আফগানিস্তানকে রাজনৈতিক সঙ্কটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে করোনাভাইরাস
গত চার দশক ধরেই সাধারণ আফগানদের জন্য ভাগ্য খুবই নির্মম। সোভিয়েত আগ্রাসন থেকে বর্তমান তালেবান বিদ্রোহ পর্যন্ত দেশটির কাহিনী সুপরিচিত। এখন যুক্তরাষ্ট্র যখন সৈন্য প্রত্যাহার করছে, গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে, তখনই করোনাভাইরাসের আবির্ভাব ঘটল। এর প্রভাবে পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যেতে পারে।
চার দশক ধরে যুদ্ধে বিধ্বস্ত আফগানিস্তান বিশ্বের সবচেয়ে গরিব দেশগুলোর একটি। দেশটির জনস্বাস্থ্য কাঠামো এতই নাজুক যে প্রাথমিক পরিচর্যাও প্রদান করা সম্ভব নয়। ফলে করোনাভাইরাসের মারাত্মক প্রকোপ সামাল দেয়া তো অনেক পরের কথা। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আফগানিস্তানে প্রতি ১০ হাজার লোকের জন্য চিকিৎসক আছেন তিনজনেরও কম। প্রতি বছর প্রতিবেশী পাকিস্তানে যায় হাজার হাজার আফগান। আর পাকিস্তানের মতো এই দেশও পলিওভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে পারেনি।
আফগানিস্তানে প্রথম করোনাভাইরাস দেখা দেয় ইরান সীমান্তের হেরাতে। এই শহরই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি করোনো রোগী রয়েছে। ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ৭১৪ জন শনাক্তের মধ্যে ২৮৪ জন তথা প্রায় ৪০ ভাগ হেরাতে। করোনায় ব্যাপক ক্ষতির শিকার ইরান থেকে ফিরে আসা লোকজন করোনা ছড়িয়েছে এখানে।
এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিবেশী ইরান ও পাকিস্তান থেকে মোট ২,৪৬,৪৩৪ জন আফগানিস্তানে ফিরেছে। এদের মধ্যে প্রায় ৯৯ ভাগ ফিরেছে ইরান থেকে। আর মার্চের কেবল তৃতীয় সপ্তাহেই ইরান থেকে এসেছে ৬৫ হাজারের বেশি লোক।
এরপর থেকে ভাইরাসটি অন্য ২৭টি প্রদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এদের একটি বড় অংশ হলো কাবুল ও কান্দাহার।
তবে আফগানিস্তানে কত লোক আক্রান্ত হয়েছে, তা নির্ণয় করা কঠিন। কারণ পরীক্ষার কিটের প্রবল সঙ্কট রয়েছে। ফলে সংক্রমণ ঠিক কতটা ছড়িয়ে যাচ্ছে, তা বোঝা যাচ্ছে না। ৩৮ মিলিয়ন লোকের দেশটিতে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ৪,৪৭০ জনের পরীক্ষা করা হয়েছে। অথচ ওই সময় পর্যন্ত পাকিস্তানে করা হয়েছে ৬২ হাজারের বেশি পরীক্ষা।
ভাইরাসটি দমনের জন্য ব্যাপক পরীক্ষা ও শনাক্তকরণ খুবই দরকারি বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু আফগানিস্তানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে করে এমন কিছুর আশা করা উচিত নয়।
আফগানিস্তানে লকডাউন জারি করা হয়েছে। তবে এতে অর্থনীতি ও জনস্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সারা বিশ্বের মতো আফগানিস্তানেও গরিবরা ঘরে থেকে না খেয়ে মরছে। কেবল লকডাউনের ফলেই আফগানিস্তানে আরো বেশি লোক গরিব হয়ে পড়বে, গরিবদের অবস্থা আরো খারাপ হবে।
আবার লকডাউনের ফলে সরকারের রাজস্ব আয়ও হবে কম। ২০১৪ সাল থেকে দেশটির প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল ২ ভাগের মতো। কিন্তু এখন তা আরো কমে যাবে। তাছাড়া দেশটির প্রবাসী আয়ের একটি অংশ আসত পাকিস্তান ও ইরান থেকে। সেখানেও তা হ্রাস পেয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আঞ্চলিক ও পরাশক্তিগুলো আফগানিস্তানে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই), ওষুধ ও নানা ধরনের সহায়তা পাঠিয়ে আসছে। কিন্তু তা প্রয়োজন মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত বিবেচিত হচ্ছে না।
করোনাভাইরাসের জের ধরে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক নেতা ও বিদ্রোহীরা তাদের সঙ্ঘাতের অবসান ঘটাতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। নির্বাচন নিয়ে আশরাফ ঘানি ও আবদুল্লাহ আবদুল্লাহর মধ্যে বিরোধ অব্যাহতই চলছে। এই দুজনের মধ্যে বিরোধ নিকট ভবিষ্যতে অবসান হবে বলে মনে হচ্ছে না। একবার মনে হচ্ছিল, তাদের মধ্যে বিরোধের অবসান হবে। কিন্তু ঘানি একতরফাভাবে প্রধানত জাতিগত পশতুদের মধ্য থেকে নিয়োগ দিতে থাকায় সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে পড়ছে। ঘানি মনে করছেন, হানিফ আতমার মতো লোকজনকে কাছে টানতে পারলে আবদুল্লাহর হাত দুর্বল হয়ে পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন খাতে সহায়তা অব্যাহত রাখা। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের তালেবান তাদের সন্ত্রাসবিরোধী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে কিনা তার ওপর নির্ভর করে সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টি নিশ্চিত করার কাজ করা ঠিক হবে না।
যুক্তরাষ্ট্র যদি অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত সৈন্য মোতায়েন অব্যাহত রাখে তবে ঘানি সুযোগটি গ্রহণ করে যুক্তরাষ্ট্রকে পূর্ণাঙ্গ আফগান গৃহযুদ্ধে টেনে নেবে।
তবে এখন আফগানদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাদের ব্যাপারে। তাদের উচিত হবে না চার দশক আগের মতো ভুল করা। আমেরিকা ও বিশ্বসম্প্রদায়ের উচিত হবে আফগানদের সহায়তা করা অব্যাহত রাখা। কিন্তু অবশিষ্ট বিশ্বের মতো আমেরিকাও করোনাভাইরাসে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। তারা আফগানিস্তানে বিলিয়ন বিলিয়ন ব্যয় না করে দেশে খরচ করতে পারে। আমেরিকাকে অবশ্যই তার নিজের জনগণের দিকে আগে তাকাতে হবে। আর আফগান নেতাদেরও বুঝতে হবে, তাদেরও নিজ দেশের জনগণের দিকে তাকাতে হবে।