হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধানে যৌথ দল গঠনের সিদ্ধান্ত
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান ও পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনতে ১০টি বিশেষ যৌথ তদন্ত দল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই সঙ্গে এসব দল সাবেক সরকারের ঘনিষ্ঠ ১০ ব্যবসায়ী গ্রুপের দুর্নীতি অনুসন্ধানের পাশাপাশি পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনতে পদক্ষেপ নেবে। প্রতিটি দল হবে তিন সদেস্যর। এর মধ্যে একজন করে দলনেতা থাকবেন ও দুজন সদস্য থাকবেন। দুদক, সিআইডি ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সমন্বয়ে এসব দল গঠন করা হবে। অচিরেই দলগুলো কাজ শুরু করবে।
বৃহস্পতিবার দুদকের এক বিশেষ সভায় এসব দল গঠন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পরে আরও একটি বিশেষ দল গঠন করার পরিকল্পনা রয়েছে সংস্থাটির। এর আগে ব্যাংক লুটের ঘটনা উদঘাটন ও পাচার করা সম্পদের তথ্য সংগ্রহ করতে ১০টি বিশেষ টিম গঠন করা হয়। দুদক, সিআইডি ও এনবিআরের সমন্বয়ে এসব টিম গঠন করা হয়েছে। টিমগুলোর সার্বিক কর্মকাণ্ড সমন্বয় করছে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)। ইতোমধ্যে এসব টিম কাজ শুরু করেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে ওই সরকারের আমলে ঘটা দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করে। প্রথমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএফআইইউ তদন্তে ব্যাংক লুট ও টাকা পাচারের ঘটনা এবং পরে আরও ব্যাপক দুর্নীতির চিত্র বেরিয়ে আসে। গত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে দেশে এত বেশি দুর্নীতি হয়েছে যে, সেগুলো শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএফআইইউর পক্ষে তদন্ত করা সম্ভব নয়। যে কারণে তদন্তের ব্যাপকতা বাড়ানো হয়। এর অংশ হিসাবে বৃহস্পতিবার দুদক আরও ১০টি বিশেষ দল গঠন করার সিদ্ধান্ত নিল।
গত মঙ্গলবার বিএফআইইউ’র পক্ষ থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের ৭ সদস্যের নামে ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়া হয়েছে। পরিবারের অন্য সদস্যরা হলেন-তার বোন শেখ রেহানা, তার (শেখ হাসিনা) ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ। এছাড়া শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক, মেয়ে টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিকের ব্যাংক হিসাবেরও তথ্য চাওয়া হয়েছে। তাদের নামে ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোতে কোনো হিসাব থাকলে সেসবে লেনদেন, জমা টাকা, ব্যাংক হিসাব খোলার ফরম ও কেওয়াইসির ফরম চাওয়া হয়েছে। এর আগে আওয়ামী লীগের গবেষণাধর্মী সংগঠন সিআরআইয়ের ট্রাস্টি হিসাবে তাদের ব্যাংক হিসারে তথ্য চাওয়া হয়। এবার চাওয়া হলো সরাসরি দুর্নীতির অভিযোগের তথ্য।
সূত্র জানায়, এর আওতায় সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ও বিগত সরকারের সুবিধাভোগী নয় এমন শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোর দুর্নীতির অনুসন্ধান করা হবে। পাশাপাশি তারা যদি টাকা পাচার করে থাকেন সেগুলো কীভাবে দেশে ফিরিয়ে আনা যায় সে বিষয়েও পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
দুদক মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, নামে-বেনামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে সাবেক মন্ত্রী-এমপিরা যে অস্বাভাবিক লেনদেন করেছেন তার সঙ্গে কোনো ব্যাংক কর্মকর্তা জড়িত থাকলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।
তিনি আরও জানান, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ মেগা প্রকল্প থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে দুদকের অনুসন্ধানে। শিগগিরই শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হবে।
অভ্যুত্থানের মুখে পালানোর পর থেকে শেখ হাসিনার বিভিন্ন দুর্নীতির তথ্য উঠে আসে। এর মধ্যে মেগা প্রকল্প, প্লট বরাদ্দ কিংবা বিদেশে অর্থ পাচারসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এমন পেক্ষাপটে দুদকের নেতৃত্বে এসব যৌথ তদন্ত দল গঠন করা হলো। দলগুলোর কাজ হবে-এস আলম, বেক্সিমকো, বসুন্ধরাসহ বিগত সরকারের সুবিধাভোগী নয় ব্যবসায়ী গ্রুপের অনিয়ম তদন্ত করা। এর মধ্যে দুই তদন্ত কমিটি তদারকি করবে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারে সদস্য এবং সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের দুর্নীতির বিষয়টি। পাশাপাশি তারা দেশ থেকে কোথায় কীভাবে টাকা পাচার করেছেন, সেসব টাকা কীভাবে দেশে ফিরিয়ে আনা যায় সে বিষয়েও পদক্ষেপ নেবে।
এর আগে গত ডিসেম্বরে দেশের আলোচিত ১০টি শিল্প গ্রুপের বিদেশে পাচার করা অর্থের অনুসন্ধান ও পাচার করা অর্থ ফেরাতে সরকারের তিন সংস্থার সমন্বয়ে ১০টি যৌথ টিম গঠন করা হয়। সরকারি তিন সংস্থা হলো-দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এই তিন সংস্থার কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত টিম ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। তাদের আইনি সহায়তা দিচ্ছেন অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস। পুরো কাজটি সমন্বয় করছে বিএফআইইউ।
সূত্র জানায়, অনুসন্ধানের তালিকায় আছে বেক্সিমকো গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, জেমকম গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, শিকদার গ্রুপ ও আরামিট গ্রুপ। এছাড়া এ তালিকায় সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের নামও রয়েছে। এসব গ্রুপ, গ্রুপের কর্ণধার ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নাম দুদকের এবারের তালিকায়ও রয়েছে। এসব গ্রুপ ও ব্যক্তিারা কীভাবে দুর্নীতি, ব্যাংক থেকে টাকা লুট করেছেন। সেগুলো কীভাবে বিদেশে পাচার করেছেন। এর সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবার কীভাবে জড়িত সেসব যোগসূত্র তদন্তের মাধ্যমে বের করা হচ্ছে। এর ভিত্তিতে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা করার পাশাপাশি পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, এসব গ্রুপ ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাবে লেনদেনের তথ্য সংগ্রহ করেছে বিএফআইইউ। তাদের নামে ব্যাংক থেকে বেআইনিভাবে ঋণ নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে মিলেছে সেন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য। এর মাধ্যমে তারা অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। সরকারি খাতের রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন। অর্থ পাচারের দায়ে সন্দেহভাজন হিসাবে চিহ্নিত। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী এসব গ্রুপ ও ব্যক্তির বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। এর বাইরে তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের নামেও তদন্ত করা হচ্ছে। এসব টিমকে আইনি সহায়তা দেবে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়।
অনুসন্ধানের আওতায় থাকা তালিকায় রয়েছে ব্যাংক দখল, ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের ঘটনা। এসব ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী গ্রুপের সম্পদের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ, ঋণের ব্যবহার, অর্থের গতিপথ, তাদের ব্যবসায়িক ও অন্যান্য লেনদেন, ঋণের সুবিধাভোগীসহ বিভিন্ন বিষয়ে অনুসন্ধান চালানো হবে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে তাদের বিষয়ে তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এর আলোকে কিছু তথ্যও ইতোমধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে।