যে তিন উপায়ে শেষ হতে পারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অনেকে বলেছিলেন, আট মাস পর ইউক্রেন রাশিয়াকে পরাজিত করতে সক্ষম হবে। ইউক্রেনীয় বাহিনীর হাতে অন্তত ৮০ হাজার রুশ সৈন্য নিহত বা আহত হবেন। এমনকি, কৃষ্ণ সাগরে নোঙর করা রুশ যুদ্ধ জাহাজগুলো ধ্বংস হয়ে সমুদ্রের তলদেশে চলে যাবে ও ইউক্রেনের আকাশে তাদের বিমানগুলো স্বাধীনভাবে উড়তে থাকবে।
সেসময় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার বাঘা বাঘা সদস্য নিরাপত্তা ও যুদ্ধ বিশ্ষলেকদের এমন অনুমান উপহাস করে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু, যুদ্ধের এখন যে পরিস্থিতি তাতে মনে হচ্ছে, ইউক্রেন ওইসব তাচ্ছিল্যের জবাবটা ভালোভাবেই দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর সহযোগিতায় ভলোদিমির জেলেনস্কির দেশটি যুদ্ধক্ষেত্রে এমনভাবে এগিয়ে যাচ্ছে যে, পুতিন প্রশাসনের জন্য যুদ্ধে জয়লাভ করাটা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে শীত যতই ঘনীভূত হচ্ছে, রাশিয়াও যেন ততটাই প্রচ্ছন্ন ও সক্রিয় হয়ে উঠছে।
এমন পরিস্থিতিতে ২০২৩ সালে কীভাবে এ যুদ্ধের অবসান ঘটতে পারে, সে সম্পর্কে তিনটি ধারণা দিয়েছে বিশ্বের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্ট।
সংবাদমাধ্যমটি বলছে, প্রথমত এমন হতে পারে- শীতের সুযোগ নিয়ে নিজেদের ফ্রন্ট লাইনগুলোকে আরও স্থিতিশীল ও নতুন করে সেনাসদস্য সংগ্রহ করবে রাশিয়া। এরপরে সর্বশক্তি দিয়ে ইউক্রেনে আক্রমণ চালিয়ে পরাজয়ের মুখ থেকে জয় ছিনিয়ে আনবে রাশিয়া।
এক্ষেত্রে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হতে পারে, যুদ্ধ যদি চলতেই থাকে, তাহলে সামনের বছরের শুরু থেকে মাঝামাঝির আগেই ইউক্রেনের জন্য ইউরোপের সব বরাদ্দ শেষ হয়ে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রও ভলোদিমির জেলেনস্কিকে নতুন অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেবে, কারণ বাইডেন প্রশাসন এককভাবে যুদ্ধের পেছনে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ভাঙতে চাইবে না। এমনটি হলে রাশিয়ার জন্য জয়লাভ করাটা খুব সহজ হয়ে যাবে।
আবার বসন্তের শুরুতে রুশ সেনাবাহিনীর নতুন ইউনিটগুলো ইউক্রেনে তীব্র আক্রমণ শুরু করবে। ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে রুশ অধিকৃত জায়গাগুলো সরে যেতে বাধ্য হবে ইউক্রেনীয় বাহিনী।
এরই মধ্যে রাশিয়া ইউক্রেনের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ অবকাঠামো লক্ষ্য করে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে। এতে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে কয়েক মাস সময় লেগে যাবে।
এ সুযোগে কিইভের ওপর পুরোপুরি কর্তৃত্ব বিস্তার করতে সৈন্যসংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন অস্ত্রের উৎপাদনও বাড়াবে রাশিয়া। একপর্যায়ে খেরসনের প্রধান শিল্প শহর ক্রিভি রিহ, দোনেতস্কের স্লোভিয়ানস্ক ও ক্রামতোর্স্ক দখল করে নেবে পুতিন বাহিনী।
