৭৩০ দিন কারাবন্দী বেগম খালেদা জিয়া আজ মসজিদে দোয়া, কাল সমাবেশ
বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ও অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। সাবেক সেনাপ্রধান শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী তিনি। জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনীতিক হিসেবে তার খ্যাতি রয়েছে। জিয়াউর রহমানের শাহাদতের পর দেশের এক ক্রান্তিকালে বিএনপির হাল ধরেন তিনি। তুমুল জনপ্রিয় এই নারীর নেতৃত্বেই বিএনপি একাধিকবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে পেয়েছেন ‘আপসহীন নেত্রীর’ খেতাব। ইতোমধ্যে তাকে ‘মাদার অব ডেমোক্র্যাসি’ বা গণতন্ত্রের মা উপাধি দিয়েছেন দলটির নেতাকর্মীরা। শুধু দলের নেতাকর্মীই নয়, দেশজুড়ে তার কোটি কোটি ভক্ত অনুসারী রয়েছেন। কিন্তু আজ ৭৩০ দিন ধরে কারাবন্দী খালেদা জিয়া। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দী হন তিনি। জামিনে দীর্ঘসূত্রতা আর নতুন মামলায় গ্রেফতার দেখানোর কারণে জামিন পাচ্ছেন না এই মহীয়সী নারী। ফলে মুক্তিও হয়নি। বিএনপির নেতাকর্মীসহ সবারই প্রত্যাশা ছিল জামিনে কারামুক্ত হবেন খালেদা জিয়া। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। ফলে ৭৪ বছরে পা দেয়া বয়সী এই সাবেক প্রধানমন্ত্রী কারাগারেই থাকছেন। দীর্ঘ এই বন্দিদশার মধ্যে কারাগারেই পঞ্চমবারের মতো ঈদও কেটেছে তার।
আজ দোয়া, কাল সমাবেশ : এ দিকে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আগামীকাল শনিবার ঢাকায় সমাবেশসহ দুই দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার কারাগারে থাকার দুই বছর তথা ৭৩০ দিন হচ্ছে। এই দিনে তার মুক্তির দাবিতে সমাবেশ ডেকেছে বিএনপি। গত মঙ্গলবার রাতে দলের এক যৌথসভায় এই সিদ্ধান্ত হয়। সভা শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কর্মসূচি ঘোষণা করে বলেন, খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি ও সুস্বাস্থ্য কামনায় শুক্রবার দেশব্যাপী বাদ জুমা মসজিদে দোয়া মাহফিল এবং ৮ ফেব্রুয়ারি বেলা ২টায় ঢাকায় নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ ও সারা দেশে জেলা সদরে বিক্ষোভ সমাবেশ হবে। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় কারা বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলো পোস্টার ও লিফলেট প্রকাশ করবে বলে জানান বিএনপি মহাসচিব।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫এর বিচারক ড. মো: আখতারুজ্জামান জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেন। ওইদিনই তাকে আদালতের পাশে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিত্যক্ত ওই কারাগারে একমাত্র বন্দী তিনি। ২০১৯ সালের ১ এপ্রিল গুরুতর অসুস্থ হলে এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে কেবিন ব্লকে চিকিৎসা নিচ্ছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। দলের চেয়ারপারসনের মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন ধরনের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপিসহ বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন। এসব কর্মসূচির মধ্যে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন, অবস্থান ও অনশন, গণস্বাক্ষর কর্মসূচি, স্মারকলিপি প্রদান, কালো পতাকা প্রদর্শন, লিফলেট বিতরণ, জনসভা, আলোচনা সভা এবং প্রতিবাদ মিছিলের কর্মসূচি।
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বন্দী রেখে হত্যার আয়োজন সম্পন্ন করেছে নিশিরাতের অবৈধ সরকার। তিনি বলেন, দেশনেত্রীর স্বজনরা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা দিন দিন অবনতি হচ্ছে। সারাক্ষণ তীব্র ব্যথার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। বাম হাত সম্পূর্ণ বেঁকে গেছে। তার ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত, বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না, হাত-পা নাড়াতে পারছেন না। তিনি স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছেন না। তার যে ভয়াবহ অবস্থা, দ্রুত উন্নত চিকিৎসার বন্দোবস্ত করতে হবে। বিএসএমএমইউর মেডিক্যাল বোর্ড তার অসুস্থতা যে দেশে নিরাময়যোগ্য নয়, সেটি উল্লেখ করলেও আদালত তাকে জামিন দেয়নি। ন্যায়বিচারহীনতার এই বিপজ্জনক ছবি পৃথিবীতে বিরল।
