বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফের হত্যাকাণ্ড আবার আলোচনায়, ভারতের সুপ্রিম কোর্টে শুনানির প্রস্তুতি
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ভারত ও বাংলাদেশকে বিভক্তকারী কাঁটাতারের বেড়ার ওপর ঝুলন্ত অবস্থায় ১৫ বছর বয়স্কা মেয়েটির লাশ দেখা যায়। তার বুকে গুলি লেগেছিল। ফেলানীর লাশটি কয়েক ঘণ্টা ঝুলেছিল, লোকজন জানিয়েছে যে সে পানির জন্য কাতর মিনতি জানিয়েছিল।
নিরস্ত্র, সহায়হীন ফেলানীকে হত্যার কারো বিচার হয়নি, কাউকে দায়ী করা হয়নি। ফেলানীকে গুলি করার জন্য অভিযুক্ত করা হয় ভারতীয় সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর কনস্টেবল অমিয় ঘোষকে। তিনি তখন ‘বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী’ বাংলাদেশের সাথে থাকা সীমান্তে ‘অ্যাম্বুশ অ্যান্ড পেট্রোল ডিউটিতে’ ছিলেন। ২০১৩ সালে তার বিচারের সময় জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্স কোর্ট তাকে রেহাই দেয়। দুই বছর পর রিভিশন বিচারে তাকে খালাস দেয়া হয়। ফেলানীর মা-বাবা থাকেন বাংলাদেশের কুড়িগ্রামের একটি গ্রামে। তাদেরকে বিচারপ্রক্রিয়া দেখার জন্য সেখানে যাওয়ার অনুমতি পর্যন্ত দেয়া হয়নি। তবে ফেলানীর বাবা মোহাম্মদ নূর ইসলাম কখনো বিচারের আশা ত্যাগ করেননি।
আগামী ১৮ মার্চ ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নূর ইসলামের আবেদনের ওপর শুনানি হবে। তিনি ফেলানীর মৃত্যু নিয়ে এসআইট বা সিবিআইয়ের নতুন করে তদন্তের আবেদন জানিয়েছেন। কনস্টেবল ঘোষের বিরুদ্ধে মামলা আবার শুরু হবে কিনা ও ফেলানীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি নিয়েও রায় দেবে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। নূর ইসলামকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা মাসুম (মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ)। এই সংগঠনের সাথেই যৌথভাবে আবেদন করা হয় সুপ্রিম কোর্টে। রাষ্ট্র যদি সীমান্ত তৈরী করে, প্রতিবেশী দেশগুলোতে টহল দিয়ে ভীতির সঞ্চার করে, তবে সাধারণ নাগরিকেরা তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করবে।
বিশ বছর আগে ২০০০ সালের জানুয়ারিতে আন্তঃসীমান্ত বিচারের আরেক ঘটনায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বাংলাদেশী এক নারী যাত্রীকে ১০ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ দেয়ার কলকাতা হাইকোর্টের রায় বহাল রেখেছিল। কলকাতার হাওড়া স্টেশনে তিনি ধর্ষিতা হয়েছিলেন। আদালত তার ঐতিহাসিক রায়ে বলেছিল, এমনকি যারা এই দেশের নাগরিক নন এবং এখানে এসেছেন স্রেফ পর্যটক হিসেবে… তারাও সাংবিধানের বিধান অনুযায়ী তাদের জীবন সুরক্ষার অধিকারী হবেন।
এই মামলায় কলকাতা ও দিল্লির আইনজীবী ও অ্যাক্টিভিস্টদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনোভাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এমনকি ঢাকাভিত্তিক বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী পরিষদও সমর্থন দিয়েছিল।
অভিবাসন ও সম্পদে সুযোগ
ওই ভয়াবহ দিনে ফেলানী পশ্চিমবঙ্গের কুচ বিহার জেলার অনন্তপুর সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে চেয়েছিল। আসামে গৃহকর্মীর কাজ করত সে। বিয়ে করতে সে দেশে ফিরছিল। তার বাবা মইয়ের সাহায্যে বেড়া ডিঙাতে পারলেও ফেলানীর পোশাক কাঁটাতারে আটকে যায়। তার ভীতিকর কান্নায় সতর্ক হয়ে ওঠে ১৮১ ব্যাটালিয়নের অমিয় ঘোষ গুলি চালিয়ে দেন।
নূর ইসলাম ও ফেলানীর মতো গরিব অভিবাসীদেরকেই ভারতের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ‘উইপোকা’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। ২০১৫ সালে ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ফেলানীর পরিবারকে ৫ লাখ রুপি প্রদান করার নির্দেশ দেয়। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ ছিল, নিরস্ত্র একটি বালিকাকে গুলি করার কোনো অজুহাত থাকতে পারে না। সংস্থাটি জানায়, সীমান্তে স্পর্শকাতর দায়িত্ব পালনের সময় নিরাপত্তা বাহিনীকে অবশ্যই কিছু শৃঙ্খলা ও রীতিনীতি অনুসরণ করতে হবে।
সংস্থাটি ২০১৫ সালের ৫ মে বিএসএফ সদরদফতরে এক নির্দেশে জানায়, তাদেরকে নিরস্ত্র নারী ও শিশুদের সাথে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের পার্থক্য করতে হবে। আর নিরস্ত্র একটি বালিকার ক্ষেত্রে বিএসএফের যে কনস্টেবল গুলি করেছে সে অবশ্যই বিএসএফ সদরদফতরের ইস্যু করা নির্দেশিকার লঙ্ঘন করেছে।
তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ক্ষতিপূরণ করার নির্দেশ অনুসরণ করেনি। নূর ইসলাম আশা করছেন যে মার্চে সুপ্রিম কোর্টের শুনানিতে ফেলানী ন্যায়বিচার পাবে।
মাথা ঝোলানো, বাতাসে চুল দুলতে থাকা ফেলানীর সাহায্যের কাতর আবেদন ভারতের কোনো সংবাদপত্রে প্রথম পৃষ্ঠায় শিরোনাম হওয়ার মতো খবর বিবেচিত হয়নি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সরকারগুলোর নজরেও তা পড়েনি। ঢাকাভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অধিকার এনিয়ে এক প্রতিবেদনে উপমহাদেশের অবচেতন মনের কথাই প্রকাশ করেছে এভাবে: ফেলানী নয়, বাংলাদেশই ঝুলছিল।
মাসুমের সচিব কিরীটি রায় বলেন, সীমান্ত অঞ্চলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইয়ের প্রতীক হলো ফেলানী। বিএসএফের হত্যার জন্য গুলি করার নীতি আমাদের বিচারব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ২০১২ সাল থেকে সংগঠনটি সীমান্ত এলাকায় নির্যাতন ও সহিংসতার ঘটনার নথিপত্র সংগ্রহ করে আসছে। কিরীটি রায়ের মতে, বিএসএফ প্রতি বছর পশ্চিমবঙ্গ (বাংলাদেশের সীমান্ত থাকা ৫ রাজ্যের একটি) সীমান্তেই ১৮০-২০০ লোককে হত্যা করে। এদের বেশির ভাগই ভারতীয়। মাসুমের তদন্তে দেখা যায়, ২০১১-২০১৯ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে বিএসএফের হত্যাকাণ্ডের অন্তত ৮৬টি ঘটনা দেখতে পেয়েছে।
নির্যাতন ও নির্বিচার হত্যাকাণ্ড
নির্যাতন, নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ও অপহরণের অভিযোগ রয়েছে বিএসএফের বিরুদ্ধে। বিএসএফের হামলার শিকার বেশ কয়েকজন অভিযোগ করেছেন যে বিএসএফ কোনো ধরনের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ না করেই নির্বিচারে গুলি করে। প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বিএসএফের কোনো সদস্যের বিচার করা হয়নি।
সীমান্তে গরু পাচারের সময় কুচবিহারের সুকারুরকুটি গ্রামের রবিবুল শেখ (২৭) ২০১৯ সালের ৯ জুলাই বিএসএফের হামলার শিকার হন। গুলি তার মাথার পেছন দিকে আঘাত করে। ২০১৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশে গরু পাচারের সময় একদল লোক বিএসএফের হামলার শিকার হয়। সফিকুল ইসলাম নিহত হন গুলিতে। গাদাধর নদী থেকে পাথর দিয়ে বাঁধা অবস্থায় ৪টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
এসব লোক তাদের জীবন যাপন করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত অতিক্রমের কাজ করেন নিয়মিত। তাদের ধর্ম ও অর্থনৈতিক অবস্থাও বিচার প্রাপ্তি থেকে অগ্রাহ্য হওয়ার কারণ। নিহত বা নির্যাতনের শিকার লোকজন হয় মুসলিম বা নিম্ন বর্ণের লোক।
যারা বলেন যে হাজার হাজার বাংলাদেশী ভারতে অবৈধভাবে বাস করছে, তারা এ কথা ভুলে যান যে ভারতীয়রা ফেলানী ও তার বাবার মতো সস্তা শ্রমিকদের শোষণ করছে। সীমান্তে বিএসএফ মোতায়েন করা হয়েছে মাদক, জাল মুদ্রা, গরু ও অস্ত্র চোরাচালানি রুখতে, কিন্তু সীমান্তের উভয় পাড়ের লোকজন মনে করে, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের তৈরী এই ‘লাইন’ অন্যায়ভাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কারণ এটি গেছে ধানক্ষেত, গ্রাম, বাজারের ওপর দিয়ে। বন্ধু, স্বজন ও বাণিজ্যের জন্য এসব স্থানে তাদের যেতেই হয়।