ঔদ্ধত্যের কারণেই আফগানিস্তানে হেরে গেছে যুক্তরাষ্ট্র

0

আফগানিস্তানে আমেরিকার যুদ্ধ নিয়ে সম্প্রতি যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সেটা আশ্চর্যজনকভাবে স্বচ্ছ, কিন্তু আসলে অবাক হওয়ার মতো কিছু সেখানে নেই। আফগানিস্তানে গত ২০ বছর ধরে কী হচ্ছে, তা মোটামুটি সবারই জানা। বিশ্বায়নের পৃথিবীতে এখনো বিশ্বায়ন চলছে অস্বাভাবিক গতিতে, মিথ্য আর অতিরঞ্জন দিয়ে সত্যকে এখন আর ঢেকে রাখা যায় না, হয়তো কিছুটা বিলম্বিত করা যায়।

ওয়াশিংটন পোস্টের সাক্ষাতকারগুলো নেয়া হয়েছিল মূলত কেন্দ্রের ‘লেসনস লার্নড’ প্রকল্পের অংশ হিসেবে – আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর ব্যর্থতার মূল কারণগুলো যাচাই করার জন্য। সাক্ষাতকারগুলো গ্রহণ করেছে স্পেশাল ইন্সপেক্টর জেনারেল ফর আফগানিস্তান রিকন্সট্রাকশান (সিগার), যাদের মূল কাজ হলো যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ প্রচেষ্টার মধ্যে দুর্নীতি আর অদক্ষতাকে দূর করা। ২০০০ পৃষ্ঠার বেশি দীর্ঘ এই নোটে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ ও কূটনীতিক, ত্রাণ কর্মী, আফগান কর্মকর্তা ও অন্য যারা প্রায় দুই দশকের দীর্ঘ এই যুদ্ধে সরাসরি ভূমিকা রেখেছেন, তাদের মতামত উঠে এসেছে। তাছাড়া, ‘লেসনস লার্নড’ কাগজপত্রগুলো ছাড়াও সংবাদপত্রটি ডোনাল্ড রামসফেল্ডের লেখা শত শত মেমো হাতে পেয়েছে, যিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশের অধীনে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

এই ব্যক্তিরা কোন কারণগুলোর কথা উল্লেখ করেছে, যেগুলোর কারণে বাস্তব পরিস্থিতিতে শুধু ব্যর্থতারই মুখোমুখি হয়নি যুক্তরাষ্ট্র, বরং মার্কিন ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধের পরিবর্তিত লক্ষ্য হাসিল করাটাই যে অসম্ভব, সেটিও উঠে এসেছে তাদের মন্তব্যে। একটি কারণ হলো যে ঔদ্ধত্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে (এবং এর আগে ইরাক ও লিবিয়াতে) গেছে, সেটা। তারা ভেবেছিল সেখানে তারা পুরো রোমান প্রবাদের প্রয়োগ করবে – ভিনি, ভিডি, ভিসি – আসলাম, দেখলাম, জয় করলাম। অথচ যাদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হলো, সেখানকার সমাজ, সংস্কৃতি ও মানুষের ভাষা সম্পর্কে তাদের কোনো জ্ঞানই নেই। এক সাক্ষাতকারে বুশ ও ওবামা আমলে যিনি হোয়াইট হাউজের আফগান যুদ্ধের জার ছিলেন, সেই লে. জেনারেল ডগলাস লিউট বলেছেন, আফগানিস্তান সম্পর্কে আমাদের মৌলিক বোঝাপড়াটাই ছিল না – আমরা জানতাম না যে আমরা কি করছি”। ইরাক ও লিবিয়ার মতো আফগান সমাজও মূলত গোষ্ঠিভিত্তিক এবং আধুনিক পশ্চিমা সমাজ ব্যবস্থা থেকে এখন সম্পর্ক, মূল্যবোধ ও ক্ষমতার কাঠামো সম্পূর্ণ আলাদা। আফগান জনগণের প্রায় ৬০ শতাংশই হলো পশতুন এবং দেশের সবচেয়ে বড় গোষ্ঠি তারা, যারা বহু পুরো জীবনধারা অনুসরণ করে থাকে এবং যারা ১৯ শতকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল, আশির দশকে তারা রাশিয়ানদের পরাজিত করেছিল – যারা ছিল আমেরিকানদের চেয়ে অনেক কঠিন।

