কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচনে ফল ঘোষণার শেষ মুহূর্তের নাটকীয়তা নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন।
ফল ঘোষণায় বিলম্ব এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সক্ষমতা এবং ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) নিয়ে নতুন করে বিতর্ক দেখা দিতে পারে।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের এটা প্রথম পরীক্ষা ছিল। ভোটে সারা দিন তারা ভালোই করেছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সবকিছু গুলিয়ে ফেলেছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারেনি। ফলে পুরো নির্বাচন নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে ভোটে ইভিএমের ব্যবহারের বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর অভিযোগের পর ইভিএম নিয়ে এক ধরনের সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। এটা নিয়ে সংকটে পড়তে হবে।
তারা মনে করেন, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইভিএমের বর্তমান সিস্টেমের আরও আপডেট করা প্রয়োজন।
বিশেষ করে এতে ভোট পুনঃগণনার সুযোগ থাকতে হবে। এক্ষেত্রে ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রায়াল (ভিভিপ্যাট) যুক্ত করা যেতে পারে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএমে ভোট হবে কি না, তা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। সব দলের সম্মতি থাকলেই কেবল এ পদ্ধতিতে ভোট নেওয়া যেতে পারে। না হলে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে।
জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, কুসিক নির্বাচনে ফলাফল ঘোষণার আগ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ভালো ছিল।
কিন্তু ফল ঘোষণার আগ মুহূর্তে যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে বড় করে প্রশ্ন উঠবে-ইভিএম থাকার পরও কয়েকটি কেন্দ্রের ফল ঘোষণা কেন ঘণ্টাখানেক বন্ধ ছিল। জানি না ভবিষ্যতে এ প্রশ্ন কী আকারে উঠবে। সেটা রাজনৈতিক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে কি না। ফল ঘোষণায় কেন বিলম্ব হয়েছে, তা নির্বাচন কমিশনকে যথাযথ ব্যাখ্যা দিতে হবে।
তিনি বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু ফল প্রত্যাখ্যান করে আইনি লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু ১০৫ কেন্দ্রের ফল তার কাছে থাকার কথা। আইনে বলা আছে, তাৎক্ষণিকভাবে ভোটকেন্দ্রে ভোট গণনা করা হবে।
ভোটের ফলাফল পাঁচটি কপি করা হবে। একটা দেওয়া হবে প্রার্থীর পোলিং এজেন্টকে, একটি কেন্দ্রে টানিয়ে দেওয়া হবে এবং একটি বাই পোস্ট নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হবে। আরেকটি পাঠানো হবে রিটার্নিং অফিসারের কাছে। প্রতিটি কেন্দ্রের ফল আলাদাভাবে প্রার্থী কিংবা তাদের চিফ এজেন্টদের কাছে থাকার কথা। সব কেন্দ্র যখন যোগ করা হবে, তখন মোট ফলাফল পাওয়া যাবে।
সাখাওয়াত বলেন, পুনঃগণনার সুযোগ আছে। ইভিএমে পুনঃগণনা করলে একই ফল আসবে। কিন্তু এখানে টালি করার কোনো সুযোগ নেই। কেউ যদি অভিযোগ করে তার ফলাফল টেম্পারিং করা হয়েছে, তাহলে সেটা আপনি টালি করবেন কীভাবে। কারণ, আপনার কাছে কোনো পেপার ট্রায়াল নেই। এই বিষয়টি বড় হয়ে উঠতে পারে। জানি না উঠবে কি না। ভোটের ফল ঘোষণায় দেরি করা এবং সন্দেহের কারণে নির্বাচন কমিশনের এ নিয়ে বিশাল পরীক্ষায় ফেলানো হয়েছে। ইভিএমে পুনঃগণনার যে বিশাল সংকট রয়েছে তা নির্বাচন কমিশনকে ভাবতে হবে।
সাখাওয়াত বলেন, ফল ঘোষণায় দেরি হওয়ায় এখন ইভিএম নিয়ে সন্দেহ তৈরি হলো। সবাই মনে করবে ইভিএমে তো দেরি হওয়ার কথা নয়। তাহলে কেন দেরি হলো। ফলে ইভিএম নিয়ে এখন বিরাট সংকটে পড়তে হবে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা যখন চসিক নির্বাচন করি, সেটা ব্যালটে ছিল। রাত ১টার পর ফল ঘোষণা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের সবার কাছে ফল ছিল বলে তা নিয়ে কেউ সন্দেহ করতে পারেনি।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, কুসিক নির্বাচনে ১০১টি কেন্দ্রের ফলাফলে একজন প্রার্থী ৬২৯ ভোটে এগিয়ে ছিলেন। পরে চারটি কেন্দ্রে অপর প্রার্থী ৯০০ ভোটে এগিয়ে গেলেন। ইভিএমে তো সঙ্গে সঙ্গে ফলাফল পাওয়ার কথা। কিন্তু এ চারটি কেন্দ্রে কেন দেরি হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যখন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হচ্ছিল, তখন শেষ চারটি কেন্দ্রে কেন এত পার্থক্য, সেটা নিয়েও কথা উঠেছে। পরাজিত প্রার্থী অভিযোগ করেছেন তাকে কারচুপি করে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইভিএমের সীমাবদ্ধতার কারণেই এসব প্রশ্ন উঠছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে যে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে, তা অনেকটা দুর্বল ও নিম্নমানের। এতে ভোট পুনঃগণনার কোনো সুযোগ নেই। একটি ছোট নির্বাচনে জটিলতার সৃষ্টি করল, বড় ভোটের ক্ষেত্রে আরও ভয়াবহ জটিলতা হতে পারে। ইভিএম নিয়ে যে জালিয়াতি করা যায়, তা আবারও বড় করে দেখা দিয়েছে।
কুসিক ফলাফলের পর এ সন্দেহ তৈরি হয়েছে। কিন্তু ইভিএমে যদি পেপার ট্রায়াল থাকত, তাহলে এসব অভিযোগ ওঠার সুযোগ ছিল না। সামনের নির্বাচন নিয়ে আমরা এমনই বিপদে আছি।
এ ইভিএম আমাদের আরও বিপদে ফেলবে। শুধু তাই নয়, ইভিএমে অনেকে ভোটাধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। ব্যালট পেপারে যেখানে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট কাস্ট সম্ভব। সেখানে ইভিএমে ৫০-৬০ শতাংশ ভোট কাস্ট হচ্ছে। যে ইভিএম ব্যবহারে মানুষ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, সেটা ব্যবহারের কোনো কারণ আমি দেখছি না।
বদিউল আলম বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অনেক রাজনৈতিক দলের প্রশ্ন রয়েছে। সেটার পাশাপাশি কুসিক নির্বাচনে তারা সক্ষমতা প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা একজনকে আচরণবিধি মানাতে পারেনি।
তাহলে জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে কীভাবে সবাইকে তা মানাবে। নির্বাচন কমিশনারের সক্ষমতা এবং ইভিএম নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এসব সমাধান করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।