সৌন্দর্যের নামে রাজধানীজুড়ে বিজ্ঞাপনের জঞ্জাল

0

নিয়ম অনুযায়ী সিটি করপোরেশন এলাকায় ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে প্রতি বর্গফুটের জন্য গুনতে হয় বিশ হাজার টাকা। অথচ কোনো প্রকার রাজস্ব দেওয়া ছাড়াই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় সৌন্দর্যবর্ধনের নামে ছোট-বড় বিলবোর্ড বসিয়ে বিজ্ঞাপনের জন্য ভাড়া দিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ হওয়ার পর থেকেই ১৩টি ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এই কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। ডিএনসিসি’র বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কিছু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে সড়ক ও সড়ক বিভাজনে সৌন্দর্যবর্ধনের অনুমতি নিয়েছে তারা। এরপর নামমাত্র কিছু গাছ লাগিয়ে ও কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে সেখানে বড় আকারের এলইডি বিলবোর্ড বসিয়ে বিজ্ঞাপনের জন্য ভাড়া দিচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান। এদিকে সড়কের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও তাতে করপোরেশনের স্বার্থরক্ষা হয়নি বলে জানিয়েছেন স্বয়ং ডিএনসিসি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবদুল হাই। তার ভাষ্য, ওইসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে করা চুক্তিপত্রে নানা জটিল শর্তের বেড়াজাল থাকায় সব জেনেও ডিএনসিসি কর্র্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না।

ডিএনসিসির কর্মকর্তারা জানান, গুলশান-২ নম্বর গোলচত্বর থেকে কাকলী মোড় পর্যন্ত কন্টিনেন্টাল হোল্ডিং লিমিটেড, কারওয়ান বাজার সার্ক ফোয়ারা ওজন ব্লু বাংলাদেশ লি., মহাখালী ফ্লাইওভারের ওপরে ও নিচে ইউনিকম মিডিয়া লিমিটেড, বিজয় সরণি র‌্যাংগস মোড় ফোয়ারা থেকে এরোপ্লেন মোড় পর্যন্ত আরকে মাল্টিমিডিয়া, মিরপুর-১০ নম্বর থেকে মিরপুর ১৪ নম্বর মোড় হয়ে কচুক্ষেত রজনীগন্ধা সুপার মার্কেট পর্যন্ত সাইনভ্যালি, ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর সড়ক থেকে গণভবনের সামনের রাস্তা ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, শ্যামলী শিশুমেলা থেকে টেকনিক্যাল মোড় হয়ে মিরপুর-১ নম্বর গোলচত্বর পর্যন্ত বিলিভ আস ক্রিয়েশন, গুলশান-২ গোলচত্বর থেকে নতুন বাজার পর্যন্ত আরকে মাল্টিমিডিয়া, হাতিরঝিল সংলগ্ন হাবিব ইন্টারন্যাশাল লি.-এর সামনে থেকে সাতরাস্তা ফ্লাইওভারের নিচ পর্যন্ত হাবিব হোটেল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, রামপুরা বনশ্রী রোডের শুরুতে ও বিটিভির নতুন ভবনের সামনের গোলচত্বরে মৃণাল হক, মানিক মিয়া এভিনিউ গোলচত্বরে মৃণাল হক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিপরীত পাশে মৃণাল হক এবং সনি সিনেমা হল থেকে চিড়িয়াখানা পর্যন্ত সড়কটির সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করার অনুমতি পেয়েছে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান। এসব এলাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও সড়কদ্বীপে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের প্রতিষ্ঠান ছাড়াও টাকার বিনিময়ে অন্য কোম্পানির বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। আর এসব বিজ্ঞাপন দিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানগুলো হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের অর্থ।

ডিএনসিসির কর্মকর্তারা জানান, সিটি করপোরেশনের ডিজিটাল বিলবোর্ড ইজারা দেওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে একটি পরিপত্র জারি করা হয়। সেখানে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন-২০০৯ এর ধারা ৮৪ বলে সরকার আদর্শ কর তফসিল প্রণয়ন করে। সেই তফসিলের ২৯৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বিজ্ঞাপনের ওপর কর আরোপের বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। এ অনুচ্ছেদের (১) এ বলা হয়েছে, সিটি করপোরেশনের নিজস্ব জমি বা ইমারতের এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় সরকারি বা আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের জমি বা ইমারতের বছরভিত্তিক অনুমোদন বা নবায়নযোগ্য বিজ্ঞাপন ফলকের ক্ষেত্রে (ঘ) এলইডি সাইনের ইজারামূল্য প্রতি বর্গফুট ২০ হাজার টাকা। মূলত এই আইন এড়িয়ে বিনা টাকায় বিজ্ঞাপন প্রচারে সৌন্দর্যবর্ধনের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, মূলত ডিএনসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের লোকজন নামে-বেনামে এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে ডিএনসিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, কারওয়ান বাজার সার্ক ফোয়ারায় ৪টি বিশাল আকারের এলইডি বিলবোর্ড বসানো হয়েছে। বিউটিফিকেশনের নাম দিয়ে তারা এ বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপন দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। একইভাবে মহাখালী থেকে জাহাঙ্গীর গেট ও বনানী কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ে কিছু প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। তারা শুধুমাত্র কাঁটাতারের বেড়া ও নামমাত্র কিছু গাছ লাগিয়ে পুরো রাস্তা বিজ্ঞাপনের জন্য ধরে রেখেছে। ডিএনসিসির সঙ্গে করা চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তাদের সড়কের চারপাশে ৫০ ফুট এলাকায় অন্য কোনো বিজ্ঞাপন দেওয়া যাবে না। আর এসব শর্তের বেড়াজালে ডিএনসিসির রাজস্বের মুনাফা এখন অন্য মানুষের পকেটে যাচ্ছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা (উপসচিব) আব্দুল হামিদ মিয়া বলেন, ‘ডিএনসিসি এলাকায় যে কোনো বিজ্ঞাপন দিতে হলে আইন অনুযায়ী সরকারি বা আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের জায়গায় প্রতি বর্গফুট ২০ হাজার টাকা করে কর দিতে হবে। আর কোনো ব্যক্তিগত জমি বা স্থাপনায় এ বিজ্ঞাপনের দর ১০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু বিউটিফিকেশনের নামে নামকাওয়াস্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ১৩টি প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন ব্যবসা করে যাচ্ছে। আইনগত দিক দিয়ে এ ধরনের ব্যবসার বৈধতা দেওয়ার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় নিয়ে করপোরেশন কাজ শুরু করেছে।’

অন্যদিকে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবদুল হাই বলেন, ‘বিউটিফিকেশনের নামে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, এতে করপোরেশনের স্বার্থরক্ষা হয়নি। নানা অসংগতিপূর্ণ শর্ত দিয়ে তাদের বিজ্ঞাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এমন সব শর্ত জুড়ে দেওয়া আছে যে ডিএনসিসি চাইলেও এক বছরের মধ্যে শর্ত বাতিল করা সম্ভব না। তাই তাদের সঙ্গে করপোরেশনের করা চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে তা আর বাড়ানো হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিজ্ঞাপন ও বিউটিফিকেশন মূলত রাজস্ব বিভাগ থেকে দেখভাল করা হয়ে থাকে। কিন্তু এ ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দিয়েছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে। কীভাবে এ কাজটি হলো তাও বুঝতে পারছি না।’

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com