ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রে বাংলাদেশের নাম
আরো একটি খারাপ বছর অতিবাহিত করেছে বৈশ্বিক গণতন্ত্র। বিখ্যাত দ্য ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সর্বশেষ গণতন্ত্র সূচকে বলা হয়েছে, গণতন্ত্রের পশ্চাৎপসারণ ঘটছে বিশ্বে। গত বছর সারা বিশ্বে গণতন্ত্রের আরো ক্ষয় হয়েছে। ১৬৭ টি দেশের ওপর চালানো বার্ষিক জরিপে বাংলাদেশের অবস্থান ৮০ নম্বরে। ৪টি ক্যাটেগরিতে ভাগ করা হয়েছে এসব দেশকে। এগুলো হলো যেসব দেশে পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র আছে তাদেরকে রাখা হয়েছে শীর্ষে। এই ক্যাটেগরির নাম দেয়া হয়েছে ‘ফুল ডেমোক্রেসি’। এরপরে রয়েছে যেসব দেশে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র রয়েছে, তাদের নাম।
এই ক্যাটেগরিকে আখ্যায়িত করা হয়েছে ‘ফ্লড ডেমোক্রেসি’ হিসেবে। বাংলাদেশের নাম রয়েছে এই ক্যাটেগরিতে। এরপরে রয়েছে ‘হাইব্রিড রেজিম’। তারপরে অবস্থান করছে কর্তৃত্ববাদী শাসন চলছে, এমন দেশের তালিকা। একে আখ্যায়িত করা হয়েছে ‘অথরিটারিয়ান রেজিম’ হিসেবে।
মোট ৫টি সূচকের ওপর ভিত্তি করে এই তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এগুলো হলো- ১. নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও বহুত্ববাদ। ২. সরকারের কার্যকারিতা। ৩. রাজনৈতিক অংশগ্রহণ। ৪. গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও ৫. নাগরিক স্বাধীনতা। এসব সূচকের ওপর ভিত্তি করে বলা হয়েছে, গত বছর সারাবিশ্বে গণতন্ত্রের ক্ষয় হয়েছে। ২০০৬ সালে এই সূচকের প্রচলন করা হয়। তার পর থেকে ১০ পয়েন্টের মধ্যে গত বছরে সর্বনিম্ন ছিল বৈশ্বিক স্কোর বা পয়েন্ট। তা হলো ৫.৪৪। ১৬৭ টি দেশের মধ্যে মাত্র ২২টি দেশে পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র ছিল বলে মনে করা হয় সূচকে। এসব দেশে বসবাস করেন ৪৩ কোটি মানুষ। কিন্তু, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশের বেশি এখনও বসবাস করেন কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে।
গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার দ্রুত অবনমন হয়েছে চীনে। সেখানকার পশ্চিমাঞ্চলীয় সিনজিয়াং প্রদেশে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বৈষম্য ও ডিজিটাল নজরদারির মতো অন্যান্য নাগরিক স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ফলে চীনা স্কোর পতনে অবদান রেখেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশ ভারতের স্কোর ৩.৩২ থেকে কমে এসে দাঁড়িয়েছে ২.২৬। ইকোনমিস্টের রিপোর্টে বলা হয়েছে, আগস্টে জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেয় ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকার। এ ছাড়া আসামে প্রায় ২০ লাখ মানুষকে নাগরিকত্বের বাইরে রাখার সিদ্ধান্ত হয়। এসব মানুষের বেশির ভাগই মুসলিম অধিবাসী। তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সূচকের অবনমনে এটি ভূমিকা রেখেছে। ওই সূচকে ৫১তম অবস্থান নিয়ে পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রের দেশের তালিকায় অবস্থান করছে ভারত। ডিসেম্বরে বৈষম্যমুলকভাবে ভারতের পার্লামেন্টে পাস হয় নাগরিকত্ব সংশোধন আইন। এই প্রক্রিয়া ২০২০ সালের সূচকে দেশটির অবনমন ঘটাবে বলে মনে করা হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রের দেশের পশ্চাৎধাবনও থামিয়ে রাখা যায় নি।
মাল্টায় সরকারের সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্নীতিবিরোধী ও সাংবাদিক ডাফনে কারুনা গালিজিয়ার খুনিদের সম্পর্কের বিষয় আবিস্কার হওয়ার পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী জোসেফ মাসকাট পদত্যাগের ঘোষণা দেন। ইকোনমিস্টের সূচক চালুর পর প্রথমবারের মতো, মাল্টা ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের ক্যাটেগরিতে নেমে আসে। এতে ভূমিকা রেখেছে সেখানকার রাজনৈতিক সঙ্কট।
সাব সাহারান আফ্রিকার ৪৪টি দেশের অর্ধেকই এই সূচকে কর্তৃত্বপরায়ণ শাসক শ্রেণিতে পড়েছে। ২৩টি দেশ দেখতে পেয়েছে তাদের গণতান্ত্রিক স্কোর কমে গেছে। উন্নতি হয়েছে মাত্র ১১টি দেশে। এসব অবনমনের জন্য দায়ী করা যেতে পারে ওই অঞ্চলে অগণতান্ত্রিক নির্বাচনকে। এমন নির্বাচন হয়েছে ফেব্রুয়ারিতে সেনেগালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। সেখানে ম্যাকি সাল-এর প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়।
তবুও অন্ধকারের নিচে কিছু আলো দেখা যেতে পারে। ফ্রান্সে ইয়েলো জ্যাকেট বিক্ষোভের জবাবে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন ধারাবাহিকভাবে টাউন হল মিটিং আহ্বান করেন। এর নাম দেয়া হয় ‘গ্রেট ন্যাশনাল ডিবেট’। এতে অনলাইনে যুক্ত হন প্রায় ২০ লাখ নাগরিক। ফলে ফ্রান্সকে ‘পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রের’ মর্যাদা ধরে রাখতে এই প্রচেষ্টা সহায়ক হয়েছে। দেশে উচ্চ পর্যায়ের অসমতা ইস্যুতে চিলিতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ শুরু হয়। তখন সরকার সর্বনিম্ন বেতন বৃদ্ধি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিক্ষোভের জবাব দেয়। এতে সম্পদশালীদের কর বৃদ্ধি করা হয়। একই সঙ্গে সরকার এ বছরে সেখানে একটি নতুন সংবিধানের ওপর গণভোট দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু যথেষ্ট মূল্যের বিনিময়ে এসেছে এই সংস্কার। ওই বিক্ষোভে মারা গেছেন কমপক্ষে ২০ জন। আহত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ।