হাজারও মানুষের মৃত্যুতে দায়ী প্রধানমন্ত্রী জনসন: ব্রিটিশ চিকিৎসক
ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর মতো যুক্তরাজ্যেও গত কয়েক সপ্তাহে দ্রুত ছড়াচ্ছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। ইতোমধ্যেই সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৯ হাজার ৮৮৫ জন, মারা গেছেন প্রায় ১০ হাজার। প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। তাদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। অনেক হাসপাতালেই রোগী ধারণক্ষমতা পূরণ হয়ে গেছে। ফলে অনেকটা বেছে বেছে গুরুতর রোগীদেরই চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
দেশের এমন দুরবস্থায় চরম ক্ষুব্ধ যুক্তরাজ্যের এক নবীন চিকিৎসক। অ্যান্ড্রু মেয়ারসন নামে ওই চিকিৎসক ওরচেস্টারশয়ার রয়্যাল হাসপাতালে কর্মরত। গত শুক্রবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে তার মতামত প্রকাশ করা হয়েছে। পাঠকদের জন্য লেখাটির অনুবাদ তুলে ধরা হলো-
প্রিয় বরিস জনসন,
রাজনীতিতে আজকাল যেমন সবকিছুই চলছে, চিকিৎসায় ঠিক তার বিপরীত- আমাদের এমন এক পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে যাকে ‘অভূতপূর্ব ঘটনা’ বলা যায়। এগুলো তখনই ঘটে যখন নানা প্রোটোকল ও এসব ঘটনা প্রতিরোধের জন্য সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা সত্ত্বেও রোগীকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। ‘অভূতপূর্ব ঘটনাগুলো’ এতটাই ভয়াবহ মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয় যে, এতে জড়িত বেশিরভাগ চিকিৎসক বাকি কর্মজীবনে এর ভার বহন করবেন।
অনেক নবীন চিকিৎসক দুর্ঘটনা ও জরুরি বিভাগে (এঅ্যান্ডই) কর্মীস্বল্পতা নিয়েও টানা কাজ করছেন। আমি দেখেছি অত্যাধিক চাপে থাকা অবস্থার ফল কী হয়। আমার বিশ্বাস, এটাকেও ‘অভূতপূর্ব ঘটনা’ হিসেবে লিপিবদ্ধ করা উচিত। ২০১৬ সাল থেকে এক ইংল্যান্ডেই অন্তত ৫ হাজার ৫০০ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হতে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করার ফলে মারা গেছেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ১৯৭০ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। আমাদের তো ক্ষোভপ্রকাশ করাই উচিত!
প্রধানমন্ত্রী, আপনি কি দয়া করে একমুহূর্তের জন্য নিজেকে একজন এনএইচএস (ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস) প্যারামেডিক, চিকিৎসক বা নার্স হিসেবে কল্পনা করতে পারেন, যখন অবস্থা এতটাই সঙ্কটাপন্ন যে অ্যাম্বুলেন্সকে গুরুতর রোগী নিশ্চিত করতে হয় এবং আমরা করিডোরে ট্রলিতে রোগীদের মারা যেতে দেখি? দয়া করে মাত্র একমুহূর্তের জন্য থামুন এবং আপনার অধীনে এনএইচএসে অপর্যাপ্ত বরাদ্দের মানবিক পরিণতি সম্পর্কে ভাবুন।
এনএইচএস মারাত্মকভাবে তহবিল ও কর্মীস্বল্পতায় ভুগছে এবং এটি আপনার ও আপনার সরকার দলের জন্যই। এই পদ্ধতিগত সমস্যাগুলো সংশোধনের বিষয়ে আপনার অস্বীকৃতিতেই এমন পাঁচ হাজারেরও বেশি ‘অভূতপূর্ব ঘটনা’ তৈরি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী, আপনি এই রোগীদের ব্যর্থ করেছেন এবং আপনার অবহেলা তাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী।