যেভাবে কারাবন্দী খালেদা জিয়া : ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার রায় ঘোষণাকে ঘিরে ঢাকাসহ দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গড়ে তোলে নিñিদ্র নিরাপত্তা। খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসা থেকে আদালত পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অগণিত সদস্য মোতায়েন করা হয়। বিএনপি নেতাকর্মীরা যাতে কোনো ধরনের শোডাউন বা রাজপথে নামতে না পারেন, সেজন্য তারা ছিলেন তৎপর। তবে কোনো বাধাই আটকাতে পারেনি বিএনপির নেতাকর্মীদের। তারা সকাল থেকেই তাদের প্রিয় নেত্রীর জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন। দলের নেতাকর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত জমায়েত নিয়েই আদালতে যান খালেদা জিয়া। ওইদিন মামলার রায় শুনতে দুপুর পৌনে ১২টায় গুলশানের বাসভবন ‘ফিরোজা’ থেকে আদালতের উদ্দেশে রওনা হন তিনি। পথে পথে পুলিশ আর র্যাবের বাধা ও সরকারি দলের লোকজনের সাথে সংঘর্ষের মধ্য দিয়েই তার গাড়িবহরে যোগ দেন হাজারো নেতাকর্মী। তাদের গগনবিদারী স্লোগানগুলোর মধ্যে ছিল- ‘আমার নেত্রী আমার মা-বন্দী হতে দেব না’, ‘জেল দিবি আমায় দে-দেশনেত্রীকে খালাস দে’। তার গাড়িবহর গুলশান-১ হয়ে পুলিশ প্লাজা, হাতিরঝিল লিঙ্করোড হয়ে নাবিস্কো মোড়ে পৌঁছলে চার দিক থেকে গাড়িবহরে যোগ দিতে শুরু করেন ছাত্রদল ও যুবদলের শত শত নেতাকর্মী। বিএনপির বেশ কিছু কেন্দ্রীয় নেতাও ছুটে আসেন। গাড়িবহর তিব্বত, সাতরাস্তা দিয়ে এফডিসির মোড়ে পৌঁছলে শুরু হয় স্বতঃস্ফূর্ত গণজমায়েত। কাকরাইল এলাকায় পুলিশের সাথে সংঘর্ষের পরও পুলিশি বাধা অতিক্রম করে নেতাকর্মীরা তাদের নেত্রীর নামে বিভিন্ন স্লোগান দিতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে তার গাড়িবহর মৎস্য ভবন, প্রেস ক্লাব, কদম ফোয়ারা, হাইকোর্ট মোড়, দোয়েল চত্বর, চানখাঁরপুল অতিক্রম করে বকশীবাজারের বিশেষ আদালতে পৌঁছায়। সেদিন বেগম জিয়ার গাড়িবহরকে ঘিরে উৎসুক মানুষের মনে দেখা দেয় কৌতূহল। সড়কের উভয় পাশে বিভিন্ন অফিস ও আবাসিক ভবনে থাকা লোকজন জানালা খুলে বেগম জিয়ার গাড়িবহরের দৃশ্য অবলোকন করেন। রাস্তায়ও নেমে আসেন সাধারণ মানুষ।
মির্জা ফখরুলের বক্তব্য : বিএসএমএমইউতে গুরুতর অসুস্থ দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়াকে সরকার দুই বছর সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে বেআইনিভাবে সাজা দিয়ে আটক করে রেখেছে। তার ওপর কারা নির্যাতন চলছে। তার মুক্তির দাবিতে ও নির্যাতনের প্রতিবাদে আমরা কর্মসূচি গ্রহণ করেছি। আমরা অবিলম্বে দেশনেত্রীকে মুক্তি দিয়ে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করার দাবি জানাচ্ছি। কেননা আমরা আশঙ্কা করছি, সরকার অত্যন্ত হীন উদ্দেশ্যে তাকে এভাবে অসুস্থতাবস্থায় কারাগারে রেখে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, দেশনেত্রীর স্বাস্থ্যের যেকোনো অবনতির জন্য এই সরকারকে সব দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে এবং জনগণের সামনে তাদেরকে একদিন আদালতে দাঁড়াতে হবে।
ডিএমপি কমিশনারের সাথে সাক্ষাৎ : আগামীকালের সমাবেশের অনুমতি এখনো পায়নি বিএনপি। অনুমতির জন্য গতকালও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মো: শফিকুল ইসলামের সাথে দেখা করে কথা বলেছে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল। প্রতিনিধিদলে ছিলেনÑ বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ ও সেলিমুজ্জামান। ডিএমপি কার্যালয় থেকে বেরিয়ে আবদুস সালাম আজাদ বলেন, আমরা সমাবেশের অনুমতি চাইতে ডিএমপি কমিশনারের সাথে দেখা করেছি। তিনি সমাবেশের অনুমতির ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে আমাদের জানিয়েছেন।