ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে প্রার্থীদের মধ্যে ১১৬ জন কোটিপতি। এর মধ্যে ১০৫ জন চেয়ারম্যান পদে, আটজন ভাইস চেয়ারম্যান পদে এবং তিনজন সংরক্ষিত নারী ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী। আর চেয়ারম্যান প্রার্থীদের ৭০ দশমিক ৫১ শতাংশের পেশা ব্যবসা। ঋণগ্রস্ত প্রার্থীও আছেন, এই হার প্রতি চারজনে একজন।
এই হিসাব শুধু অস্থাবর সম্পদের ভিত্তিতে। কারণ, জমির মূল্য এলাকাভেদে একেক রকম। তাই তা হিসাবের বাইরে রাখা হয়েছে। স্থাবর সম্পদ হিসাব করলে কোটিপতি প্রার্থী আরও বাড়বে। দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে এ তথ্য তুলে ধরেছে। গতকাল রোববার রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়।
গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তুলনায় এবার কোটিপতি প্রার্থী বেড়েছে তিন গুণ। এর আগে প্রথম ধাপে ১৫০ উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রায় ৭০ শতাংশ ছিলেন ব্যবসায়ী। কোটিপতি ছিলেন ৯৪ জন।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘নির্বাচনে জনস্বার্থের বিষয়ে প্রাধান্য থাকছে না। ব্যবসায়ীরা নির্বাচনকে বিনিয়োগ এবং জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের পদকে আয় ও সম্পদ বিকাশের মাধ্যম হিসেবে দেখছেন।’ বড় দুই রাজনৈতিক দলই মাঠ পর্যায়ে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারছে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে আগামীকাল মঙ্গলবার ১৬০ উপজেলায় ভোট হবে। টিআইবি বলেছে, নির্বাচন কমিশন থেকে ১৫৭ উপজেলার প্রার্থীর হলফনামার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে ৫৯৯ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৬৮৯ জন এবং নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৫২৩ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
ঋণগ্রস্ত প্রার্থী চারজনে একজন
টিআইবির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, দ্বিতীয় ধাপে ১৫৭ উপজেলায় চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান মিলে মোট প্রার্থী ১ হাজার ৮১১ জন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ২৩৫ জন, ভাইস চেয়ারম্যান ১৬৭ জন, নারী ভাইস চেয়ারম্যান ৬০ জন (মোট ৪৬২ জন) প্রার্থী ঋণগ্রস্ত।
৩১০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ঋণ রয়েছে নেত্রকোনার পূর্বধলার চেয়ারম্যান প্রার্থী আসাদুজ্জামানের। ৯৯ কোটি ১৫ লাখ টাকার ঋণ রয়েছে কুমিল্লা সদর দক্ষিণের চেয়ারম্যান প্রার্থী মোহাম্মদ আক্তারুজ্জামানের। তালিকায় ৩ নম্বরে রয়েছেন পিরোজপুরের নেছারাবাদের ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. সোহাগ মিয়া। তাঁর ঋণ ৩৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।
ব্যবসায়ী প্রার্থী ৭০ শতাংশের বেশি
টিআইবি বলছে, দ্বিতীয় ধাপে চেয়ারম্যান প্রার্থীদের ৭০ দশমিক ৫১ শতাংশ নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ১৭ শতাংশের পেশা কৃষি। তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছেন আইনজীবী (৪ দশমিক ১৭ শতাংশ), শিক্ষক (৪ দশমিক ১৭ শতাংশ) এবং ৮.৯৮ শতাংশ অন্যান্য পেশার।
একইভাবে ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রায় ৬৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ ব্যবসায়ী। নারী ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর ৫২ শতাংশ গৃহিণী এবং ২৯ শতাংশ ব্যবসায়ী। এর পরের অবস্থানে শিক্ষক ও কৃষিজীবী।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ব্যবসায়ী প্রার্থী বেড়ে চলেছে বলে মনে করে টিআইবি। ব্যবসায়ী প্রার্থী ২০১৪ সালের চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তুলনায় এবার ৮ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে গৃহিণী, কৃষিজীবী ও শিক্ষক প্রার্থীর সংখ্যা দিন দিন কমছে।
বেড়েই চলেছে সম্পদ
টিআইবির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ক্ষমতায় থাকার সঙ্গে দ্রুত আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শুধু নির্বাচিত ব্যক্তি নন, তাদের স্ত্রী বা স্বামী ও নির্ভরশীলদের আয় ও সম্পদ বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। যারা দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় আছেন, তাদের আয় ও সম্পদ বেশি বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে স্থানীয় পর্যায়ে পরিবারতন্ত্র।
প্রার্থীদের মধ্যে অস্থাবর সম্পদের তালিকার শীর্ষে আছেন নোয়াখালীর সেনবাগের চেয়ারম্যান প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম। তাঁর মোট অস্থাবর সম্পদ ৮৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকার। তালিকার ২ নম্বরে আছেন ঢাকার ধামরাইয়ের সুধীর চৌধুরী, তাঁর সম্পদ ৩৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকার। তৃতীয় অবস্থানে আছেন মোহাম্মদ ইদ্রিস ফরাজী, তাঁর অস্থাবর সম্পদ ২২ কোটি ৮৭ লাখ টাকার।
২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তুলনায় আয় বৃদ্ধির দিক দিয়ে সবার ওপরে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের নারী ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী সোনালী খাতুন। তাঁর আয় বেড়েছে ১০ হাজার ৯০০ শতাংশ। ২০০০ শতাংশের বেশি আয় বেড়েছে আরও সাত প্রার্থীর। তাদের তিনজন নারী ভাইস চেয়ারম্যান ও দু’জন চেয়ারম্যান প্রার্থী।
অস্থাবর সম্পদের ভিত্তিতে ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তুলনায় সবচেয়ে বেশি অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ঝালকাঠি সদরের চেয়ারম্যান প্রার্থী খান আরিফুর রহমানের। তাঁর সম্পদ বেড়েছে ১১ হাজার ৬৬৬ শতাংশ। ২০০০ শতাংশের বেশি অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে আরও ৯ চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর।
জমির মালিকানার দিক দিয়ে আইনি সীমা অতিক্রম করেছেন চার প্রার্থী। আইন অনুযায়ী, একজন নাগরিক সর্বোচ্চ ১০০ বিঘা বা ৩৩ একর জমির মালিক হতে পারেন। এই তালিকার শীর্ষে আছেন শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী এস এম আমিনুল ইসলাম। তাঁর জমি ৫৪ দশমিক ৬ একর। দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন শিবালয়ের চেয়ারম্যান প্রার্থী আবদুর রহিম খান। তাঁর রয়েছে ৩৪ দশমিক ২৯ একর জমি।
টিআইবির বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত পাঁচ বছরে উপজেলা ভোটে পরাজিত প্রার্থীদের তুলনায় জনপ্রতিনিধিদের আয় ও সম্পদ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। এই সময়ে একজন প্রার্থীর আয় বেড়েছে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৯০০ শতাংশ, অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৬৬৬ শতাংশ। পাঁচ বছরে অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধিতে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা পেছনে ফেলেছেন সংসদ সদস্যদের। গেল সংসদ নির্বাচনে একজন প্রার্থীর সম্পদ বৃদ্ধির হার ছিল সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৬৫ শতাংশ, সেখানে একজন চেয়ারম্যান প্রার্থীর সম্পদ বেড়েছে ১১ হাজার শতাংশের বেশি।
সংবাদ সম্মেলনে হলফনামা বিশ্লেষণের তথ্য তুলে ধরেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট কো-অর্ডিনেটর ইকরামুল হক ইভান। উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) সুমাইয়া খায়ের, আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশনের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশনের সহকারী সমন্বয়ক (অ্যাসিস্ট্যান্ট কো-অর্ডিনেটর) রিফাত রহমান ও কে এম রফিকুল আলম।