এমন পরিস্থিতিতে পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনকে রাশিয়ার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নিতে আহ্বান জানাবে। তখন জেলেনস্কির কাছে ইউরোপীয়দের আহ্বানে সাড়া দেওয়া না ছাড়া, আর কোনো উপায় থাকবে না।
দ্বিতীয় দৃশ্যকল্প হতে পারে, ‘অচলাবস্থা’। রাশিয়া কয়েক হাজার যুবককে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দিয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের কার্যকর যোদ্ধায় পরিণত করতে পারেনি। তাছাড়া অধিকাংশ চৌকশ রুশ সামরিক প্রশিক্ষক ও অভিজ্ঞ সেনা কর্মকর্তা যুদ্ধক্ষেত্রে নিযুক্ত রয়েছেন।
এমতাবস্থায় সাঁজোয়া যানের অভাবে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত তরুণ সেনারা হালকা-পদাতিক ইউনিটে পরিণত হয়েছেন। তাদের দিয়ে হয়তো কোনো সামরিক ব্যারাকে সৈন্যের অভাব পূরণ ও পরিখা খনন করা সম্ভব হবে, কিন্তু সম্মুখ যুদ্ধে তারা উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখতে পারবেন না।
এ বছরের নভেম্বরে খেরসন থেকে ঘোষণা দিয়ে প্রায় ৩০ হাজার সেনা প্রত্যাহার করে নেয় রাশিয়া। অবস্থা এতটাই বেগতিক ছিল যে, বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ রেখেই পিছু হটতে বাধ্য হন রুশ সেনারা।
অনেকে বলছেন, যুদ্ধে জয়ী হতে না পেরে পুতিন প্রশাসন ইউক্রেনের অর্থনীতিকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে। তাছাড়া বেসামরিক অবকাঠামোতে হামলার মাধ্যমে ইউক্রেনীয় নাগরিক ও সেনাদের মনোবল নষ্ট করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এরপরও খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না ক্রেমলিন।
এমন পরিপ্রেক্ষিতে ইউক্রেন ও এর মিত্রদের দুর্বল করে তুলতে যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত বা স্থিতিবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করবেন। অনেকের দাবি, পুতিন এ যুদ্ধ ২০২৪ সাল পর্যন্ত নিয়ে যাবেন।
দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, ডোলান্ড ট্রাম্প পুনরায় হোয়াইট হাউজে ফিরবেন ও ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়া বন্ধ করে দেবেন- এমন আশায় পুতিন এ যুদ্ধ ২০২৪ সাল পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাবেন।
তৃতীয় দৃশ্যকল্পটি একই সঙ্গে সবচেয়ে উৎসাহজনক ও বিপজ্জনক। সেটি হলো, বসন্তে জেলেনস্কি তার সেনাবাহিনীকে জাপোরিঝিয়ায় একটি নতুন ফ্রন্ট খোলার নির্দেশ দেবেন। গ্রীষ্ম নাগাদ ইউক্রেনীয় বাহিনীর পাঁচটি ব্রিগেড পুরো মারিওপোল ঘিরে ফেলবে ও রুশ সেনাদের পিছু হটতে বাধ্য করবে।
এদিকে, ইউক্রেন তার হিমার্স রকেট লঞ্চারগুলোকে দক্ষিণাঞ্চলে সরিয়ে নিয়ে রাশিয়া অধিকৃত ক্রিমিয়ার বন্দর, ঘাঁটি ও ডিপো লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে। এমনকি, উপদ্বীপে প্রবেশেরও হুমকি দিয়েছে ইউক্রেন।
এমন পরিস্থিতিতে পুতিনের জন্য দুটি পথ খোলা থাকবে। হয় যুদ্ধ বন্ধ করা, না হলে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা। কিন্তু বৈশ্বিক চাপের কথা মাথায় রেখে পুতিন প্রশাসন পারমাণবিক হামলা চালাতে পারবে না। সুতরাং, ঝুঁকি সত্ত্বেও ইউক্রেন জয়ী হবে।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট