কোরআন-সুন্নাহর দৃষ্টিতে কথা বলার কতিপয় উত্তম আদব রয়েছে-
কথা বলার আগে ব্যক্তি চিন্তা করবে, আগে অন্যের কথা শুনবে, এটি হলো কথা বলতে পারার যথাযথ ব্যবহার। এটা স্মরণে রাখতে হবে, যে কথাটিই সে উচ্ছারণ করছে, আল্লাহর কাছে এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। কথা বলার সুযোগ থাকা সস্ত্বেও চুপ থাকা উত্তম। কোরআন-সুন্নাহর দৃষ্টিতে কথা বলার কতিপয় উত্তম আদব রয়েছে। তাহলো-
১. فَاِذَا دَخَلۡتُمۡ بُیُوۡتًا فَسَلِّمُوۡا عَلٰۤی اَنۡفُسِکُمۡ تَحِیَّۃً مِّنۡ عِنۡدِ اللّٰهِ مُبٰرَکَۃً طَیِّبَۃً
যখন তোমরা ঘরে প্রবেশ করবে তখন তোমরা (কথা বলার আগে) তোমাদের স্বজনদের প্রতি সালাম করবে অভিবাদন স্বরূপ, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে কল্যাণময় ও পবিত্র।’ (সুরা নুর : আয়াত ৬১)
২. সতর্কতার সঙ্গে কথা বলা কেননা প্রতিটি কথাই রেকর্ড করা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন-
مَا یَلۡفِظُ مِنۡ قَوۡلٍ اِلَّا لَدَیۡهِ رَقِیۡبٌ عَتِیۡدٌ
‘যে কথাই মানুষ উচ্চারণ করে (তা সংরক্ষণের জন্য) তার কাছে একজন সদা তৎপর প্রহরী আছে।’ (সুরা কাফ : আয়াত ১৮)
৩. সুন্দরভাবে উত্তমরূপে কথা বলা। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ قُوۡلُوۡا لِلنَّاسِ حُسۡنًا
‘আর তোমরা লোকের সাথে উত্তমভাবে কথা বলবে।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ৮৩)
৪. অনর্থক ও বাজে কথা পরিহার করা। কথা বলা যেমন সবচেয়ে বড় পুণ্য আবার কথা বলা সবচেয়ে বড় পাপের কাজও বটে। যে ব্যক্তি এই বাস্তবতা উপলব্ধি করবে, তার কথা বলা যেমন অর্থবহ হবে, তেমনই তার চুপ থাকাও হবে অর্থবহ।
৫. নিচু স্বরে কথা বলা। আল্লাহ তাআলা বলেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَرۡفَعُوۡۤا اَصۡوَاتَکُمۡ فَوۡقَ صَوۡتِ النَّبِیِّ وَ لَا تَجۡهَرُوۡا لَهٗ بِالۡقَوۡلِ کَجَهۡرِ بَعۡضِکُمۡ لِبَعۡضٍ اَنۡ تَحۡبَطَ اَعۡمَالُکُمۡ وَ اَنۡتُمۡ لَا تَشۡعُرُوۡنَ
‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা নবীর আওয়াজের উপর তোমাদের আওয়াজ উঁচু করো না এবং তোমরা নিজেরা পরস্পর যেমন উচ্চস্বরে কথা বল, তাঁর সাথে সেরকম উচ্চস্বরে কথা বলো না। এ আশঙ্কায় যে তোমাদের সকল আমল-নিষ্ফল হয়ে যাবে অথচ তোমরা উপলব্ধিও করতে পারবে না।’ (সুরা হুজরাত : আয়াত ২)
اِنَّ الَّذِیۡنَ یَغُضُّوۡنَ اَصۡوَاتَهُمۡ عِنۡدَ رَسُوۡلِ اللّٰهِ اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ امۡتَحَنَ اللّٰهُ قُلُوۡبَهُمۡ لِلتَّقۡوٰی ؕ لَهُمۡ مَّغۡفِرَۃٌ وَّ اَجۡرٌ عَظِیۡمٌ
নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর রাসুলের কাছে নিজদের আওয়াজ অবনমিত করে, আল্লাহ তাদেরই অন্তরগুলোকে তাকওয়ার জন্য বাছাই করেছেন, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপ্রতিদান।’ (সুরা হুজরাত : আয়াত ৩)
৬. বুদ্ধি খাটিয়ে কথা বলা। আল্লাহ তাআলা বলেন-
اُدۡعُ اِلٰی سَبِیۡلِ رَبِّکَ بِالۡحِکۡمَۃِ وَ الۡمَوۡعِظَۃِ الۡحَسَنَۃِ وَ جَادِلۡهُمۡ بِالَّتِیۡ هِیَ اَحۡسَنُ
‘তুমি মানুষকে তোমার রবের পথে আহবান কর হিকমাত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে আলোচনা কর সুন্দরভাবে।’ (সুরা নাহল : আয়াত ১২৫)
৭. গাধার মতো কর্কশ স্বরে কথা না বলা। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ اقۡصِدۡ فِیۡ مَشۡیِکَ وَ اغۡضُضۡ مِنۡ صَوۡتِکَ ؕ اِنَّ اَنۡکَرَ الۡاَصۡوَاتِ لَصَوۡتُ الۡحَمِیۡرِ
‘আর তোমার চলার ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন কর, তোমার আওয়াজ নীচু কর; নিশ্চয় সবচাইতে নিকৃষ্ট আওয়াজ হল গাধার আওয়াজ।’ (সুরা লোকমান : আয়াত ১৯)
৮. উত্তম কথা বলে শত্রুকে বন্ধুতে পরিণত করা। উত্তম কথায় আল্লাহর পথে দাওয়াত দেওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ لَا تَسۡتَوِی الۡحَسَنَۃُ وَ لَا السَّیِّئَۃُ ؕ اِدۡفَعۡ بِالَّتِیۡ هِیَ اَحۡسَنُ فَاِذَا الَّذِیۡ بَیۡنَکَ وَ بَیۡنَهٗ عَدَاوَۃٌ کَاَنَّهٗ وَلِیٌّ حَمِیۡمٌ
ভাল ও মন্দ সমান হতে পারে না। উৎকৃষ্ট (ভালো কথার) দ্বারা মন্দ প্রতিহত কর; তাহলে যাদের সঙ্গে তোমার শত্রুতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত।’ (সুরা হামীম আস-সাজদাহ : আয়াত ৩৪)
৯. ঈমানদারের কথা ও কাজ এক হওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لِمَ تَقُوۡلُوۡنَ مَا لَا تَفۡعَلُوۡنَ
‘হে মুমিনগণ! তোমরা এমন কথা কেন বল যা তোমরা কর না।’ (সুরা সফ : আয়াত ২)
১০. خُذِ الۡعَفۡوَ وَ اۡمُرۡ بِالۡعُرۡفِ وَ اَعۡرِضۡ عَنِ الۡجٰهِلِیۡنَ
‘তুমি বিনয় ও ক্ষমা পরায়ণতার নীতি গ্রহণ কর, এবং লোকদেরকে সৎ কাজের নির্দেশ দাও, আর মূর্খদেরকে এড়িয়ে চল।’ (সুরা আরাফ : আয়াত ১৯৯)
হজরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত একটি ঘটনা রয়েছে যে, ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফত আমলে উয়াইনাহ ইবনে হিসন একবার মদিনায় আসে এবং স্বীয় ভ্রাতুস্পপুত্র হুর ইবন কায়সের মেহমান হয়। হুর ইবনে কায়স ছিলেন সে সমস্ত বিজ্ঞ আলেমদের একজন যারা ফারুকে আজম রাদিয়াল্লাহু আনহুর পরামর্শ সভায় অংশগ্রহণ করতেন। উয়াইনাহ স্বীয় ভ্রাতুস্পপুত্র হুরকে বলল, তুমি তো আমিরুল মুুমিনিনের একজন অতি ঘনিষ্ঠ লোক; আমার জন্য তার সাথে সাক্ষাতের একটা সময় নিয়ে এসো।
