করোনাযুদ্ধে আদর্শ নেতা নিউজিল্যান্ডের জ্যাসিন্ডা

0

বিশ্বনেতাদের যোগ্যতার পরীক্ষা নিচ্ছে করোনাভাইরাস। মহামারিতে বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানরা তাদের নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ভাইরাসের বিস্তার ঠেকানোর চেষ্টা করছেন। প্রত্যেকের কাজের ধরন, পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা আলাদা হলেও সবার লক্ষ্য একটাই করোনাকে হারানো।

করোনাভাইরাসকে হারানোর এই যুদ্ধে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জ্যাসিন্ডা অ্যার্ডেন।

‘পৃথিবীর সবচেয়ে উপযোগী নেতা’ হিসেবে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জ্যাসিন্ডা অ্যার্ডেনকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য আটলান্টিক ম্যাগাজিন।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে নিজের মতো করে নেতৃত্বের পথ তৈরি করেছেন নিউজিল্যান্ডের ৩৯ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী জ্যাসিন্ডা অ্যার্ডেন। দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে তিনি জনগণের ওপর কোনোকিছু চাপিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে তাদেরকে নিজেদের সুরক্ষার বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তার বক্তব্য সহজ ও সুস্পষ্ট। আর এ জন্যই নিউজিল্যান্ডের সব শ্রেণির জনগণ প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা মেনে চলছেন।

নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্ক বলেন, ‘মানুষ বিশ্বাস করে, তিনি (জ্যাসিন্ডা) কারো কাছে কোনোকিছু প্রচার করতে চাইছে না। তারা জানে, সবাই এখন এক ধরনের বিপদের মধ্যে আছে। আর বিপদের সময়ে প্রধানমন্ত্রী নিউজিল্যান্ডবাসীর পাশে আছেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি জনগণের সম্পূর্ণ আস্থা আছে। জ্যাসিন্ডা সহানুভূতিশীল আর এজন্যই সব শ্রেণির মানুষ তার প্রতি নির্ভরশীল।’

অন্য দেশের সরকারপ্রধানরা যখন প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন করে কিংবা টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ রেখে সবাইকে মহামারি সম্পর্কে বোঝাতে চেষ্টা করছেন, তখন ভিন্ন পথে হেঁটেছেন জ্যাসিন্ডা অ্যার্ডেন। কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই তিনি বেশ কয়েকবার ফেসবুক লাইভে এসেছেন। লকডাউন চলাকালীন মার্চের শেষ দিকে তিনি যখন লাইভে আসেন, তখন তাকে সাদামাটা ঘরোয়া একটি সোয়েটার গায়ে জড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তিনি জানান, মাত্রই মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে লাইভে এসেছেন।

ফেসবুক লাইভে জনগণের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলেন তিনি। লকডাউনের জন্য জনগণের অসুবিধা হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেন। জনগণকে বোঝান যে, করোনাযুদ্ধ জয় করতে হলে সবাইকে একসঙ্গে লড়তে হবে।

লকডাউনের গাইডলাইন তিনি খুব সহজ ভাষায় মানুষকে বুঝিয়েছেন। বলেছেন, ‘নিজেকে একটি বাবলের মধ্যে রাখুন। পরিবারের সদস্য, অফিস সহকর্মী কিংবা যাদের ছাড়া আপনার চলবেই না তাদেরকে সেই বাবলের ভেতরে রেখে অন্য সব মানুষ থেকে দূরে থাকুন। এমন আচরণ করুন যেন আপনি ইতোমধ্যেই কোভিড-১৯’এ আক্রান্ত। তাই হাতেগোনা মানুষ ছাড়া বাবলের বাইরের কারো সঙ্গে মিশবেন না। বাবলের বাইরে গেলে আপনি বাকিদের মধ্যেও সংক্রমণ ঘটাবেন। তাই প্রিয়জনদের সুরক্ষার জন্য ঘরে থাকুন।’

ফেসবুক লাইভে এসে তিনি তার নিজের বাবল সম্পর্কে সবাইকে জানান। তার বাবলে থাকা অফিস কর্মকর্তা ও পরিবারের সদস্যদের দেখান।

