পবিত্র রমজান মাস মুসলিম উম্মাহর দরজায় কড়া নাড়ছে, প্রস্তুতি নেবেন যেভাবে

0

পবিত্র রমজান মাস মুসলিম উম্মাহর দরজায় কড়া নাড়ছে। আর একমাসও বাকি নেই। আর কয়দিন পরেই আল্লাহ তাআলার রহমত বরকত মাগফেরাত নাজাতসহ অনেক কল্যাণের মাস রমজানুল মোবারক শুরু হবে। রমজানের অবিরত বরকত ও কল্যাণ পেতে হলে আগে থেকেই যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। কেননা যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভালো প্রস্তুতি মানেই ওই কাজটির অর্ধেক পূর্ণতা ও সফলতা অর্জিত হয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কোনো বান্দা যে কোনো ভালো কাজ বা আমল যদি যথাযথভাবে উত্তম উপায়ে করে; তবে সে আমল বা কাজ আল্লাহ তাআলা পছন্দীয় হিসেবে গ্রহণ করেন।’ (তাবারানি)
আর এ জন্য বরকত ও কল্যাণের গুরুত্বপূর্ণ মাস রমজানের বেশকিছু আগাম প্রস্তুতি রয়েছে। মুমিন মুসলমানের জন্য যে প্রস্তুতি পুরো রমজানজুড়ে রহমত বরকত মাগফেরাত নাজাত ও যাবতীয় কল্যাণের দরজা উম্মুক্ত রাখবে।

সাধারণত মানুষের প্রস্তুতি দেখলে মনে হয়-
রমজান শুধু ভোগের মাস। ভালো খাওয়ার মাস। পণ্য মজুদের মাস। আনন্দ-উৎসবের মাস। ব্যবসা-বাণিজ্যের মাস। না রমজান তা নয়, বরং রমজান হলো ত্যাগের মাস। রমজান ইবাদত-বন্দেগির মাস। আল্লাহর রহমত বরকত মাগফেরাত নাজাত ও যাবতীয় কল্যাণ পাওয়ার মাস।

রমজান আসার আগে প্রস্তুতি মানে খাবারের বিশাল সমাহার সংগ্রহের প্রস্তুতি নয়; বরং আত্মিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করাই মূল বিষয়। দুঃখজন হলেও সত্য মানুষ আত্মিক প্রস্তুতি বাদ দিয়ে খাবারের আয়োজনের দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়ে।

হজরত মুয়াল্লা ইবনে ফজল রাহমাতু্ল্লাহি আলাইহি নামে এক বিখ্যাত তাবেয়ী বলেন-
‘সালাফে সালেহিনগণ রমজানের ৬ মাস আগে থেকে আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন- হে আল্লাহ! আপনি আমাদের রমজান পর্যন্ত হায়াত দান করেন। আর রমজান শেষে তারা বাকি ৬ মাস দোয়া করতেন- হে আল্লাহ! রমজানে যা আমল করেছি; তা আপনি কবুল করে নিন।’

সুতরাং রমজানের আমল বা কাজ যেনতেনভাবে নয়; বরং পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে আদায় করতে হবে। আর তাতে আল্লাহর সন্তুষ্টিও পাওয়া যাবে। আর এতে রমজানের আগাম প্রস্তুতির জন্য ১১টি বিষয় তুলে ধরা হলো-
১. তাওবাহ-ইসতেগফার করা
রমজানের আগের সব গুনা থেকে তাওবাহ ইসতেগফার করতে হবে। কোনো অন্যায়কারী যদি ভাবে যে, রমজান চলে এসেছে, আর আমার সব গুনা এমনিতেই ক্ষমা হয়ে যাবে। বাস্তবে বিষয়টি এমন নয়। বরং আগে থেকে তাওবাহ-ইসতেগফার করে রমজানের যাবতীয় কল্যাণ লাভে নিজেকে প্রস্তুত করা খুবই জরুরি। আর তাতে আল্লাহ তাআলা ওই বান্দার আগের সব গুনা মাফ করে দিয়ে রমজানের যাবতীয় কল্যাণ দিয়ে জীবন সুন্দর করে দেবেন। এ জন্য বান্দা বেশি বেশি পড়বে-
– اَللَّهُمَّ اغْفِرْلِىْ : আল্লাহুম্মাগফিরলি, হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করে দিন।

২. রমজানের সব উপকারিতা স্মরণ করা
বরকতময় মাস রমজান সম্পর্কে কোরআন-সুন্নায় যেসব ফজিলত মর্যাদা ও উপকারিতার বর্ণনা রয়েছে, রমজান শুরু হওয়ার আগেই সেসব সম্পর্কে জেনে নেওয়া। সেসব উপকার পেতে কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনাগুলো মেনে চলার প্রস্তুতি নেওয়া। মাস রমজান আসতেছে, মানসিকভাবে বারবার এ কথার স্মরণ ও নেক আমলের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে এ দোয়াটি বেশি বেশি করা-
– اَللَّهُمَّ بَلِّغْنَا رَمَضَانَ : আল্লাহুম্মা বাল্লিগনা রামাদান। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন। অর্থাৎ রমজান পর্যন্ত হায়াত দান করুন।’

৩. মানসিক প্রতিজ্ঞা নেওয়া
রমজান মাসে পরিপূর্ণ সওয়াব ও ক্ষমা পেতে মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করা। জীবনভর যত গুনা করেছি এ রমজানে সেসব গুনা বা অন্যায় থেকে পরিপূর্ণ ক্ষমা পেতে হবে। সবচেয়ে বেশি সওয়াব পেতে হবে। রমজান শুরু হওয়ার আগে এ প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করা জরুরি।
আফসোসের বিষয়- অনেক সময় পূর্ব প্রস্তুতি না থাকার কারণে রমজান পেয়েও মুমিন মুসলমান পরিপূর্ণ সওয়াব ও ক্ষমা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়।
প্রতিজ্ঞা এমনভাবে করা যে, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য বা নিজের কাজ যেমনই হোক, আমি আমার বিগত জীবনের সবে গুনা থেকে নিজেকে মাফ করিয়ে নেব। আমার প্রতি আল্লাহকে রাজি-খুশি করিয়েই ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।

৪. ভাংতি রোজার কাজা আদায় করা
রমজান শুরু হওয়ার আগে বিগত জীবনে অসুস্থ হওয়ার কারণে বা সফরের কারণে রমজানের ফরজ রোজা কাজা হয়ে থাকলে তা যথাযথভাবে আদায় করে নেওয়া। বিশেষ করে মা-বোনদের ভাঙতি রোজা থাকতে পারে। তাই রমজানের আগে শাবান মাসের এ সময়ে কাজা রোজা আদায় করে নেওয়া। এতে দুইটি ভালো আমল বাস্তবায়িত হবে-
– প্রথমটি : বিগত জীবনের কাজা রোজা আদায় হবে। রমজানের রোজা পালনের প্রতি আগ্রহ বাড়বে।
– দ্বিতীয়টি : সুন্নাতের অনুসরণ হবে। রমজানের আগের মাস শাবানে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেশি বেশি নফল রোজা রাখতেন। রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে। কাজা রোজা আদায় করার মাধ্যমে সুন্নাতের অনুসরণও হয়ে যাবে।

৫. সাধারণ ক্ষমা পাওয়ার চেষ্টা করা
আল্লাহ তাআলা রমজান মাসে অনেক মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। তবে এ সাধারণ ক্ষমা সবার ভাগ্যে জুটে না। কেননা এ ক্ষমা পেতে হলে দুইটি কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। ক্ষমা প্রার্থনা করে তা থেকে ফিরে আসতে হবে। তাহলো-
– শিরক থেকে মুক্ত থাকা। আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শিরক না করা। কেউ ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছায়, ছোট বা বড় শিরক করে থাকলে রমজান আসার আগেই তা থেকে তাওবাহ-ইসতেগফারের মাধ্যমে ফিরে আসা।
– হিংসা থেকে মুক্ত থাকা। কারো প্রতি কোনো বিষয়ে হিংসা না করা। কারণ হিংসা মানুসের সব নেক আমলকে সেভাবে জালিয়ে দেয়; যেভাবে আগুন কাঠকে জালিয়ে দেয়। তাই হিংসা পরিহার করে মনকে ক্ষমা লাভে স্বচ্ছ রাখা।

৬. ফরজ রোজার নিয়ম-কানুন জেনে নেওয়া
রমজান মাস আসার আগে রোজা পালনের মাসআলা-মাসায়েল তথা নিয়ম-কানুনগুলো ভালোভাবে জেনে নেওয়া জরুরি। আর তাতে রমজানের রোজা নষ্ট হওয়া থেকে বা মাকরূহ হওয়া থাকে বা অন্যান্য বিষয়গুলো জেনে নেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করা।

৭. বিগত রমজানের অসমাপ্ত আমলগুলো খুঁজে বের করা
রমজান মাস আসার আগে বিগত রমজানের নেক আমলগুলো করতে না পারার কারণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করা। যেমন তা হতে পারে এমন-
– কেন নিয়মিত কোরআন অধ্যয়ন করা হয়নি?
– কেন তারাবিহ পড়া হয়নি?
– কেন দান-সহযোগিতা করা হয়নি?
– কেন ইতেকাফ করা হয়নি?
– কেন রোজাদারকে ইফতার করানো হয়নি?
– কেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের স্ঙ্গে আদায় করা সম্ভব হয়নি?
– কেন কোরআন-সুন্নার আলোচনায় বসা হয়নি?
– কেন রমজানের পরিবারের লোকদের হক আদায় করা হয়নি?
– কেন রমজানের পাড়া-প্রতিবেশি বা আত্মীয়দের হক আদায় করা হয়নি?
এ বিষয়গুলো চিহ্নিত করে নেওয়া। যেন এ বছর রমজান আসার আগে আগে চিহ্নিত কারণগুলো থেকে নিজেকে বিরত রেখে কিংবা পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করে কল্যাণকর সব নেক আমলগুলো করা যেতে পারে।