দ্বিতীয়ত, সেখানে মোতায়েনকৃত সেনা, কর্মকর্তা এবং অধিকাংশ বেসামরিক কর্মীরা সমাজ সম্পর্ক শুধু অজ্ঞই ছিল না, সেই সাথে জনগণের সংস্কৃতিকে তারা শ্রদ্ধাও করতো না। আফগানিস্তানের জীবন যাপনের ধারা নিয়ে যে ঔদ্ধত্য আর অসম্মান দেখিয়েছে তারা, সেটা আফগানদের, হৃদয় ও মন জেতার ব্যাপারটিকে অসম্ভব করে দিয়েছে।

তৃতীয়ত, আমেরিকান কমান্ডাররা এটাই ঠিক করতে পারেনি যে, কাদের সাথে তারা যুদ্ধ করছে। মার্কিন সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্সেস টিমের সাবেক এক উপদেষ্টা বলেছেন, “তারা ভেবেছিল যে, আমি তাদের কাছে একটা মানচিত্র নিয়ে যাচ্ছি যেখানে লেখা আছে কোথায় ভালো মানুষ থাকে, আর কোথায় খারাপ মানুষ”। তারা বিশ বছর ধরে যুদ্ধ করছে কি শুধু ওবিএল পাওয়ার জন্য? সেক্ষেত্রে তাদের ২০১১ সালেই দেশ ছাড়া উচিত ছিল। তারা কি তালেবানদের পরাজিত করতে চেয়েছিল? ভিয়েতনাম থেকে যদি কোন শিক্ষা নেয়া হতো, তাহলে সহজেই এটা বোঝা যেতো যে, যে গেরিলা বাহিনীর প্রতি স্থানীয়দের সমর্থন রয়েছে, তাদের সাথে লড়াই করা যায় না, তারা ইচ্ছা মতো হারিয়ে যেতে পারে আবার জেগে উঠতে পারে, আর বিশেষ করে যারা বিদেশী আগ্রাসন থেকে দেশের মাটিকে রক্ষার জন্য লড়ছে।

আরেকটি সমস্যা হলো এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ ধারণা যে, অর্থ দিয়ে সব ক্ষত সারিয়ে দেয়া যাবে। এই বিশ্বাসের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের ব্যয়ই শুধু বহুগুণে বাড়েনি বরং এটা আফগান সমাজের মধ্যে দুর্নীতিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে, যেটা আগে কখনও ছিল না আর এরপর সেটা আফগান ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে ঢুকে গেছে। মার্কিন সেনাবাহিনীর কর্নেল ক্রিস্টোফার কোলেন্দা বলেছেন, “২০০৬ সাল নাগাদ, প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের নেতৃত্বাধীন আফগান সরকার একটা চৌর্যবৃত্তিনির্ভর শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিল”। কাবুলে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কূটনীতিক রায়ান ক্রোকার বলেছেন, “আমাদের সবচেয়ে বড় প্রকল্প, দুঃখজনকভাবে এবং অবশ্যই অনিচ্ছাকৃতভাবে, যেটা হয়েছে, সেটা হলো একটা গণ দুর্নীতির সিস্টেমের জন্ম দেয়া”।

সাক্ষাতকারগুলোতে আরও বেরিয়ে এসেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে আফগানিস্তানে বিপুল সহায়তা দিয়েছে, যেগুলো ব্যবস্থাপনার মতো কোন স্পষ্ট ভিশন তাদের সামনে ছিল না। ইউএসএআইডি’র এক নির্বাহী বলেছেন, এখানে যে অর্থ আমরা ব্যয় করেছি, তার ৯০ শতাংশই ছিল অতিরিক্ত: „কোন কারণ ছাড়াই আমাদেরকে অর্থ দেয়া হয়েছে এবং সেগুলো ব্যয় করতে বলা হয়েছে, আমরা ব্যয় করেছি”। সেনা আর বেসামরিক কর্মীদেরকে এখানে নজিরবিহীণ পরিমাণে মদ আর খাবার দেয়া হয়েছে। ২০০৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর্যবেক্ষকরা জানিয়েছিলেন যে, গার্দেজের গ্যারিসনে প্রতি সপ্তাহে একটি বিমান ভর্তি করে খাবার আসে এবং ফ্রিজারগুলোতে খাবার রাখার মতো জায়গা থাকতো না। সে কারণে নতুন আসা খাবার রাখার জন্য ফ্রিজারের ভালো খাবারগুলোকে ফেলে দিতে হতো।

আরেকটি ব্যর্থতা হলো রাজনৈতিক সিস্টেমের অপব্যবহার। গোষ্ঠিভিত্তিক সমাজে গণতন্ত্র চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা স্বাভাবিকভাবেই ব্যর্থ হয়েছে এবং কাবুলে মার্কিন-বন্ধুসুলভ ও যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল সরকার বসানোর চেষ্টাটাও তাই ব্যর্থ হয়েছে। ২০০৪ সালে মি কারজাইয়ের তথাকথিত নির্বাচন এবং ২০১৪ সালে মি ঘানির নির্বাচন এবং সাম্প্রতিককালের ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের নির্বাচন (যে নির্বাচনের ফল এখনও অজানা) – এগুলো প্রমাণ করে দিয়েছে যে, আফগান ঐতিহ্যের মধ্যে নির্বাচনের ধারণাটাই নেই। এই সিস্টেমের গুরুত্বটা মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করার জন্য প্রক্রিয়াটা অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার প্রয়োজন ছিল কিন্তু একেবারে শুরু থেকেই বিভিন্ন মার্কিন সংস্থার সহায়তা নিয়ে সাজানো নির্বাচন হয়েছে যাতে কাঙ্ক্ষিত একটা ফল পাওয়া যায়। এই সব অবৈধ কর্মকাণ্ডের কারণেই সরকার বাছাইয়ের ক্ষেত্রে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ব্যাপারে আফগানদের ভবিষ্যতে আস্থাটাও হয়তো চলে গেছে।

আরেকটি অন্য ধরনের বিপর্যয় – যেটা অবশ্য এর সাথে সম্পর্কিত – সেটা হলো আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থা। অর্থের জন্য যুদ্ধ করাটা আমেরিকানদের জন্য খুবই স্বাভাবিক বিষয় হলেও অতিসম্প্রতিকালের আগে আফগানদের মধ্যে এই ধারণাটাই ছিল না। সে কারণে বেতনবিহীন তালেবানরা যুদ্ধে জিতছে, কারণ তারা লড়ছে একটা উদ্দেশ্য নিয়ে। সে কারণেই আমেরিকানদের বেতনভোগী আফগান সেনারা পালিয়ে যাচ্ছে কারণ অর্থ ছাড়া যুদ্ধের পেছনে তাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই, এবং কার্যত তারা ব্যবসায়ী। আফগান নিরাপত্তা বাহিনীকে অদক্ষ আখ্যা দিয়ে কোন মার্কিন সামরিক প্রশিক্ষকই তাদের ব্যাপারে এ আত্মবিশ্বাস দেখায়নি যে, তারা নিজেরা তালেবানদের প্রতিরোধ করতে পারবে, এবং তাদের বিরুদ্ধে পরাজয়ের মাত্রা কমিয়ে আনতে পারবে। স্পেশাল ফোর্সেস টিম আফগান পুলিশের ব্যাপারে বলেছে, তারা হলো দেশের মধ্যে ব্যারেলের একেবারে তলায় অবস্থান করছে, যে দেশটি নিজেই ব্যারেলের তলায় রয়েছে। আরেক কর্মকর্তা বলেছেন যে, এই নিরাপত্তা বাহিনীর অন্তত এক তৃতীয়াংশই হয় মাদকাসক্ত, না হলে তালেবান সদস্য।

শেষ ব্যর্থতাটা হলো আফগান নারীদেরকে ‘আধুনিক’ করে তোলার জন্য চেষ্টা চালানো। পরিবারে ও সমাজে নারীর ভূমিকার বিষয়ে সামরিক সহায়তা দিয়ে পশ্চিমা মূল্যবোধ চাপিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্তটি ব্যর্থ হতে বাধ্য এবং সেটা উল্টা আফগান সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমা রাজনৈতিক ব্যবস্থার মতো, পশ্চিমা মূল্যবোধ আফগানদের কাছে অচেনা এবং এর কিছু অংশ যদি ধীরে ধীরে তাদের গ্রহণের আগ্রহ থাকেও, সেটা হতে হবে সামরিক চাপ ছাড়া।

যে দলিল ফাঁস হয়েছে – সেখানে যদিও বহুদিন ধরে জানা বিষয়গুলোই দৃশ্যমান হয়েছে – সেটা কংগ্রেসের মধ্যে শোরগোল তৈরি করেছে এবং অন্যেরা শুধু আশাই করতে পারে যাতে এই দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচিত হওয়ায় যাতে আফগানিস্তান থেকে আমেরিকান সেনাদের আরও দ্রুত ও পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। যাতে আফগানরা তাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত সমাজ, অবকাঠামো, পরিবেশের অবশিষ্ট টুকরোগুলো কুড়িয়ে আবার দেশ গড়তে পারে। একমাত্র তখনই আফগানিস্তানে শান্তি ফিরে আসার একটা সুযোগ তৈরি হবে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com