সততা-নিষ্ঠা ও কঠোর পরিশ্রমের প্রতীক প্রাক্তন নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান
বাংলাদেশের যে ক’জন ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব তাদের সততা, মেধা, কর্মদক্ষতা, সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের মাধ্যমে সমহিমায় ইতিহাসে উজ্জ্বল স্থান করে নিয়েছেন তাদের মধ্যে প্রাক্তন নৌবাহিনী প্রধান, যোগাযোগ ও কৃষিমন্ত্রী রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান অনন্য। ১৯৩৪ সালের ৩ নভেম্বর সিলেট জেলার বিরাহীমপুরে একটি অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ও বিখ্যাত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এম এ খান।
আর মৃত্যুবরণ করেন ১৯৮৪ সালের ৬ আগস্ট। মাঝে মাত্র ৪৯ বছর সময় পেয়েছিলেন দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করার। এই অতি অল্প সময়ে একজন মানুষ তাঁর ঐকান্তিক পরিশ্রম, পারদর্শিতা, দক্ষতা ও দেশপ্রেম দিয়ে যে সমাজ ও দেশের উন্নয়নে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখতে পারেন তার অন্যতম উদাহরণ রেখে গেছেন মাহবুব আলী খান। মাহবুব আলী খানের পিতা আহমেদ আলী খান ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম মুসলিম ব্যারিস্টার। তিনি নিখিল ভারত আইন পরিষদের সদস্য ও আসাম কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাঁর মা যুবাইদা খাতুন ছিলেন অবিভক্ত বিহার, আসাম ও উড়িষ্যার জমিদার পরিবারের খান বাহাদুর ওয়াসিউদ্দিন আহমেদের কন্যা। অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ও ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি ছিলেন একজন অমায়িক ও পরোপকারী ব্যক্তি। ছোটবেলা থেকেই দরিদ্র ও অবহেলিত জনগোষ্ঠীর প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। দরিদ্র মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্য তিনি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন বিশেষ তৎপর। দরিদ্র ও অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সম্পদ ব্যবহার করে গেছেন অবলীলায়। সিলেট ও কলকাতায় শৈশব কাটিয়ে ভারতবর্ষপ্রথম পাতার পর
ভাগের পর পরিবারের সাথে তিনিও চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকাতেই কাটে তার কৈশোর। মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ভর্তি হন তৎকালীন শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ ঢাকা কলেজে। ঢাকা কলেজের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে ৫২’র উত্তাল সময়ে তিনিও রাজপথের একজন সাহসী যোদ্ধা হিসেবে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৫২ সালে তিনি পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগদান করে কোয়েটায় ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে তখন সশস্ত্র বাহিনীতে সুযোগ পাওয়া ছিল অত্যন্ত কঠিন কাজ। মাহবুব আলী খান তাঁর মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে নৌবাহিনীতে স্থান করে নেন। নৌবাহিনীতে সুযোগ পেয়ে একজন সাধারণ ক্যাডেট হিসেবে নিজেকে আটকে রাখতে চাননি তিনি। একজন চৌকস ক্যাডেট হিসেবে অনেক পাকিস্তানী ক্যাডেটদের পেছনে ফেলে তিনি যুক্তরাজ্যের রয়্যাল নেভাল কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন লাভ করে। নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণের কারিগরি বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ও পারফরমেন্স ছিল অন্যান্য ক্যাডেটদের জন্য ঈর্ষার বিষয়। ১৯৫৬ সালের ১ মে তিনি স্থায়ী কমিশন লাভ করেন। একজন চৌকস অফিসার হিসেবে তাঁর মেধা, যোগ্যতা, সাহসিকতা ও নেতৃত্বের গুণে পাকিস্তান নৌবাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ যেমন : যুদ্ধ জাহাজের গানারি অফিসার, টার্পডো ও এন্টি সাবমেরিন অফিসার, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্টাফ অফিসার ইত্যাদি পদে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
নৌবাহিনীর একজন দক্ষ ও কুশলী অফিসার হিসেবে তিনি ১৯৬৩ সালে যুক্তরাজ্যের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ কর্তৃক সম্মানজনক পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে অংশগ্রহণ করে বিজয় ছিনিয়ে আনেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন। একজন দেশপ্রেমিক সাহসী যোদ্ধা হিসেবে দেশমাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য তিনি ব্যাকুল ছিলেন। তিনি তখনই পালিয়ে দেশে আসার পরিকল্পনা করেন। তাইতো নিজের ও পরিবারের সকলের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বন্দীদশা থেকে পালিয়ে আফগানিস্তান ও ভারত হয়ে ১৯৭২ সালে তিনি তাঁর প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
বাংলাদেশে এসেই তিনি বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে একটি যুগোপযোগী ও আধুনিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে কঠোর পরিশ্রম শুরু করেন। ব্রিটিশ নৌবাহিনীসহ অন্যান্য দেশের নৌবাহিনীর সাথে তাঁর সুসম্পর্কের কারণে ঐসকল দেশ আমাদের নৌবাহিনীর মানোন্নয়নে তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৭৬ সালে যুক্তরাজ্য বাংলাদেশকে একটি নেভাল শিপ (বিএনএস ওমর ফারুক) হস্তান্তর করেন। তিনি ঐ শিপের অধিনায়ক হিসেবে তা বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। তিনি চট্টগ্রাম মার্কেন্টাইল একাডেমির প্রথম বাংলাদেশি কমান্ড্যান্ট। তিনি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত যেমন- নৌসদর দপ্তরের পার্সোনাল বিভাগের পরিচালক, নৌবাহিনীর সহকারী স্টাফ প্রধান (অপারেশন ও পারসোনাল) ইত্যাদি পদে কাজ করেন। একজন দক্ষ ও চৌকস অফিসার হিসেবে তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৭৯ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৮০ সালের ১ জানুয়ারি রিয়ার এডমিরাল পদে পদোন্নতি পান।