৮. শাবান মাসজুড়ে রোজা রাখার মহড়া চালু রাখা
রমজান মাসের বেশি বেশি ইবাদত করতে এবং রোজা রাখার জন্য শাবান মাসে বেশি বেশি নফল রোজা রাখা। বেশি বেশি কোরআন অধ্যয়ন করা। নফল নামাজ পড়া। তাওবাহ-ইসতেগফার করা। ত্যাগের মানসিকতা তৈরি করা। দান-সাদকাহ শুরু করা। যাতে এ মহড়ার বাস্তবায়ন পুরো রমজানজুড়ে সুন্দরভাবে চালানো যায়।

৯. রমজানের ২৪ ঘণ্টার রুটিন তৈরি করা
রমজান মাসজুড়ে যে যেই কাজেই থাকুক না কেন, পুরো সময়টি কোন কোন কাজে কীভাবে ব্যয় হবে তার একটি সম্ভাব্য রুটিন তৈরি করে নেওয়া। আগাম রুটিন থাকলে রমজানে চরম ব্যস্ততার মাঝেও নেক আমলসহ অন্যান্য কাজগুলোও ইবাদতের মধ্যেই কেটে যাবে। এক কথায় সব কাজের তালিকা করে নেওয়া।

১০. রমজানের চাঁদের অনুসন্ধান করা
শাবান মাসের ২৯ তারিখ সন্ধ্যায় চাঁদের অনুসন্ধান করা সুন্নত। বিলুপ্ত হওয়ার পথে থাকা এ সুন্নতটিকে আবারও জীবিত করার পূর্ব পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
– চাঁদ দেখা গেলে এ দোয়া পড়া-
اَللهُ اَكْبَرُ اَللَّهُمَّ أَهِلَّهُ عَلَيْنَا بِالْأَمْنِ وَ الْاِيْمَانِ وَالسَّلَامَةِ وَ الْاِسْلَامِ وَ التَّوْفِيْقِ لِمَا تُحِبُّ وَ تَرْضَى رَبُّنَا وَ رَبُّكَ الله
উচ্চারণ : আল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ঈমানি ওয়াস্সালামাতি ওয়াল ইসলামি ওয়াত্তাওফিকি লিমা তুহিব্বু ওয়া তারদা রাব্বুনা ওয়া রাব্বুকাল্লাহ।
অর্থ : আল্লাহ মহান, হে আল্লাহ! এ নতুন চাঁদকে আমাদের নিরাপত্তা, ঈমান, শান্তি ও ইসলামের সঙ্গে উদয় কর। আর তুমি যা ভালোবাস এবং যাতে তুমি সন্তুষ্ট হও, সেটাই আমাদের তাওফিক দাও। আল্লাহ তোমাদের এবং আমাদের প্রতিপালক।’ (তিরমিজি, মিশকাত)

– রমজানের চাঁদ দেখার খবর শুনেই হৃদয়ের গভীর থেকে আল্লাহর কাছে মুমিনের আকুতিভরা প্রার্থনা হবে এমন-
اللَّهُمَّ سَلِّمْنِي لرمضان، وسلم رمضان لي، وتسلمه مني مُتَقَبَّلاً
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা সাল্লিমনি লি-রমাদান, ওয়া সাল্লিম রামাদানা লি, ওয়া তাসলিমাহু মিন্নি মুতাক্বাব্বিলা।’
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আমাকে শান্তিময় রমজান দান করুন। রমজানকে আমার জন্য শান্তিময় করুন। জন্য রমজানকে শান্তিময় করে দিন। রমজানের শান্তিও আমার জন্য কবুল করুন।’ (তাবারানি)

১১. বেশি বেশি দোয়া
রমজানের আগে আল্লাহর কাছে এ প্রার্থনা করা। হে আল্লাহ! আমি যতই চেষ্টা করি, তোমার তাওফিক বা ইচ্ছা না থাকলে আমি যেমন রমজান পাবো না। আবার রমজান পেলেও রবকত লাভে সক্ষম হবো না। সুতরাং রমজান ও রমজানের নেক আমল করার তোমার কাছে চাই।

হে আল্লাহ! রমজানে মুসলিম উম্মাহকে সৌভাগ্যবানদের কাতারে নাম লেখানোর তাওফিক দান করুন। আমিন। রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের কাতারে শামিল হওয়ার তাওফিক দান করুন। রমজানের আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com