সাংবাদিকতা না থাকলে করোনায় প্রাণহানি আরও বেশি হতো : ব্রিটিশ কলামিস্ট
করোনাভাইরাসের ফলে যুক্তরাজ্যে যে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, ১৯৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কখনও দেশটিতে এতো বিপুল সংখ্যক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। সবার জন্য উন্মুক্ত একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কতটা প্রয়োজনীয় তা দেখিয়ে দিয়েছে এ ভাইরাস। জিন ম্যাপিং, ভ্যাকসিন তৈরি আর বিজ্ঞানের কী হাল তা-ও দেখিয়ে দিয়েছে এটি। তবে এই সময়ে সবকিছু ছাপিয়ে যে বিষয়টি প্রমাণিত তা হচ্ছে, সাংবাদিকতা না থাকলে করোনায় প্রাণহানি আরও অনেক বেশি হতো। শুক্রবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য মিরর-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে এমন মতামত তুলে ধরেছেন খ্যাতনামা কলামিস্ট সুসি বোনিফেস।
ফ্লিট স্ট্রিট ফক্স ছদ্মনামে লেখা ওই নিবন্ধে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব, সরকারের এ সংক্রান্ত নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণ, লকডাউন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পর্যালোচনাসহ নানা বিষয় জনসাধারণের কাছে তুলে ধরতে সাংবাদিকদের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেন কলামিস্ট।
তিনি বলেন, কোনও ওষুধ কিংবা চিকিৎসকদের যাবতীয় প্রশিক্ষণ, করোনা ঝুঁকিতে থাকা সবাইকে বাঁচাতে পারেনি। তবে এটা ঠিক যে, সরকার বাসায় থাকার যে বার্তা দিয়েছে সেটা কাজে লেগেছে।
সুসি বোনিফেস বলেন, একটি ধনী দেশ তার নিজস্ব অর্থনীতিতে বিধিনিষেধ আরোপ করলেই লোকজন ঘরে বসে থাকে না। দারিদ্র্য মোকাবিলায় একটি ডানপন্থী সরকারের সমাজতান্ত্রিক পরিবর্তনকে আলিঙ্গনও খুব সহজ বিষয় নয়। ৬৬ মিলিয়ন মানুষকে ঘরে রাখার মতো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নও কষ্টসাধ্য। এর সবগুলো ক্ষেত্রেই সাংবাদিকদের প্রয়োজন রয়েছে। কেননা, সংবাদমাধ্যমগুলোই নানা বয়সের, নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে এসব বিষয়ে সচেতন করতে পারে।
দ্য গার্ডিয়ান, দ্য সান, ডেইলি মেইল, বিবিসি, চ্যানেল ফোর, স্কাই নিউজ, আল জাজিরার মতো খ্যাতনামা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেরও নাম উল্লেখ করেন সুসি বোনিফেস। তার নিবন্ধে সংবাদমাধ্যগুলোতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা উল্লেখ করা, চিকিৎসক, রোগীদের সার্বিক অবস্থা, তাদের মতামত, বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ প্রকাশের তাৎপর্য তুলে ধরা হয়।
সুসি বোনিফেস বলেন, সংবাদমাধ্যমগুলোতে রিপোর্টার, ফটোগ্রাফার, সহসম্পাদক, প্রডিউসার, প্রেজেন্টার, ফ্লোর ম্যানেজার, ক্যামেরা অপারেটর, সাউন্ড টেকনিশিয়ান, প্রিন্টার্স, ডিজাইনার, আর্টিস্ট এবং প্রযুক্তিগতভাবে, বাস্তবিকভাবে বা নৈতিকভাবে আরও অনেকেই সংশ্লিষ্ট। নানা ধাপে যাচাইয়ের পর খবরের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই তা প্রচার করা হয়।
এই কলামিস্ট মনে করেন, ইতিহাসের প্রথম খসড়া তৈরি করা একটি জটিল বিষয়। তাড়াহুড়ো করলে এটি দুর্ঘটনার দিকে নিয়ে যায়।
সুসি বোনিফেস উল্লেখ করেন, উহানে মহামারি ছড়িয়ে পড়ার নিরবতা ভেঙেছিল সাংবাদিকতা। যখন চীনা কর্তৃপক্ষ ভুল তথ্য প্রকাশ করছিল, বারবার একই তথ্য দিচ্ছিল তখনও তা সামনে আনে সাংবাদিকরা। যেখানেই এসব মিথ্যা প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে সেখানেই তা প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যমগুলো। ইরানে, উত্তর কোরিয়াতেও এসব সত্যি হয়ে উঠছে। চীন যেভাবে সত্য থামিয়ে রাখতে পারেনি সেভাবেই এসব দেশগুলোও এখন তা পারছে না।
সাংবাদিকদের প্রকাশিত খবর এক পর্যায়ে শোরগোল তোলে। এ নিয়ে তদন্ত হয় আর শেষ পর্যন্ত বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। সংবাদমাধ্যমগুলো দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চূড়ান্ত পরিস্থিতিও প্রকাশ করে।
এই ব্রিটিশ কলামিস্ট বলেন, সাংবাদিকতা না থাকলে মজুদ চলতে পারে, এমনকি লুটও হতে পারে। পুলিশ তার নতুন ক্ষমতা নিয়ে আরও উদ্দীপনার সঙ্গে ভুল করে যেতে পারে। পত্রিকায় বা সন্ধ্যার খবরে ছবি ছাপা হবে না জেনে মানুষ আরও বেশি সমুদ্রের তীরে যাবে। ফলশ্রুতিতে আরও বেশি সংক্রমণ হবে এবং আরও বেশি মৃত্যু হবে।
তিনি বলেন, আমরা নির্ভুল নই। আমরা আপনাদের প্রিয় পাত্র নই। আমরা কখনোই আপনাদের ধন্যবাদ দাবি করি না; কেবল চাই আপনারা আপনাদের চিন্তাগুলো শুনুন।
আমার মেয়ের একটি ত্রিমাত্রিক পাতার বই আছে। নাম দ্য স্টোরি অব এভরিথিং। বইটি শুরু হয়েছে বিগ ব্যাং দিয়েন আর পরে ব্যাকটেরিয়া, ডাইনোসর, বন মানুষ, কৃষি এবং শিল্প থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে। এর পাতায় পাতায় মাটির ঘর থেকে গ্লাস নির্মিত আকাশচুম্বী ভবন, আবার কারখানার দিকে মুখ করা জাহাজের ছবিও আছে। জাহাজের ওপর থাকা বক্সগুলোতে লেখা রয়েছে কাগজ ও কালি আর কারখানাটি হলো একটি প্রেসের।
প্রজাতি হিসেবে আমাদের অগ্রগতির সঙ্গে হাতে হাত ধরে এগিয়েছে সাংবাদিকতা। লেখার সক্ষমতা, প্রকাশ করা, গল্প করা, জানানো এবং এসব কিছুই আমাদের বিকাশে সাহায্য করেছে।
এই ব্রিটিশ সাংবাদিক উল্লেখ করেন, ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরের সুনামির খবর সংগ্রহের সময় আমি এবং ফটোগ্রাফার ব্রায়ান ক্যাসি অন্যান্য জায়গার পাশাপাশি মিয়ানমারেও গিয়েছিলাম। আমরা জানতে পেরেছিলাম কয়েকজন ব্রিটিশ নাগরিক থাই সীমান্তের কাছে তাদের ভিসা নবায়ন করতে গিয়েছিলেন। তারা হয়তো ঢেউয়ের কবলে পড়ে থাকতে পারে বলেও শুনতে পেলাম। নদীর ওপারে যেতে আমরা একটি নৌকা ও একজন অনুবাদক যোগাড় করলাম। কয়েকজন স্থানীয়কেও পেলাম। আপনারা ঢেউ দেখেছেন? জানতে চাইলাম আমরা। কোনও বিদেশিকে দেখেছেন?
মিয়ানমারের এসব নাগরিকেরা তাদের গ্রাম চেনে আর হয়তো পাশের গ্রামটি। তারা তাদের জাতি, তাদের অঞ্চল, তাদের সরকার এমনকি কাছাকাছি শহর সম্পর্কেও কিছু জানে না। এটা ছিল একটা পশ্চাৎপদ অঞ্চল। সেখানে সাংবাদিকতা ছিলো না আর সে কারণে কোনও জ্ঞান নেই, যাচাই নেই, গণতন্ত্র বা অন্য হাজার প্রকারের জিনিস নেই।
অনেকেই অভিযোগ করে থাকেন সাংবাদিকতা একটা সমস্যা। সন্ত্রাসী, অসদাচরণ করা রাজনীতিবিদ, অপরাধী, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার আন্দোলনকারী ও সেলিব্রেটিরা একে সমস্যা বলে অভিযোগ করে থাকেন। তাদের কারও কারও জন্য সাংবাদিকের ওপর হামলা করা হেডলাইনে আসার নিশ্চয়তা দেয়, বিক্রি বাড়ার নিশ্চয়তা দেয় এমনকি সমর্থকও বাড়তে পারে।
অন্য যেকোনও কাজের চেয়ে সাংবাদিকতাই যে সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে তা প্রমাণ করার আর কোনও উপায় নেই। সে কারণে আমরা ওষুধ, শিক্ষা, স্যানিটেশন ও রাজনীতির পাশাপাশি আমাদের কাজ চালিয়ে যাই। সে কারণেই আমরা গুরুত্বপূর্ণ কাজের তালিকায় থাকি। আর সে কারণে আমাদেরও করোনাভাইরাসে ধরে।