা ফাঁদে তিনি নিজেই জড়িয়ে পড়বেন? ১৯৭৩ সালে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের রেকর্ড করা কিছু টেপ ফাঁস হয়ে যায়। প্রায় একই সময় অ্যাটর্নি জেনারেল এলিয়ট রিচার্ডসন এই মামলায় প্রসিকিউটর হিসেবে আর্চিবাল্ড কক্সকে নিয়োগ করেন। মামলার তদন্ত করার জন্য নিক্সনের কাছে ১৯৭২ সালের নির্বাচন পূর্ববর্তী সমস্ত টেপ চান কক্স। তবে নিক্সন টেপ না দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না। বরং কক্সের পদত্যাগের নির্দেশ জারি করলেন। ফলে ওইদিন রাতেই অ্যাটর্নি জেনারেল এলিয়ট রিচার্ডসন স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলেন আর আর্চিবাল্ড কক্স চাকরি হারালেন।
মিডিয়াতে ফলাও করে অ্যাটর্নি জেনারেলসহ বেশ কয়েকজনের পদত্যাগের কথা প্রচার করা হয়। এই রাতের ঘটনাটিকে আমেরিকান মিডিয়া নাম দেয় ‘Saturday Night Massacre’ হিসেবে। এই ঘটনার ফলে নিক্সন সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। ফলে টেপ না দিয়ে আর যাবেন কোথায় নিক্সন! তদন্তকারীদের চাপে শেষ পর্যন্ত হোয়াইট হাউজের টেপ হস্তান্তর করতে বাধ্য হন তিনি। তবে সেই টেপের ১৯৭২ সালের ২০ জুন তারিখের একটি সংলাপের ১৮ মিনিট গায়েব করে দেন নিক্সনের সেক্রেটারি রোজ মেরি ওডস। এই ঘটনাকে ঐতিহাসিকেরা নাম দিয়েছেন ‘রোজ মেরি স্ট্রেচ’। এটিই নিক্সনকে এনে ফেলে একেবারে খাদের কিনারায়। বাকি টেপগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজে তদন্ত কমিটি ওয়াটারগেটের ঘটনার সঙ্গে প্রেসিডেন্টের প্রত্যক্ষ যোগের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়। ১৯৭৪ সালের ২৭ জুলাই নিক্সনের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকার নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়ার পর তদন্ত কমিটি রিচার্ড নিক্সনকে তার প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইমপিচ করার পার্লামেন্টে বিল আনার জন্য সুপারিশ করে। কিন্তু, তার আগেই ৯ আগস্ট তিনি তার পদত্যাগপত্র জমা দেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পান। দায়িত্ব পেয়ে তিনি সাবেক প্রেসিডেন্টের ক্ষমার আদেশ জারি করেন। নিক্সন প্রশাসনের এক ডজনের বেশি কর্মকর্তার বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি হয়। কার্ল বার্নস্টেইন এবং বব উডওয়ার্ড সাহসী সাংবাদিকতার জন্য পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। আর ২০০৫ সালে বার্নস্টেইন এবং উডওয়ার্ডকে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য দেওয়া সেই ‘Deep Throat’ আত্মপ্রকাশ করে জানান, তিনি আর কেউ নন— মার্ক ফেল্ট নামে এক সাবেক সিআইএ এজেন্ট।
সেই দুনিয়া কাঁপানো সাংবাদিক বব উডওয়ার্ডের সদ্য প্রকাশিত বই ‘ফিয়ার’ ঘিরে এখন মার্কিন মুলুকে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। বইটিতে ট্রাম্প প্রশাসন এবং প্রেসিডেন্টের প্রতি তার সহকারীদের মনোভাব নিয়ে বেশ কিছু তাৎপর্যপূর্ণ দাবি করা হয়েছে। যথারীতি ট্যুইটারে বই এবং লেখক দুইয়ের বিরুদ্ধেই সরব হয়েছেন ডন। তাঁর বক্তব্য, গোটাটাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিবৃতি এসেছে হোয়াইট হাউস থেকেও। তা সত্ত্বেও, বিতর্ক ঠান্ডা হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই আপাতত চোখে পড়ছে না।
ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি ফাঁস করা সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড তার নতুন বইয়ে ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসের বিশৃঙ্খল ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন। বর্তমান প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতার ভিত্তিতে নিজের বইয়ে উডওয়ার্ড লিখেছেন, ‘দেশের মঙ্গলের জন্য অনেক সময়ে খোদ প্রেসিডেন্টের নির্দেশও অগ্রাহ্য করেন তার সহকারীরা।’ নিজের এমন দাবির স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে হোয়াইট হাউসের একাধিক কর্তাব্যক্তির মন্তব্যকে উদ্ধৃত করেছেন উডওয়ার্ড। চিফ অফ স্টাফ জন কেলি না কি ব্যক্তিগত এক বৈঠকে প্রেসিডেন্টকে ‘বুদ্ধু’ বলে মন্তব্য করেছেন। বলেছেন, এখন তারা উন্মাদনগরীতে রয়েছেন। ‘ফিয়ারে’ আরো লেখা হয়েছে, প্রেসিডেন্টকে ‘মিথ্যুক’ বলেছেন তার সাবেক আইনজীবী জন ডড।
এখানেই শেষ নয়! উডওয়ার্ড লিখেছেন, হোয়াইট হাউসের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা গ্যারি কন কিছুদিন আগে ট্রাম্পের টেবিল থেকে একটি চিঠি চুরি করে নেন, যাতে প্রেসিডেন্ট তাতে স্বাক্ষর না করতে পারেন। গ্যারির কথায়, ট্রাম্প ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করে ফেললে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে আমেরিকার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ভেঙে যেত! তাই বাধ্য হয়ে এই কাজ করেন তিনি। গ্যারির দাবি, বিষয়টি ট্রাম্পের চোখেই পড়েনি। ঘটনা হলো, বইটি প্রকাশিত হওয়ার আগে টেলিফোনে ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলেছিলেন লেখক উডওয়ার্ড। সেই কথোপকথনে উডওয়ার্ডকে ‘নিরপেক্ষ’ বলে প্রশংসা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট।
সূত্র : বর্তমান