জনগণের ওপর নির্দেশনা চাপিয়ে না দিয়ে তিনি বাস্তবতা বুঝিয়েছেন। বলেছেন, ‘নিজ নিজ অবস্থানে থাকুন। এখন সবকিছু বন্ধ। অন্য কোথাও যেতে গিয়ে যদি রাস্তার মাঝখানে গাড়ি নষ্ট হয়, তাহলে সারানোর লোক পাবেন না। তখন প্রত্যন্ত অঞ্চলে একা একা বিপদ হতে পারে।’

শিশুদের প্রতি অধিক সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘আমি জানি, শিশুদের খেলার মাঠ থেকে দূরে রাখা বেশ কঠিন। কিন্তু, ভাইরাসটি কঠিন পৃষ্ঠে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।’

সংবাদ সম্মেলন, কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের মতো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াও ঘন ঘন ফেসবুক লাইভে ব্যক্তিগতভাবেও নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলছেন জ্যাসিন্ডা অ্যার্ডেন।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্ক বলেন, ‘জ্যাসিন্ডা কখনো সাংবাদিকদের প্রশ্নে বিরক্ত হননি। একবার সংবাদ সম্মেলনে একজন সংবাদকর্মী প্রশ্ন করতে গিয়ে বারবার আমতা আমতা করছিলেন, ঠিকভাবে কথা বলতে পারছিলেন না। জ্যাসিন্ডা তাকে কৌতুকের ছলে বলেছেন, “আমি বুঝতে পারছি দুশ্চিন্তায় আপনি রাতে ভালো ঘুমাতে পারেননি।” তিনি সবসময়ই ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালনের জন্য সংবাদকর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন।’

সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়েই প্রায় ৫০ লাখ জনসংখ্যার এই দেশটিতে এক মাসের লকডাউন ঘোষণা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী জ্যাসিন্ডা অ্যার্ডেন বলেন, ‘ভাইরাসের সংক্রমণ কমানো নয়, আমাদের লক্ষ্য শূন্যে নিয়ে আসা। করোনাভাইরাসকে পুরোপুরি নির্মূল করা।’

করোনাভাইরাস নির্মূল করার লক্ষ্যেই কাজ করছে তার সরকার। করোনা প্রতিরোধে নিউজিল্যান্ড সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মাইকেল বেকার ও নিক উইলসন। এই দুই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে সীমান্তে কঠোর ব্যবস্থাপনা, বিদেশফেরতদের বাধ্যতামূলকভাবে কোয়ারেন্টিনে রাখা, ঝুঁকিতে থাকা সব মানুষের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসাদের শনাক্ত করা— এসব ব্যবস্থার কারণেই নিউজিল্যান্ডে করোনা ঠেকানো সম্ভব হয়েছে।

মাইকেল বেকার বলেন, ‘আমাদের প্রথম পরিকল্পনা হচ্ছে— করোনাভাইরাস নির্মূল করা। আর দ্বিতীয় পরিকল্পনা হলো— অনেক মানুষের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা।’

বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানরা করোনার বিরুদ্ধে লড়তে একেক ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছেন। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেল বিজ্ঞানের ওপর আস্থা রেখেছেন। অন্যদিকে, বিজ্ঞানকে উড়িয়ে দিয়েছেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জায়ার বোলসোনারো। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলনে দোষারোপের নতুন নতুন পদ্ধতি খুঁজে নিচ্ছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন না করলেও ১৩০ কোটি মানুষকে লকডাউন করে রেখেছেন।

ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গবেষক ভ্যান জ্যাকসন বলেন, ‘তিনি (জ্যাসিন্ডা) কখনো ভুল তথ্য দেন না। কাউকে দোষারোপও করেন না। তিনি জনগণের পাশে থাকার চেষ্টা করেন। সবার প্রত্যাশা পূরণের জন্য তিনি নিরলসভাবে কাজ করার চেষ্টা করছেন।’

তিনি জানান, জ্যাসিন্ডা অ্যার্ডেন এমন একজন নেতা, যিনি বাড়িতে দুই বছরের মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে সাদামাটা সোয়েটার পরেই কয়েক লাখ মানুষের কাছে তাদের সুখ-দুঃখ সম্পর্কে জানতে চান। এই দৃষ্টিভঙ্গি ও নেতৃত্বের ধরনের কারণেই তিনি অনন্য।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com