কাশ্মিরে ইসরাইলি পদ্ধতি প্রয়োগ করছে ভারতীয় সেনাবাহিনী
ভারত-অধিকৃত কাশ্মিরের বেসামরিক এলাকা থেকে পাকিস্তানকে টার্গেট করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোলাবর্ষণের ভিডিও প্রকাশ হওয়ার পর বাহিনীটির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে।
কুপওয়ারা জেলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা পাঞ্জগামের বাসিন্দারা মিডল ইস্ট আইকে সোমবার জানান, গত সপ্তাহে ভারতীয় বাহিনী ভারী আর্টিলারি নিয়ে ওই এলাকায় প্রবেশ করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা চালানোর জন্য গ্রামটিকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে।
গ্রামবাসীরা বলছে, তারা এখন কেবল প্রতিশোধমূলক হামলার মুখেই পড়ছেন না, সেইসাথে বফোর্স আর্টিলারি কামানের কানে তালা লাগা শব্দে ঘরবাড়ির ক্ষতি হচ্ছে, শিশুরা সন্ত্রস্ত্র হচ্ছে, শান্ত গ্রামটিকে রণাঙ্গণে পরিণত করা হচ্ছে।
পাঞ্জগামের এক অধিবাসী জায়বা হোসাইন আইকে বলেন, আমরা সেনাবাহিনীর কাছে গিয়েছিলাম, কিন্তু তারা আমাদেরকে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বললো। আমরা কোথায় যাব?
তিনি বলেন, একদিকে সরকার আমাদের বলছে বাড়িতে থাকতে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে, অন্যদিকে তাদের সেনাবাহিনী দূর পাল্লার অস্ত্র ব্যবহার করছে। এতে আমাদের বাড়ির ভেতরের সবকিছু কাঁপে।
কাশ্মিরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার আন্তঃসীমান্তে শুক্রবার থেকে হামলা শুরু হয়েছে। উভয় পক্ষ ২০০২ সালের যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের জন্য একে অপরকে দায়ী করেছে।
পঞ্জগামের লোকজন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পদক্ষেপের নিন্দা করে বলেছে যে তারা নিয়ন্ত্রণ রেখার (এলওসি) মাত্র ২০ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে। সেনাবাহিনীর এই সিদ্ধান্তের ফলে আশপাশের গ্রামগুলো বিপদে পড়বে।
হোসাইন বলেন, যদি জানতাম যে তারা একদিন এই এলাকায় এসে আমাদের সবাইকে মানব-ঢাল হিসেবে ব্যবহার করবে, তবে আমরা এসব বাড়িঘর তৈরি করতাম না।
তিনি বলেন, আমরা ভয়ে চিৎকার করছি, আমাদের সন্তান ও প্রবীণরা আতঙ্কে রয়েছে।
ভয়ে আমরা কবরও ঠিকমতো খুঁড়তে পারি না।
সোমবার প্রতিশোধমূলক গোলাবর্ষণে আট বছরের একটি শিশুসহ তিন কাশ্মিরি বেসামরিক নাগরিক মারা যায়।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর মুখপাত্র রাজেশ খালিয়া এক বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী আজ ভোর ৫টায় কেরান সেক্টরে বিনা প্ররোচনায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। পাকিস্তান এখন কুপওয়ার সেক্টরে বেসামরিক নাগরিকদের টার্গেট করছে। এতে এক নারী, এক শিশুসহ তিনজন নিহত হয়েছে।
এদিকে পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মিরে একটি দুই বছরের বালক নিহত ও অন্য চারজন আহত হয়েছে।
পাকিস্তান জানিয়েছে, ভারতীয় সেনাবাহিনী বিনা প্ররোচনায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। তারা ধুকনিয়াল, রাজচিকরি ও চিকিকোট সেক্টরে বেসামরিক লোকজনকে টার্গেট করছে।
এরপর থেকে আন্তঃসীমান্ত গোলাবর্ষণ বন্ধ হলেও অধিবাসীরা বলছে, উত্তেজনা এখনো রয়েছে।
ইসরাইলি পদ্ধতির অনুসরণ
জম্মু কাশ্মির কোয়ালিশন অব সিভিল সোসাইটির প্রগ্রাম কো-অর্ডিনেটর খুররম পারভেজ মিডলইস্ট আইকে বলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর বেসামরিক এলাকায় আর্টিলারি অস্ত্রের ব্যবহার যুদ্ধাপরাধের সমতুল্য।
তিনি বলেন, আমাদের জানা মতে তারা গ্রামে ১৫৫ এমএম বফোর্স বসিয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, সেনাবাহিনী বেসামরিক এলাকাকে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। এটা একটি যুদ্ধাপরাধ।
তিনি বলেন, এটা খুবই স্পষ্ট যে দুই দেশের কেউই বেসামরিক জীবনকে পাত্তা দেয় না। আর ভারতীয় এলাকায় বেসামরিক হত্যার মাধ্যমে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি খারাপ করা হচ্ছে। এটা একটি মনোস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, কাশ্মিরের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।
দিল্লিভিত্তিক আইনজীবী ও লিগ্যাল এনথ্রোপলজিস্ট শ্রীময় ঘোষ একমত পোষণ করে বলেন যে আবাসিক এলাকায় আর্টিলারি পজিশন নিয়ে যাওয়া মানে গ্রামবাসীদেরকে গোলার সামনে রাখা এবং এলাকাটিকে পরিকল্পিতভাবে শত্রুর গোলার সামনে স্থাপন করা। বেসামরিক লোকজনকে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা যুদ্ধাপরাধের সমতুল্য অপরাধ।
ভারতীয় পুলিশ কর্মকর্তা শ্রী রাম আম্বারকর বলেন, ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে এবং তা সংশোধন করা হবে।
তবে ঘোষ বলেন, সামরিক পদক্ষেপকে সামরিক পদক্ষেপগুলোকে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইন ও নীতিমালাকে ভারত পাত্তা না দেয়া এবং কাশ্মিরিদের প্রতি আক্রণাত্মক অবস্থান গ্রহণে কোনো রীতিনীতি পালন না করার মনোভাবই প্রকাশ করছে।
তিনি বলেন, বিরোধপূর্ণ কাশ্মিরে বিদ্রোহ দমনে আমরা অতীতে মানব ঢাল ব্যবহার দেখেছি। ২০১৬ সালে একটি ভিডিওতে দেখা যায়, সামরিক একটি যানের বনেটে একজনকে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওই সময়কার ভারতীয় সেনাপ্রধান একে ‘উদ্ভাবনমূলক পদক্ষেপ’ হিসেবে প্রশংসা করেছিলেন।
ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রায়ই কাশ্মিরিদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বলে অভিযোগ রয়েছে। আর তা অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরাইলি বাহিনী করে থাকে।
ঘোষ বলেন, ভারত বেসামরিক ও সামিরক টার্গেটের মধ্যকার পার্থক্য অস্পষ্ট করে তুলছে। এসবের তদন্ত হওয়া উচিত।
এ ব্যাপারে মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।