ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে নগরে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী ও আন্দোলনকারীদের ওপর হামলাকারীরা এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
অথচ, তাদের ভয়েই জুলাই থেকে গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত অজানা আতঙ্কে ছিল ছাত্র-জনতা, গণমাধ্যমকর্মী থেকে শুরু করে আন্দোলনে সমর্থনকারীরা।
দুয়েকটি ঘটনায় মামলা হলেও প্রকাশ্য অস্ত্রধারীরা ধরা পড়ছে না। তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন বরিশাল নগরবাসী।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের শিক্ষার্থীরা শুরু থেকেই কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে বরিশালের প্রধান প্রধান সড়কগুলোয় সরব ছিলেন। এতে খুবই অল্প সময়ে যুক্ত হন শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ, সরকারি পলিটেকনিক কলেজ, সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ, সরকারি মহিলা কলেজ, বরিশাল কলেজসহ সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও।
ফলে মধ্য জুলাইয়ের আগে থেকেই বিভাগীয় শহরে কোটা সংস্কারের দাবি জোরালো হতে শুরু করে। এর মধ্যেই সরকারি ব্রজমোহন কলেজে ছাত্রলীগ হামলা চালায় আন্দোলনকারীদের ওপর। পরবর্তীতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শক্ত প্রতিরোধের কারণে সদ্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তকমা পাওয়া ছাত্রলীগ সেসময় আর ক্যাম্পাসে অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি। একই অবস্থা দেখা যায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যখন তীব্র হতে শুরু করে, তৎকালীন পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে মারমুখী হয়। পুলিশের লাঠিপেটাসহ হয়রানিতেও মাঠ থেকে সরে না যাওয়ায় পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের রয়ে যায়। তখন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সবকটি গ্রুপ। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ, শ্রমিক লীগসহ আওয়ামীমনা সবগুলো সংগঠন মাঠে নামে আন্দোলন দমনে। শুরু হয় নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড।
আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১৭ জুলাই রাতে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে যুবলীগ, শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নগরে মোটরসাইকেল মহড়া দেয়। আন্দোলনকারীদের রাজপথ থেকে হটিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি পুরো নগরে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। বাসা-বাড়ি, মেসসহ বহু আবাস্থলে তল্লাশি শুরু করে তারা। ১৮ ও ১৯ জুলাইও তারা এ ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। বরিশালের রাজপথে, শ্রমিকলীগ ও ছাত্রলীগের অনুসারীরা দেশিয় অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়। তাদের ভয়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন কৌশল পাল্টালে হামলার খড়্গ ওঠে বিএনপির ঘাড়ে।
১৯ জুলাই বিকেলে নগরের চৌমাথা এলাকায় মহানগর বিএনপির কর্মসূচিতে হামলা চালায় মহানগর আওয়ামী লীগ। আর এরপর পরই বরিশাল নগর দাপিয়ে বেড়ায় সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারীদের পাশাপাশি সাবেক সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি জাহিদ ফারুক শামীম, সাবেক মেয়র ও সাদিক আব্দুল্লাহর চাচা আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতের অনুসারীরা। দেশি-বিদেশি অস্ত্র, স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মহড়া দিতে দেখা যায় সাদিক আব্দুল্লাহ, মাহমুদুল হক খান মামুনের মতো নেতাদের। ৫ আগস্ট পর্যন্ত এসব ভীতির মাঝেই আন্দোলন চালিয়ে যায় শিক্ষার্থীরা।
মাঠে থাকা সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সংবাদ কাভার করতে গিয়ে কখনও পুলিশ আবার কখনও কথিত আন্দোলনকারীদের হামলার শিকার হয়েছেন তারা। ভীতির মাঝেই অস্ত্রধারীদের ছবি তুলতে গিয়েও হেনস্থা-লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। অবশ্য, সমন্বয়কদের পক্ষ থেকে বরিশালে কোনো সহিংসতায় তাদের কেউ জড়িত ছিল না- শুরু থেকেই দাবি করা হচ্ছিল।
আওয়ামী লীগ ও তার সবগুলো অঙ্গসংগঠনের ক্যাডারবাহিনী অস্ত্র হাতে অবস্থান নেওয়ার বহু ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বেশ কিছু ছবিতে কারা কারা এ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল তাদের দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কেন, কোন কারণে তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না, প্রশ্ন নগরবাসীর। তারা জানিয়েছে, ‘৩৬ জুলাই’ বিজয় অর্জনের পরও তারা আতঙ্কে থাকেন। শিক্ষার্থীদের মনেও অজানা ভয় কাজ করে।
বরিশাল নগরের চৌমাথা এলাকার বাসিন্দা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় ১৮ জুলাই থেকেই নগরে একদল মানুষকে বিভিন্ন সাইজের দা, কুড়াল, ছুড়ি এবং শটগান উঁচিয়ে হাঁটতে দেখেছি। তারা অস্ত্র উঁচিয়ে নানা ধরনের হুমকি শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষকে দিয়েছে। বিশেষ করে ১৯ জুলাই নগরের চৌমাথা এলাকায় বিএনপির ওপর হামলার পর সাদিক আব্দুল্লাহ ও তার চাচা খোকন সেরনিয়াবাতের অনুসারীরা পুলিশের সামনে যেভাবে অস্ত্রের মহড়া দিয়েছে তাতে তো মনে হয়েছে দেশে কোনো আইন নেই। আবার ৪ আগস্ট বটতলা এলাকায় সাবেক সাংসদ জাহিদ ফারুক শামীমের অন্যতম ঘনিষ্ঠজন মাহমুদুল হক খান মামুনের উপস্থিতিতে তাদের অনুসারীরাও অস্ত্রের মহড়া দিয়েছে। পুলিশের পাশে থেকে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের দমাতে জোরালো ভূমিকা রেখেছে।
তিনি বলেন, এই অস্ত্রধারীদের আইনের আওতায় না আনলে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হবে না। ফলে ভবিষ্যতেও যে কেউ অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরবে এবং সাধারণ নাগরিক ভয় দেখিয়ে কিংবা জিম্মি করে নিজেদের ফায়দা লুটবে।
এ বিষয়ে লেখক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আনিসুর রহমান খান স্বপন বলেন, যারা অস্ত্র মহড়া দিয়েছে কিংবা শিক্ষার্থীসহ আন্দোলনকারীদের ভয় দেখানোর জন্য অস্ত্রের ব্যবহার করেছে তাদের আইনের আওতায় না আনা হলে এটি প্রশ্রয়ের শামিল হবে। ফলে ভবিষ্যতে সামাজিক অবক্ষয় সৃষ্টির পাশাপাশি বরিশালে এ ধরনের দৃশ্য নগরবাসী আবার দেখবে এবং যেখান থেকে ভয়াবহ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিও সৃষ্টি হতে পারে।
যদিও এ বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন বরিশাল জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন। আর বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম সম্প্রতি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পুলিশ তৎপর। এ ধরনের ব্যক্তিদের উপস্থিতির তথ্য দিয়ে পুলিশকে সহযোগিতা করার জন্য নাগরিকদের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন, যাতে তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যায়।