হুর ইবনে কায়স রাদিয়াল্লাহু আনহু ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে নিবেদন করলেন যে, আমার চাচা উয়াইনাহ আপনার সঙ্গে সাক্ষাত করতে চান। তখন তিনি অনুমতি দিয়ে দিলেন। কিন্তু উয়াইনাহ ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহুর দরবারে উপস্থিত হয়েই একান্ত অমার্জিত ও ভ্রান্ত কথাবার্তা বলতে লাগল যে, আপনি আমাদের না দেন আমাদের ন্যায্য অধিকার, না করেন আমাদের সঙ্গে ন্যায় ও ইনসাফের আচরণ।
ওমর ফারক রাদিয়াল্লাহু আনহু তার এসব কথা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে হুর ইবন কায়স নিবেদন করলেনঃ হে আমিরুল মুমিনিন, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-
خُذِ الۡعَفۡوَ وَ اۡمُرۡ بِالۡعُرۡفِ وَ اَعۡرِضۡ عَنِ الۡجٰهِلِیۡنَ
‘তুমি বিনয় ও ক্ষমা পরায়ণতার নীতি গ্রহণ কর, এবং লোকদেরকে সৎ কাজের নির্দেশ দাও, আর মূর্খদেরকে এড়িয়ে চল।’ (সুরা আরাফ : আয়াত ১৯৯)
আর এ লোকটিও জাহেলদের একজন। এই আয়াতটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহুর সমস্ত রাগ শেষ হয়ে গেল এবং তাকে কোনো কিছুই বললেন না। ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহুর ব্যাপারে প্রসিদ্ধ ছিল যে, আল্লাহর কিতাবে বর্ণিত হুকুমের সামনে তিনি ছিলেন উৎসর্গিত প্ৰাণ।’ (বুখারি ৪৬৪২)
১১. নারীরা পর-পুরুষের সঙ্গে আহলাদিভাবে কথা না বলা তবে সুন্দ ও ন্যয়সঙ্গত কথা বলা। আল্লাহ তাআলা বলেন-
یٰنِسَآءَ النَّبِیِّ لَسۡتُنَّ کَاَحَدٍ مِّنَ النِّسَآءِ اِنِ اتَّقَیۡتُنَّ فَلَا تَخۡضَعۡنَ بِالۡقَوۡلِ فَیَطۡمَعَ الَّذِیۡ فِیۡ قَلۡبِهٖ مَرَضٌ وَّ قُلۡنَ قَوۡلًا مَّعۡرُوۡفًا
হে নবীর পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও, যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর তাহলে পর-পুরুষের সঙ্গে কোমল কন্ঠে এমনভাবে কথা বল না যাতে অন্তরে যার ব্যাধি রয়েছে সে প্রলুব্ধ হয় এবং তোমরা ন্যায় সঙ্গত কথা বলবে।’ (সুরা আহযাব : আয়াত ৩২)
১২. মুর্খ ও অজ্ঞদের সাধ্যমতো এড়িয়ে চলা। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ عِبَادُ الرَّحۡمٰنِ الَّذِیۡنَ یَمۡشُوۡنَ عَلَی الۡاَرۡضِ هَوۡنًا وَّ اِذَا خَاطَبَهُمُ الۡجٰهِلُوۡنَ قَالُوۡا سَلٰمًا
‘আর রাহমান-এর বান্দা তারাই, যারা জমিনে অত্যন্ত বিনম্রভাবে চলাফেরা করে এবং যখন জাহেল ব্যক্তিরা তাদেরকে (অশালীন ভাষায়) সম্বোধন করে, তখন তারা বলে, সালাম।’ (সুরা ফুরকান : আয়াত ৬৩)
তাইতো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, তার উচিত কথা বললে ভালো কথা বলা, অন্যথায় চুপ থাকা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সব সময় সুন্দর ও উত্তম কথা বলার তাওফিক দান করুন। কথা বলার ক্ষেত্রে কোরআনের নির্দেশ ও আদবগুলো মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।