তুরস্কে ভবন নির্মাণে দুর্নীতি: চাপে এরদোয়ান

0

গত কয়েক দশকের মধ্যে ভয়াবহতম ভূমিকম্প চাপে ফেলেছে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ও সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানকে। ইতোমধ্যে দেশটিতে প্রশ্ন উঠেছে— এতো বড় মাপের ট্র্যাজেডি এড়ানো যেত কিনা এবং প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সরকার মানুষের জীবন বাঁচাতে আরও কিছু করতে পারতেন কিনা।

৬ ফেব্রুয়ারি সোমবার স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে তুরস্ক ও তার প্রতিবেশী দেশ সিরিয়া। ওই ভূমিকম্পের ১৫ মিনিট পর ৬ দশমিক ৭ মাত্রার আরও একটি বড় ভূমিকম্প এবং পরে অনেকগুলো আফটারশক হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তাৎক্ষণিক এক বিবৃতিতে বলা হয়, তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় কাহরামানমারাশ প্রদেশের গাজিয়ানতেপ শহরের কাছে ভূপৃষ্ঠের ১৭ দশমিক ৯ কিলোমিটার গভীরে ছিল ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল।

ইউএসজিএসের বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ১৯৩৯ সালের পর এটাই ছিল তুরস্কে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প।

এদিকে, চলতি বছর মে মাসে তুরস্কে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু সময়-সুযোগ ও সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও দুর্যোগ মোকাবিলা ও ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়ায় আসন্ন নির্বাচনে জয় নিয়ে ঝুঁকিতে আছেন এরদোয়ান, যিনি টানা কুড়ি বছর ধরে দেশটির রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের পদে আছেন।

তবে তুরস্কের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ হওয়া সত্ত্বেও ভূমিকম্প পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় সম্প্রতি তিনি যে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন, তাতে দেশটির অভ্যন্তরে প্রত্যাশিত সাড়া মেলেনি বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি।

ভূগর্ভের দুটি ফল্টলাইনের ওপর তুরস্কের অবস্থান। ফলে ভূমিকম্পঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর তালিকায় তুরস্কের অবস্থান বেশ ওপরের দিকে। কিন্তু দেশটিতে ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত যে বিধিমালা বা নির্দেশনা (বিল্ডিং কোড) বর্তমানে কার্যকর আছে, সেটি ৮০ বছরের পুরনো।

অনুসন্ধান এবং উদ্ধারকাজে দেরি

৬ ফেব্রুয়ারি সোমবার স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে তুরস্ক ও তার প্রতিবেশী দেশ সিরিয়া। ওই ভূমিকম্পের ১৫ মিনিট পর ৬ দশমিক ৭ মাত্রার আরও একটি বড় ভূমিকম্প এবং পরে অনেকগুলো আফটারশক হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তাৎক্ষণিক এক বিবৃতিতে বলা হয়, তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় কাহরামানমারাশ প্রদেশের গাজিয়ানতেপ শহরের কাছে ভূপৃষ্ঠের ১৭ দশমিক ৯ কিলোমিটার গভীরে ছিল ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল।

ভয়াবহ সেই তুরস্কের ৮১টি প্রদেশের ১০টিতে ব্যাপক উদ্ধার অভিযানের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেই অভিযান ‍শুরু করতে অনেক সময় লেগে যায় এবং অভিযোগ উঠেছে, বেশ কয়েকটি শহর ও গ্রামে উদ্ধার অভিযান শুরু হয়েছে ভূমিকম্পের দু-তিনদিন পর।

ভূমিকম্পে তুরস্কে ছয় হাজারেরও বেশি ভবন ধসে পড়েছে। দুর্যোগের প্রথম কয়েক ঘন্টা বেশ গুরুত্বপূর্ণ হলেও রাস্তা খারাপ থাকায় উদ্ধারকারী দলগুলোকে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিন পর্যন্ত রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়।

এরদোয়ানও স্বীকার করেছেন—তুরস্কের কাছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘তল্লাশি ও উদ্ধারকারী দল’ থাকা সত্ত্বেও সরকার যতো দ্রুত অভিযান পরিচালনা করতে চেয়েছিল তত দ্রুত হয়নি।

অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় তুরস্কে ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতা বেশি। কিন্তু দেশটির স্বেচ্ছাসেবী উদ্ধারকারী দল আকুত ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা নাসুহ মাহরুকি বিশ্বাস করেন, এবারের ভূমিকম্পের ঘটনায় রাজনীতি ঢুকে পড়েছে।

এর আগে ১৯৯৯ সালের অগাস্টে তুরস্কে বড় ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল। সে সময় উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিল দেশটির সশস্ত্র বাহিনী। কিন্তু এবার বিপর্যয়ের মাত্রা অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও সেনাবাহিনীকে উদ্ধার অভিযানে নামার অনুমতি দিতে বিলম্ব করেছে এরদোয়ানের নেতৃত্বাধীন সরকার।

বিবিসিকে নাসুহ মাহরুকি বলেন, ‘সারা বিশ্বে সবচেয়ে সংগঠিত এবং সার্বিক সক্ষমতার দিক থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় সংস্থা হল সশস্ত্র বাহিনী; তাদের হাতে প্রচুর উপকরণের মজুত রয়েছে। যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তা যত বড়ই হোক—সেনাবাহিনী সবচেয়ে দক্ষভাবে সামাল দিতে পারেন।’

অন্যদিকে, তুরস্কের বেসামরিক দুর্যোগ মোকাবিলা দপ্তরের কর্মী আছে ১০ থেকে ১৫ হাজারের মতো। আকুতের মতো কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা নিজেদের স্বেচ্ছাসেবক কর্মীদের দিয়ে সরকারি উদ্ধারকর্মীদের সহায়তা করছে বলে বিবিসিকে জানান মাহরুকি।

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে সেনাবাহিনীর সক্ষমতা ১৯৯৯ সালের তুলনায় অনেক বেশি, কিন্তু এবার উদ্ধার তৎপরতায় নামতে তাদেরকে সরকারের আদেশের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে।এ কারণে উদ্ধার ও অনুসন্ধান অভিযান শুরু করতে দেরি হয়েছে।

সতর্ক করা হয়েছিল

বছরের পর বছর ধরে তুরস্কের বাসিন্দাদের একটি বড় ধরণের ভূমিকম্পের বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছিল; কিন্তু খুব কম মানুষই ধারণা করেছিলেন যে এটি দক্ষিণপূর্বাঞ্চলীয় আনাতোলিয়ান ফল্ট বরাবর আঘাত হানবে।

এই ভূমিকম্পের প্রভাব দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত হয়েছে, কারণ এ পর্যন্ত যত ভূমিকম্প হয়েছে দেশটিতে, সেসবের বেশিরভাগই হয়েছে দেশটির উত্তর ও উত্তরপূর্বাঞ্চলে।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে তুরস্কের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ এলাজিগে একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। ওই সময় ইস্তান্বুল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির ভূতত্ত্ব প্রকৌশলী অধ্যাপক নাসি গোরুর দক্ষিণাঞ্চরে ভূমিকম্পের ঝুঁকিটি অনুমান করেছিলেন। এমনকি তিনি আদিয়ামান এবং কাহরামানমারাশ শহরের উত্তরে পরবর্তী ভূমিকম্পের পূর্বাভাসও দিয়েছিলেন।

‘আমি স্থানীয় সরকার, গভর্নর এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে সতর্ক করেছিলাম। আমি বলেছিলাম, দয়া করে আপনার শহরগুলোকে ভূমিকম্পের জন্য প্রস্তুত করার ব্যবস্থা নিন। আমরা ভূমিকম্প থামাতে পারব না, কিন্তু চাইলেই ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পারব।’

তুরস্কের অন্যতম প্রধান ভূমিকম্প প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মুস্তাফা এরদিকের মতে, আবাসিক ভবনগুলো আধুনিক বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করার কারণেই এত প্রাণহানি ঘটেছে ভূমিকম্পে । ভবন নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর অজ্ঞতা এবং অযোগ্যতাকেও দায়ী করেছেন তিনি।

বিবিসিকে এরদিক বলেন, ‘আমরা চাইলেই প্রাণহানি অনেক কমাতে পারতাম।’