নৌবাহিনীর প্রধান হিসেবেও তিনি তাঁর কর্মদক্ষতা, মেধা, সততা ও নেতৃত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সফল নৌবাহিনী প্রধান। বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে বিশ্বমানের আধুনিক ও যুগোপযোগী বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর আধুনিকায়ন সূচনাই হয় তাঁর হাত ধরে। তিনি নৌবাহিনীকে একটি পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশ নৌবাহিনী আইন তৈরি করেন। নৌবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তাঁর সময়ে বিভিন্ন ধরনের আধুনিক জলযান ও সমরাস্ত্র সংগ্রহ করা হয়। তিনি বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে একটি আধুনিক ত্রিমাত্রিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসীমায় জেগে ওঠা দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের মালিকানা যখন ভারত দাবি করছিল তখন সুকৌশলে তিনি নৌবাহিনী মোতায়েন করে দ্বীপটি বাংলাদেশের দখলে রাখতে সক্ষম হয়। স্বাধীনতার পরপর বঙ্গোপসাপগরে বাংলাদেশের জলসীমায় এবং সুন্দরবন এলাকায় জলদস্যুতার হার অনেক বেড়ে যায়। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে জলদস্যুদের দমন করা সম্ভব হয়। তিনি সশস্ত্র বাহিনীর বেতন ও পেনশন কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বেতন যুগোপযোগী করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রশাসনিক পুনর্গঠনে গঠিত জাতীয় বাস্তবায়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং উপজেলা পদ্ধতির প্রবক্তা।
মাহবুব আলী খান বাংলাদেশের রাজনীতির একজন অত্যন্ত সফল, সৎ ও স্বচ্ছ ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলাদেশের যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি যোগাযোগ মন্ত্রী থাকা অবস্থায় বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার অবকাঠামো উন্নয়নে বিপ্লব সাধিত হয়। তিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। কৃষিমন্ত্রী হিসেবে কৃষি আন্দোলনকে তিনি বেগমান করে সামনে এগিয়ে নিয়ে যান। একজন মন্ত্রী হয়েও সততার মাপকাঠিতে তিনি ছিলেন একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। পারিবারিক মূল্যবোধ এবং রাজনৈতিক দর্শন এতোটাই উচ্চ পর্যায়ের ছিল যে দুর্নীতি কখনোই তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। নৌবাহিনীর প্রধান এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হয়েও তিনি অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন। দেশ ও জনগণের কল্যাণই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।
তিনি ছিলেন শহীদ জিয়ার আদর্শ ও দর্শনে অনুপ্রাণিত একজন অনন্য সাধারণ মানুষ। শহীদ জিয়ার সাথে ছিল তাঁর গভীর আত্মার সম্পর্ক। পারিবারিকভাবেও শহীদ জিয়ার সাথে তাঁর ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। শহীদ জিয়ার জ্যৈষ্ঠ পুত্র জনাব তারেক রহমানের সাথে তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা জুবাইদা রহমান বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
তিনি ১৯৫৫ সালে তাঁরই মতো একজন আদর্শবান নারী সৈয়দা ইকবালমান্দ বানুর সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের পরিবারকে আলোকিত করেছে দুই কন্যা শাহিনা খান জামান এবং ডা. জুবাইদা রহমান। শাহিনা খান জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়ন করেন, আর ডা. জুবাইদা রহমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি প্রিভেন্টিভ কার্ডিওলজি বিষয়ে যুক্তরাজ্য হতে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর জ্যৈষ্ঠ কন্যার স্বামী সৈয়দ শফিউজ্জামান বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর। তাঁর কনিষ্ঠ কন্যার স্বামী তারেক রহমান। তিনি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জ্যৈষ্ঠ পুত্র। বর্তমানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
মাহবুব আলী খান যেমন সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন গেছেন ঠিক তেমনি তাঁর পরিবারের সদস্যগণও মানবসেবায় অনন্য সাধারণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৮৫ সালে গঠন করা হয় ‘মাহবুব আলী খান মেমোরিয়াল কমিটি।’ সমাজসেবা, মানবসেবা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাশাস্ত্রে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ ও সার্কভুক্ত দেশসমূহে বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গকে রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান মেমোরিয়াল গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়।
মাহবুব আলী খান জীবিত থাকা অবস্থায় নারীর জন্য আধুনিক ও পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সিলেটের নাফিজাবানু চ্যারিটেবল হাসপাতাল ও ম্যাটারনিটি হাসপাতালের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। মাহবুব আলী খানের স্ত্রী ইকবালমান্দ বানু সমাজের অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত নারী ও শিশুদের উন্নয়নে গঠন করেন সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান ‘সুরভি’। এ সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বর্তমানে লক্ষাধিক নারী ও শিশু সরাসরি উপকৃত হচ্ছে।
তাদের দুই কন্যাও দেশ-বিদেশে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। একটি পুরো পরিবার কিভাবে মানবসেবায় নিয়োজিত থাকতে পারে তার প্রকৃত শিক্ষা পাওয়া যায় মাহবুব আলী খানের পরিবার থেকে।
১৯৮৪ সালে ঢাকায় সংগঠিত একটি বিমান দুর্ঘটনার উদ্ধার কাজ তদারকি করতে যেয়ে অসুস্থ বোধ করলে তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন দেশপ্রেমিক এ মহানায়ক। দেশগঠনমূলক এবং দেশের অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত জনগণের উন্নয়নমূলক কাজের জন্য তিনি আজও বেঁচে আছেন দেশের লক্ষ কোটি জনগণের হৃদয়ে।