ভারতে সরকারের ব্যর্থতা আড়াল করতে দায় চাপানো হচ্ছে সংখ্যালঘুদের উপর
করোনাভাইরাস মহামারী প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তার সাথে ইতালিয়ান দার্শনিক গিয়াকোমো লিওপার্ডির একটি বক্তব্যের মিল পাওয়া যাচ্ছে: “কোন মানবিক বৈশিষ্ট্যই দৈনন্দিন জীবনে কম সহিষ্ণুতার প্রত্যাশা করে না, যখন কম পায়, সেটা অসহিষ্ণুতা।”
অন্যান্য দেশে যখন রোগটি শিকড় গাড়ছিল, তখন শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক প্রকাশনাগুলো ভারতে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে বিজেপি নেতাদের নেতিবাচক ভূমিকা তুলে ধরছিলো করছিল। তারা তখন ধর্মভিত্তিক ঐতিহ্যবাহী ওষুধের ওপর ভর করে অবৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা (যোগ বা গোমূত্র পান) প্রয়োগের কথা বলছিলেন।
বোঝাই যাচ্ছে, সরকার তার বক্তব্য প্রচারে ধর্মকেই মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছিল।
যেকোনো সংস্কৃতিতে ধর্ম মূল্যবোধের একটি শক্তিশালী উৎস। অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টি বিশেষভাবে সত্য।
ইসলামে আত্মীয়-স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্ত, মুসাফির ও ভিক্ষুকদের সহায়তা করতে বলা হয়েছে। হিন্দুদের অবশ্যই নিজের প্রতিবেশীর দিকে তাকিয়ে আনন্দ বা বেদনা মূল্যায়ন করতে বলা হয়েছে।
মহামারীর সময় ধর্মীয় মূল্যবোধ কিভাবে মানুষের কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করে তার একটি উদাহরণ দেখা যায় পাকিস্তানে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক-ধর্মীয় দলগুলো করাচির মন্দির ও চার্চগুলোতকে সংক্রমণমুক্ত করার পাশাপাশি রান্না করা খাবারও বণ্টন করেছে।
এ কারণে দক্ষিণ এশিয়ার সরকারি কর্মকর্তাদের তাদের সুপারিশমালা সমর্থনের পেছনে থাকা যুক্তি উপলব্ধি করা যেতে পারে। তারা ধর্মীয় নেতাদের সমর্থন কেন দেন বা ধর্মীয় উদ্দীপনা কেন প্রদর্শন করেন, বিশেষ করে মহামারীর সময়, সেটা বোঝা যায়।
পাকিস্তানেও প্রভাবশালী ধর্মনেতাদের প্রয়াসের নেতিবাচক ও ইতিবাচক উভয় বিষয়টিই ফুটে ওঠেছে।
অবশ্য ভারতে রোগটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার হুমকি সৃষ্টি এবং দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করার প্রেক্ষাপটে ভারতীয় নেতারা সমাজের অন্যান্য সদস্যদের ওপর গোঁড়ামিপূর্ণ ও বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করেছে।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষই কোভিড-১৯-এর কয়েক ডজন সংক্রমণের জন্য একটি মুসলিম মিশনারি গ্রুপকে দায়ী করেছে। ওই গ্রুপটি মার্চের প্রথম দিকে দিল্লিতে একটি বার্ষিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ একে ‘তালেবানি’ অপরাধ হিসেবে অভিহিত করে।
ভুয়া ভিডিওতে ভ্রান্তভাবে দাবি করা হয় যে মিশনারি গ্রুপটির সদস্যরা পুলিশের ওপর থুতু ফেলছে, নার্সদের হয়রানি করছে। এসব ভিডিও ভাইরালও হয়। ভারত সরকার বেশ স্মার্টভাবে দিল্লিতে মুসলিমদের ওপর নির্যাতন চালানোর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিন্দার বিষয়টি আড়াল করার চেষ্টা করছে এর মাধ্যমে।
অথচ বিজেপি নেতা ও উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ নিজে পর্যন্ত লকডাউন ভেঙে হিন্দুদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক লোক উপস্থিত হলেও তা কোনো খবরে পরিণত হয়নি।
#coronajihad নামের হ্যাশট্যাগটি তিন লাখের বেশিবার শেয়ার হয়েছে, সম্ভবত সাড়ে ১৬ কোটি লোক তা দেখেছে।
ডিজিটাল মানবাধিকার গ্রুপ ইকুইলিটি ল্যাবসের মতে, এ ধরনের পোস্টগুলোর একটি বড় অংশই টুইটারের নিয়ম লঙ্ঘন করে করা হচ্ছে। কিন্তু তবুও এগুলো সরানো হচ্ছে না। টুইটার স্পষ্টভাবেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে যুক্ত হচ্ছে। অবশ্য কাশ্মির ও ভারতের অন্যান্য কিছু ঘটনা বিবেচনা করলে একে নজিরবিহীন মনে হবে না।
অথচ বাস্তবে ভারতে হাজার হাজার অভিবাসী শ্রমিক আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে লকডাউনের কারণে। তাদের হাতে টাকা নেই, লঙ্গরখানার খাবারের ওপর ভরসা করে থাকবে, সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, তাদের অনেকে শত শত মাইল হেঁটে গ্রামের দিকে যাচ্ছে খাদ্য ও থাকার নিশ্চিয়তার জন্য।
সরকারি সহায়তার জন্য অপেক্ষা করছে কোটি কোটি চাকরিহীন লোক। তারা এখন ক্ষুধার আশঙ্কায় ভুগছে। কিন্তু সরকারি সহায়তার আশ্বাস এখনো পূরণ হয়নি।
লকডাউনের বিধিনিষেধ অমান্যকারী লোকদের প্রহার করা হচ্ছে, নির্যাতন করা হচ্ছে। অথচ সামাজিক মিডিয়ায় হতাশাজনকভাবে প্রকাশ পাচ্ছে যে সরকারি কর্মকর্তাদের পরিবার সদস্যরা বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা ভোগ করছে।
কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সত্ত্বেও ভারতে করোনাভাইরাস রোগীর দিক থেকে এই অঞ্চলে শীর্ষ স্থানে রয়েছে। এমনকি প্রতিবেশী পাকিস্তানে পুরোপুরি লকডাউন না করা সত্ত্বেও ওই দেশের রোগীর সংখ্যাকেও ছাপিয়ে গেছে ভারত। অথচ দুই দেশের জনসংখ্যাগত অবস্থান ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে বেশ মিল রয়েছে।
সম্ভবত সরকারি ব্যর্থতা আড়াল করার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো সংখ্যালঘুদের উপর দায়ভার চাপিয়ে দেয়া।
অনিশ্চয়তাপূর্ণ পরিস্থিতিতেও দায় চাপানোর কারণ হতে পারে। হগসের অনিশ্চয়তা-পরিচিতি তত্ত্ব অনুযায়ী, অনিশ্চয়তার সময় লোকজনের মধ্যে তার নিজের জনসাধারণের ওপর দায় চাপানোর প্রবল চেষ্টা দেখা যায়। এমনকি নিজ দেশের পুরো সম্প্রদায়কে দানবীয়ভাবে তুলে ধরতে হলেও তারা তা করে।