ভূমিকম্প কর রহস্য

১৯৯৯ সালের ভূমিকম্পের পরে দুটি “ভূমিকম্প সংহতি কর” নামের তহবিল তৈরি করা হয়েছিল। বিভিন্ন মোবাইল ফোন কোম্পানির ভয়েস এবং ম্যাসেজিং সার্ভিসের উপর কর, ইন্টারনেট সেবা, ক্যাবল টিভি ও রেডিও’র উপর কর আরোপ করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে তুরস্কের সরকারের কোষাগারে প্রায় সাড়ে চারশ কোটি ডলার জমা হয়েছিল।

এই তহবিল ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন তৈরি এবং দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য ব্যয় করার কথা ছিল। কিন্তু ওই তহবিলের অর্থ দিয়ে কী করা হয়েছে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। এর কোন ব্যাখ্যা সরকারের কাছ থেকে কখনোই পাওয়া যাযনি।

নগর পরিকল্পনাবিদরা অভিযোগ করেছেন যে ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলগুলোতে নিয়ম মেনে ভবন তৈরি করা হয়নি এবং যেসব কোম্পানির বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিছু আর্থিক জরিমানা করে তাদের ছাড় দেয়া হয়েছিল। এর ফলে প্রায় ৬০ লাখ ভবন অপরিবর্তিত অবস্থায় থেকে যায়।

২০১৯ সালে ইস্তাম্বুলে একটি আবাসিক ভবন ধসে ২১ জন নিহতের ঘটনায় আর্থিক জরিমানা দিয়ে ছাড় দেওয়া হয়েছিল ভবনটির নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানকে। তুরস্কের তখনকার সিভিল ইঞ্জিনিয়ার চেম্বার প্রধান বলেছিলেন, এই সাধারণ ক্ষমা তুর্কি শহরগুলোকে কবরস্থানে পরিণত করবে।

বিরোধী দল সিএইচপি’র নেতা কামাল কিলিকদারোওলু বলছেন, ২০ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সরকার ভূমিকম্পের জন্য দেশকে প্রস্তুত করতে পারেনি।

এরদোয়ানের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তার রাজনীতির কারণে আজ আমরা এই অবস্থানে এসেছি।’

মেরুকরণের রাজনীতি

মে মাসে নির্বাচনের জন্য এখনও কোন প্রচার প্রচারণ শুরু হয়নি। কিন্তু এরই মধ্যে দেশটির বিরোধী দলগুলো প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা থেকে হটানোর জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করেছেন। শিগগিরই হয়তো নিজেদের মনোনীতি প্রার্থীর নামও জানাবেন তারা।

বিরোধীদের অভিযোগ, এরদোয়ান সমালোচনার ব্যাপারে ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছেন এবং সম্প্রতি তার অনেক রাজনৈদিক প্রতিপক্ষ হয় কারাগারে আছেন বা বিদেশে পালিয়ে গেছেন।

২০১৬ সালে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টা রক্তপাতের মধ্যে শেষ হয়েছিল। তখন তিনি এর প্রতিক্রিয়ায় কয়েক হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করেন এবং সেইসঙ্গে হাজারো সরকারি কর্মচারীকে বরখাস্ত করেন।

দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ৫৭% হওয়ার কারণে জীবনযাত্রার ব্যায়ও আকাশছোঁয়া হয়ে পড়েছে।

ভূমিকম্পের প্রতিক্রিয়ায় সরকারের প্রথম পদক্ষেপগুলোর মধ্যে ছিল সাময়িকভাবে টুইটার ব্লক করা, যা তুরস্কে উদ্ধারকারীদের জীবিতদের সনাক্ত করতে সহায়তা করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছিল।

তবে সরকারের দাবি, টুইটার ভুল তথ্য ছড়াতে ব্যবহার করা হচ্ছে। জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা নিয়ে সমালোচনামূলক পোস্ট করার জন্য দেশটির সরকার ইতোমধ্যে কয়েকজনকে আটকও করেছে।

জার্মানিতে নির্বাসিত তুর্কি সাংবাদিক ডেনিজ ইউসেল বিবিসিকে বলেন, ‘১৯৯৯ সালের তুর্কি ভূমিকম্প এরদোয়ানকে ক্ষমতায় আনতে সাহায্য করেছিল। বর্তমান এই বিপর্যয়ও মে মাসের নির্বাচনে ভূমিকা পালন করবে। তবে সেটা কীভাবে— তা এখনও স্পষ্ট নয়।’

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com