আপনি ও আপনার দল স্বাস্থ্যসেবা খাত যেভাবে পেয়েছিলেন তার চেয়ে আরও ভালো অবস্থায় রেখে যেতে প্রায় এক দশক সময় পেয়েছেন। কিন্তু প্রত্যেকটি হিসাবেই কনজারভেটিভ পার্টি ব্যর্থ হয়েছে, আমরা এনএইচএস হাসপাতালে সেটা প্রতিদিনই দেখতে পাই। ইংল্যান্ডে ৪০ হাজার নার্স ও ১০ হাজার চিকিৎসক কম রয়েছে, এঅ্যান্ডই’তে অপেক্ষা করার হার এনএইচএসের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে, ক্যান্সারের রোগীদের আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে বেশি অপেক্ষা করতে হচ্ছে, সামাজিক সেবার জগাখিচুড়ি অবস্থা, মানসিক সেবা পাওয়াই যায় না, আর জনগণকে সুস্থ ও হাসপাতালের বাইরে রাখার জন্য সম্প্রদায়ের বহু সেবাপ্রদান ক্ষমতা নষ্ট করেছেন। আপনার নীতিগুলোর প্রত্যক্ষ ফলাফল হিসেবে প্রায় ৫ হাজার ৫০০ মানুষ মারা গেছে। উত্তরাধিকারীদের জন্য এটাই রেখে যাচ্ছে ‘এক জাতি’র কনজারভেটিভ পার্টি।
আপনি যদি এগুলো ঠিক করতে চান, তবে কঠিন প্রশ্নের উত্তর দিতে ভয় পাওয়ায় লুকিয়ে লুকিয়ে ছবি তুলতে আমাদের হাসপাতালে আসা বন্ধ করুন। এর পরিবর্তে আমাদের চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের কথা শোনা শুরু করুন। আমেরিকান প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে আমাদের আরও বেসরকারিকরণের দরকার নেই। আমাদের বেশি দামি পরামর্শক এবং মধ্যসত্ত্বভোগী দরকার নেই।
আমাদের রয়্যাল কলেজ অব ইমার্জেন্সি মেডিসিনের সভাপতি ডা. ক্যাথরিন হেন্ডারসনের কথা শোনা দরকার। তিনি বলেছেন, ‘পার্লামেন্টের মাধ্যমে রোগীদের বারবার হতাশ করা হয়েছে যা ধারাবাহিকভাবে সমস্যার মাত্রা ধরতে ব্যর্থ হয়েছে… আমাদের কর্মীদের সীমা পার হয়ে গেছে… সবচেয়ে সহজ কথা- আমাদের আরও বেড প্রয়োজন, আরও কর্মী প্রয়োজন, আমাদের আরও সামাজিক যত্ন প্রয়োজন। রাজনীতিবিদদের অবশ্যই এটি করতে হবে।’
যখন কোনও হাসপাতালে ‘অভূতপূর্ব ঘটনা’ ঘটে, তখন জড়িত চিকিৎসকরা প্রায়ই দীর্ঘ তদন্তের শিকার হন এবং গুরুতর পরিণতিগুলোর প্রেক্ষিতে কখনও কখনও তাদের অনুশীলনের লাইসেন্স হারাতে হয়। নয় বছর মারাত্মক অবহেলার পর, নয় বছর ধরে ‘এক জাতি’র কনজারভেটিভ পার্টি কীভাবে এনএইচএস’কে আরও নিরাপদ, আরও দক্ষ ও উৎপাদনশীল করে তুলতে পারে তার বক্তৃতা দেয়ার পর আমরা দেখেছি টরি সরকার কী অর্জন করেছে: এনএইচএসের ইতিহাসে এঅ্যান্ডই’তে অপেক্ষাকালের সবচেয়ে খারাপ সময়, পৃথিবীর পঞ্চম ধনী দেশে করিডোরে লোক মারা যাচ্ছে।
এনএইচএস হাসপাতালে আমাদের কী প্রয়োজন তা নিয়ে আপনি আর বক্তৃতা দেয়ার উপযুক্ত নন। আপনি ব্রিটিশ জনগণকে ব্যর্থ করেছেন, আমার প্রিয় ওরচেস্টারশায়ার রয়্যাল হাসপাতালকে ব্যর্থ করেছেন এবং আপনার অবহেলার কারণে ট্রমায় ভোগা আমাদের পরিশ্রমী এনএইচএস কর্মীদের ব্যর্থ করেছেন। যেহেতু আমাদের রোগীদের সুরক্ষা এতটা হুমকির মুখোমুখি হয়েছে, তাই আমি চুক্তির ২৯ ধারায় হুইসেলব্লোয়ার হিসেবে আপনার অনুমোদিত চ্যানেলের বাইরে কথা বলার জন্য আমার অধিকার প্রয়োগ করছি। কারণ দেশের হাসপাতালগুলোতে এসব ঘটনা অসংখ্যবার ঘটছে এবং এর জন্য কে দায়ী তা জানার অধিকার ব্রিটিশ জনগণের রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী, এনএইচএস আপনার হাতে নিরাপদ নয়। আপনার এবং আপনার দলের গত এক দশকের অবহেলা প্রায় ৫ হাজার ৫০০ রোগীর মৃত্যুতে অবদান রেখেছে। আপনি যদি আমার মতো নবীন চিকিৎসক হতেন তবে আপনার লাইসেন্সটি এখন বাতিল করে দেয়া হতো এবং আপনাকে কারাগারে পাঠানো হতো।