ভাইরোলজিস্টের সাক্ষাৎকার: করোনাভাইরাস ঠিক কবে থামবে?
পৃথিবীর তিন ভাগের একভাগ মানুষ এখন পুরোপুরি লকডাউনে। করোনাভাইরাসের কূল-কিনারা খুঁজতে গিয়ে পৃথিবীর বিখ্যাত সব বিজ্ঞানী, গবেষক, চিন্তক এক গভীর অন্ধকারে ডুবে গেছেন। এক দেশ থেকে আরেক দেশ, এক মানুষ থেকে আরেক মানুষের ওপর বাছ-বিচারহীনভাবে করোনাভাইরাস ঘটিয়ে চলেছে তার বিস্তার। কবে, কীভাবে থামবে করোনা সংক্রমণ? এখনো এর কোনো সদুত্তর নেই কারো কাছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের পক্ষ থেকে বিশ্বখ্যাত ভাইরোলজিস্ট গুইডো ভ্যানহ্যামের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে মাত্র দুটি প্রশ্নকে ভিত্তি করে। সাক্ষাৎকারটি ভাষান্তর করেছেন মিজান রহমান।
করোনাভাইরাস ঠিক কীভাবে থামবে বলে মনে হয়?
এক অর্থে বলতে গেলে, এই ভাইরাস আসলে থামবে না যতক্ষণ না আমরা তা থামাতে পারি। যতক্ষণ না আমরা এই ভাইরাসকে নির্মূল করতে পারি, ততক্ষণ পর্যন্ত ভাইরাস তার বিস্তৃতি বাড়াতেই থাকবে। এই ধরনের ভাইরাসকে নির্মূল করতে আমাদের দরকার খুবই কার্যকরী প্রতিষেধক, যা প্রতিটি মানুষের ওপরে প্রয়োগ করতে হবে। এ রকম গণহারে প্রতিষেধক প্রয়োগ এখন পর্যন্ত কেবল স্মলপক্সের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়েছে। তাতেও লেগে গেছে অনেক বছর।
সুতরাং বলা যায়, এই ভাইরাস আপাতত থেকে যাচ্ছে। এই ভাইরাস একটি ভাইরাস পরিবারের সদস্য, আমরা এখন অনেকেই জানি, সেই ভাইরাস পরিবার হলো করোনাভাইরাস। এখন এই ভাইরাস অন্যান্য ভাইরাস থেকে আলাদা কী ধরনের আচরণ করে সেটা দেখা। হতে পারে এটা প্রতিবছর ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ফিরে ফিরে আসবে। শীত, বসন্ত, শরতে এটা হয়তো নিয়ন্ত্রণহীন আচরণ করবে আবার গ্রীষ্মে কিছুটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে। এখন আমাদের দেখতে হবে বিভিন্ন ঋতুতে এর কী প্রভাব পড়ে।
কিন্তু, একটি বিষয়ে এই মহামারি এক ধরনের দ্বিধায় ফেলে দিচ্ছে। স্পেন ও ইতালি সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দুটি দেশ। তাদের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ ও ২৬ শতাংশ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। যদি ৫০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি হয়ে যায় তখন প্রাকৃতিকভাবেই হয়তো মহামারি থেমে যাবে। অতীতকালে বিভিন্ন মহামারিতে যখন চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার হয়নি, তখন এমনটিই ঘটেছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার ও মানুষের প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর নিরীক্ষা করে বলা যাবে এই ভাইরাসের প্রকোপ ঠিক কীভাবে থামবে।
মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতার ক্ষেত্রে তাহলে কী কী বিষয় কাজ করবে? আমরা এ বিষয়ে কতটুকু জানি?
আমরা জানি, এটি অত্যন্ত সংক্রামক একটি ভাইরাস। এখন পৃথিবীর প্রায় সবাই এটি জানেন। আমরা যা জানি না তা হলো, এই সংক্রমণের মাত্রা। এটি জানতে আমাদের আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার হবে।
আমরা জানি, মানুষের দেহে এন্টিবডি তৈরি হয়। এই এন্টিবডি ভাইরাসের বিরুদ্ধে কিছুটা যুদ্ধ করে। আমরা চীনের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি দেখেছি। কিন্তু, এই এন্টিবডি আসলে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কতটা যুদ্ধ করতে পারে তা এখনো আমরা নিশ্চিত না। যারা একবার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, তারা সুস্থ হওয়ার পর আবারো আক্রান্ত হচ্ছেন কি না, এমন কোনো উপাত্ত আমাদের হাতে খুব বেশি নেই। যেহেতু সুস্থ হওয়ার পর নতুন করে আক্রান্ত হওয়ার তেমন উল্লেখযোগ্য সংবাদ নেই, আমরা ধরে নিতে পারি এন্টিবডি কাজ করছে।
কিন্তু এটা কতদিন, কত মাস বা কত বছর কাজ করবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। ভবিষ্যতে এই মহামারির বিষয়ে আমাদের এই তথ্যের ওপর কিছুটা নির্ভর করতে হবে। তবে আপাতত যেটা মনে হচ্ছে, আমরা এর মাত্রা কমিয়ে আনতে পারি, আমরা হয়তো পরিসংখ্যানের সংখ্যাগুলোকে কিছুটা কমাতে পারি। তবে এটাকে একেবারে নির্মূল করতে পারবো না। কারণ, এক পর্যায়ে গিয়ে আমাদেরকে ঘর থেকে বের হতে হবে। আমাদের কাজে যেতে হবে। আমাদের স্কুলে যেতে হবে। যদিও আমরা কেউ জানি না, সেটা কবে সম্ভব।
ততদিনে এই ভাইরাস তার বিস্তৃতি ঘটাতেই থাকবে। যতদিন না কার্যকর প্রতিষেধক আবিষ্কার হচ্ছে, ততদিন এই মহামারিতে আক্রান্ত মানুষ তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়ে যতটুকু নিজেকে রক্ষা করতে পারে। আমরা অবশ্যই একটি পথ খুঁজে পাব। কিন্তু, এর জন্য হয়তো আমাদের এক বছর কিংবা তার কাছাকাছি সময় লেগে যেতে পারে।
এটি এখন পর্যন্ত একটি অমীমাংসিত প্রশ্ন যে, এই ভাইরাসকে সহ্য করার সক্ষমতা মানুষের কেমন। বয়স একটি বড় বিষয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা স্বাভাবিকভাবে কমে যায়। কম বয়স্কদের ঝুঁকির বিষয়টিও এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। অন্যান্য রোগের কারণে তাদেরও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ঘাটতি থাকতে পারে।
ক্যানসার কিংবা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির যে কোনো সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থেকে। এ ছাড়া, উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন যারা, তারাও বড় ধরনের ঝুঁকিতে থাকেন। আরেকটি বিষয়ে আমাদের আগ্রহ আছে— এমন কোনো মানুষ আছেন কি না যিনি সংক্রমিত হচ্ছেন কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ছেন না। এটি হয়তো কয়েক মাস পর জানা যাবে। চীনে এ বিষয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এরপর হয়তো এই ভাইরাসের সঙ্গে এন্টিবডির সহাবস্থানের বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
কিছু মানুষ আছেন যাদের এন্টিবডি শক্তিশালী হওয়ায় চিকিৎসা সেবা নিতেই হয় না। তারা সব সময় সুস্থ থাকেন। চীনে এ বিষয়ে ক্লু পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে আপনার রক্তের গ্রুপ হয়তো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠতে পারে। তবে এটি খুবই প্রাথমিক স্তরের তথ্য। এখন থেকে এক বছর কিংবা তার কিছু পরে হয়তো আমরা এ বিষয়ে আরও অনেক তথ্য হাতে পাব।